'কেউ অপরিহার্য নয়' এই বিকৃত, অবাস্তব, অবৈজ্ঞানিক দর্শন গ্রহণ করার ফল কি হয়েছিল তা পরবর্তী কাহানীতে তুলে ধরা হ'ল।
আবার এই হিন্দমোটর কারখানায় ‘কেউ অপরিহার্য নয়’ এই বিকৃত অবাস্তব দর্শনের একটা জ্বলন্ত উদাহরণ আছে। সময়টা তখন সম্ভবত ৮০সালের পর। সরকারে তখন বামপন্থীরা। জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে ৭৭সালে সরকার গঠনের পর প্রথম পাঁচ বছর পূর্ণ হ’তে চলেছে। কারখানায় তখন প্রয়াত দীনেন ভট্টাচার্যের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে CITU ইউনিয়ন ক্ষমতায় আসীন। তখন কারখানায় একটা কথা চালু ছিল সবার মুখে মুখে ইউনিয়ন তথা হিন্দমোটরের শেষ কথা দীনেন ভট্টাচার্য ও কোম্পানীর সর্বাধিনায়ক এস এল ভাট্টারের সখ্যতাই বলুন আর দ্বৈরথই বলুন চলত সমানে সমানে। হিন্দমোটরের বর্তমান মর্ম্মান্তিক দুর্দিনে এখনও কান পাতলে শোনা যায় কারখানার আনাচে কানাচে যে মজার গল্প চালু ছিল তাহ’ল শ্রমিকের স্বার্থ ও কোম্পানীর স্বার্থ নিয়ে যখন শ্রমিকের প্রতিনিধি দীনেনবাবু ও কারখানার প্রতিনিধি ভাট্টারজী দুজন দু’প্রান্তে আলোচনায় বসতেন তখন শ্রদ্ধেয় দীনেন ভট্টাচার্য তাঁর ছোটখাটো কালো শরীরের নিটোল ভুরি নাচিয়ে হাসতে হাসতে টেবিলের ওপ্রান্তে বসা কারখানার সর্বাধিনায়ক এস এল ভাট্টারের উদ্দেশ্যে বলতেন, ‘আপনার ফিফটি আমার ফিফটি’! শ্রমিক স্বার্থে ও কোম্পানীর স্বার্থে এই যুগলবন্দীর লেনদেন, বোঝাপড়ার নিখুঁত ভারসাম্যের খেলা ছিল দেখার মত। শ্রমিকনেতা শ্রদ্ধেয় দীনেনবাবু পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবার আগে ভাট্টারজীর সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসে মসৃণভাবে শেষ যে কয়েক হাজার শ্রমিককে দু দফায় স্থায়ী করে গেছেন সেই গন্ধ হাতে মেখে ঢেঁকুর তুলে গেছে পরবর্তী দীর্ঘ সময় সিটু নেতৃত্ব। তাঁর মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই তীব্র গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হ’য়ে গেছিল ঐক্যবদ্ধ সিটূ নেতৃত্ব। আর তখন বারবার একটা নামই উঠে এসেছিল হিন্দমোটরের আকাশে বাতাসে। আর সেই নাম হ’ল প্রয়াত শ্রদ্ধেয় দীনেন ভট্টাচার্য্য। তাঁর অনুপস্থিতির মুল্য কি হ’তে পারে তার নগ্ন রুপ দেখেছিল হিন্দমোটরের হাজার হাজার শ্রমিক কর্মচারী, বিভিন্ন শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন ও তাদের নেতৃবৃন্দ। সেই অস্থির সময়ে শ্রমিক কর্মচারী মাঝে সত্যকে ঢেকে রাখতে যে কথাটা সচেতন ভাবেই বারবার বলা হ’ত ইউনিয়নের পক্ষ থেকে তা হ’ল সেই ভয়ংকর অবাস্তব ও অবৈজ্ঞানিক দর্শন ‘কেউ অপরিহার্য নয়’!
যাইহোক পরবর্তী সময়ে দায়িত্বে অনেকেই এসেছিলেন যেমন বিজয় মোদক, বিনোদ দাস ইত্যাদি এমনকি সিআইটি ইউ-র তৎকালীন সর্বভারতীয় সভাপতি চিত্তব্রত মজুমদারের সক্রিয় পর্যবেক্ষণও ইউনিয়নকে তীব্র গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের হাত থেকে রক্ষা ক’রে পুনরায় ঐক্যবদ্ধ এক শৃঙ্খলিত মজবুত ট্রেড ইউনিয়নের মর্যাদা ফিরিয়ে দিতে পারেনি যা কিনা দীনেন ভট্টাচার্যের আমলে তীব্র গোষ্ঠীদ্বন্ধ মুখোশের আড়ালে হ’লেও এক ঐক্যবদ্ধ চেহারায় ছিল একথা অনস্বীকার্য। আর সেই এক এক নেতার এক এক গোষ্ঠীর পদচারণে ভারী হ’য়ে উঠেছিল হিন্দমোটরের আকাশ বাতাস, ক্ষমতা দখলের নগ্ন লড়াই-এ ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল আদর্শ, শ্রমিক স্বার্থ, কোম্পানীর উন্নতি; চরম ব্যহত হয়েছিল উৎপাদন ব্যবস্থা। বহু গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কায়েমী স্বার্থে জীর্ণ দীর্ণ সিটু ইউনিয়ন মুছে গেছিল হিন্দমোটরের বুক থেকে। আর ধীরে ধীরে নেবে আসছিল ঈশান কোল কালো করে এক ভয়ংকর ঘুটঘুটে অন্ধকারের ঘন কালো মেঘ যা কিনা সুনামীর ঝড়ের তীব্রতাকে হার মানিয়ে উড়িয়ে নিয়ে গেল পশ্চিমবঙ্গের ম্যাপ থেকে হিন্দমোটর নামক বিশাল টাইটানিক রুপী জাহাজের অস্তিত্বকে চিরদিনের মত। আজ স্মৃতি হ’য়ে আছে আইএনটিইউসি, এসএসকেইউ, এসএসইউ, সিআইটিইউ শ্রমিক কর্মচারী ও কনভয় ড্রাইভারদের ইউনিয়ন অফিস! স্মৃতি হয়ে রইল শুধু হিন্দমোটরের অ্যাম্বাসাডর, কন্টেসা, ট্রেকার, বেডফোর্ড-এর মত অভূতপূর্ব সৃষ্টি! ইতিহাস হ’য়ে রইল হিন্দমোটর ও তার নাটকীয় কায়েমী স্বার্থের শ্রমিক আন্দোলন। আজ অধিগৃহীত প্রায় সাড়ে সাতশো একর জমির মধ্যে প্রায় সাড়ে চারশো একর জমির ওপর গড়ে ওঠা বিশাল কারখানা ও তৎসংলগ্ন প্রশাসনিক ভবন, ক্যান্টিন, বাংলো, স্কুল, মন্দির, হাসপাতাল, শ্রমিক কোয়ার্টার, খেলার মাঠ ইত্যাদি ঘন অন্ধকারে নিমজ্জিত। সন্ধ্যে ৬.৩০মিঃ থেকে ৭.৩০মিঃ পর্যন্ত্য এক ঘন্টা আলো থাকে তারপর আবার ডুবে যায় বিস্তীর্ণ এলাকা ঘোর অন্ধকারে। আর সেই গাঢ় অন্ধকারের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকলে একটা গা ছমছম করা রহস্যময় ফিসফিসানি যেন অন্ধকারে ডুবে থাকা গাছের ডালে ডালে, পাতায় পাতায় শোনা যায়! মন্দিরের সামনে বিশাল তেল পুকুরের জলে ঢেউ তুলে অন্ধকারের বুক ভেদ করে ভেসে আসে বিকৃত সুরে একটা তীব্র ব্যঙ্গধ্বনি, শুনতে পাই কে বা কারা যেন বলছে,
‘কেউ অপরিহার্য নয়’!!!!!! 'কেউ অপরিহার্য নয়'! (লেখা ২১শে ফেব্রুয়ারী'২০১৫)
No comments:
Post a Comment