Powered By Blogger

Wednesday, February 21, 2024

প্রবন্ধঃ কেউ অপরিহার্য নয়! (১)

‘কেউ অপরিহার্য নয়’। এই কথাটা একসময় খুব শুনতাম। এখনও শুনি। শুনি প্রতিদিন টিভির নিউজ চ্যানেলগুলিতে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের অন্তর্কলহের পরিণামস্বরূপ ক্রমাগত দলীয় প্রচারের ঢক্কানিনাদ দলে ‘কেউ অপরিহার্য নয়’ টিভির নিউজচ্যানেল গুলিকে গ্রাস করে ফেলেছে। খবর শুনতে শুনতে ক্লান্ত শরীর মন, ক্লান্ত চোখ মুখ; কিন্তু ক্লান্তিহীন অন্তহীন খবর পরিবেশন। কথাটা শুনতাম বামপন্থীদের মুখে। দলে কেউ অপরিহার্য নয়। আর সেটা বেশী বেশী শুনতাম যখন বামপন্থীরা চূড়ান্ত ক্ষমতার শীর্ষে ছিল তখন। প্রথমদিকে তাদের সমষ্টিগত চিন্তা, সমষ্টিগত সিদ্ধান্ত, সমষ্টিগত নেতৃত্ব ইত্যাদি ইত্যাদি রাজনৈতিক দর্শন সাম্যবাদ বা সমাজতন্ত্রবাদ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আউড়াতে শুনতাম। পরবর্তীক্ষেত্রে ক্ষমতায় আসীন হওয়া মাত্র দেখা গেল ধীরে ধীরে ক্ষমতার গোলকধাম বা ভুলভুলাইয়া-ই ঘুরতে ঘুরতে এই ‘সমষ্টি’ নামক দর্শনে তথাকথিত বিশ্বাসী নীতিবাগীশরাই তথাকথিত বিকৃত ‘ব্যষ্টি’ দর্শনে আসক্ত হয়ে পড়েন। আর তখন এই তীব্র আসক্তি কোন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছায় তার প্রমাণ আমরা সারা বিশ্বে প্রতিনিয়তই দেখেছি এবং আমাদের রাজ্যেও অফিসে-কাছারিতে, কলে-কারখানায়, সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তা দেখেছি ও বর্তমানেও তা দেখছি। এমনকি ঘরে-বাইরে, পাড়ায় পাড়ায়, ক্লাবে ক্লাবে একই দৃশ্য অনুষ্ঠিত হ’য়ে চলেছে আবহমানকাল ধরে। "সেই Tradition সমানে চলেছে" - দ্রষ্টাপুরুষ এস ওয়াজেদ আলির এই একটা মন্তব্যই তাঁকে আমাদের মাঝে জীবন্ত করে রেখেছে, রাখবে চিরদিন।

এই ক্ষমতালোভী মানুষরাই নিজের স্বার্থে নিজের ক্ষমতাকে ধরে রাখতে কিম্বা ভোল পালটে ক্ষমতাসীন মানুষটির অসময়ে বা দুর্দিনে পরিবর্ত পরিস্থিতিতে পরবর্তী ক্ষমতাসীন মানুষটিকে খুশি করার তাগিদে তাঁর পক্ষে আওয়াজ তোলে 'কেউ অপরিহার্য নয়'। আর সেই পরিহার্য মানুষটির যখন অভাব অনুভূত হয় বা মৃত্যু হয় তখন ঘরে বাইরে ‘এক অপূরণীয় ক্ষতি’ বলে তাঁর অনুপস্থিতিকে চিহ্নিত করা হয়। কি অদ্ভুত নির্লজ্জ বেইমানী আর সীমাহীন সুবিধাবাদী মানসিকতা! এ সেই নিষ্ঠুর, নির্ম্মম, নৃশংস প্রবাদের জীবন্ত প্রতিফলন, ‘কাজের বেলায় কাজী, কাজ ফুরালে পাজি’। কি অদ্ভুত মস্তিষ্ক এদের! নিজের অবস্থান থেকে নিজেরাই ১৮০ডিগ্রি সরে গিয়ে নিজের অজান্তেই হোক আর ভালো মানুষের মুখোশ ধারণ করেই হোক নিজেদের নিজেরাই অপমান করে বসে! উদাহরণস্বরূপ তুলে ধরা যেতে পারে এমন অনেক দৃষ্টান্তই আমাদের চোখের সামনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।


এ প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের শাসনব্যবস্থায় জ্যোতিবাবুর অনুপস্থিতি। মমতার আক্রমণে রাজ্যের নির্বাচনী ময়দান থেকে সরে দাঁড়ালেও দেশের সংকট মুহুর্তে প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য দেশের রাজনৈতিক দলগুলির কাছে সর্ব্বসম্মতিতে তাঁর প্রশ্নাতীত গ্রহণযোগ্যতা দলীয় সংখ্যাগরিষ্ঠের অযৌক্তিক, ভুল ও ষষ্ঠরিপুর তাড়নায় ইর্ষান্বিত সিদ্ধান্তের কারণে বাস্তবায়িত হওয়ার পথে বাধার সৃষ্টি হয়। মতভেদ চরম আকার ধারণ করলে সেই অবাস্তব অবৈজ্ঞানিক যুক্তি ‘কেউ অপরিহার্য নয়’ সুকৌশলে সামনে চলে আসে। জ্যোতিবাবুর আর প্রধানমন্ত্রী হওয়া হ'ল না, দেশ একজন অসাধারণ প্রশাসক পেল না, বাঙালী নেতাজীর পর দ্বিতীয় বাঙালী প্রধানমন্ত্রী পাওয়া থেকে বঞ্চিত হ'ল ইত্যাদি যাই হ'ক না কেন সেই এক বাক্য 'কেউ অপরিহার্য নয়' গিলে ফেলল গোটা দলকে, গোটা দেশকে। পরবর্তী সময়ে যখন বামপন্থীদের পায়ের তলার মাটি সরতে সরতে বিশাল খাদ-এর আকার গ্রহণ করে তখন দ্বিধাহীন চিত্তে দলের বোদ্ধা প্রবীণ সহকর্ম্মীরা তাঁর স্মরণ সভায় দলের বর্তমান শোচনীয় অবস্থার কথা স্মরণ করে তাঁর স্মৃতিতে প্রকাশ্যে চোখের জল ফেলতে ফেলতে স্বীকার করেন জ্যোতি বসু দলে কতটা অপরিহার্য ছিলেন। কায়েমী স্বার্থের এক অদ্ভুত নির্লজ্জ প্রতিফলন!


প্রমাণ হ'ল কেউ পরিহার্য নয়। সবাই সবার জায়গায় অপরিহার্য!
ক্রমশঃ (লেখা ২১শে ফেব্রুয়ারী'২০১৫)

No comments:

Post a Comment