Powered By Blogger

Thursday, November 3, 2022

ধর্ম ও ধর্মান্তর ৩ (পূর্ব প্রকাশিত ২-এর পর)

ইচ্ছা করলেই যে নিম্ন বর্ণের যে কেউ ব্রাহ্মণ হ'তে পারে সাধনার দ্বারা এর রাস্তাও খোলা আছে হিন্দুধর্মে। যেমন পড়াশুনা ক'রে মানুষ উচ্চজ্ঞানের অধিকারী হয়, উচ্চ ডিগ্রি লাভ করে ঠিক তেমনি ব্রহ্মজ্ঞান অর্থাৎ বৃদ্ধির জ্ঞান লাভের মধ্যে দিয়ে, আচরণের মধ্যে দিয়ে মানুষ সে যে কেউ ব্রাহ্মণ হ'তে পারে। আবার অনেকের মধ্যে বৃদ্ধির জ্ঞান আছে কিন্তু সে জ্ঞান আচরণ সিদ্ধ নয় সে কিন্তু আবার ব্রাহ্মণ নয়। তাই ব্রহ্মজ্ঞান সম্পন্ন ব্রাহ্মণের ছেলে কিন্তু ব্রাহ্মণ নয়। ব্রহ্মজ্ঞান পিতা লাভ করেছে সাধনার দ্বারা কিন্তু পুত্র তা করেনি তাই সে ব্রাহ্মণ নয়। যেমন ডাক্তারের ছেলে, উকিলের ছেলে ডাক্তার বা উকিল হ'তে পারে না তার জন্য পরিশ্রম ক'রে প্রপার বিদ্যা অর্জন করতে হয় তেমনি ব্রাহ্মণের ছেলে হ'লেই ব্রাহ্মণ হয় না।
ঠিক তেমনি আবার ব্রহ্মজ্ঞান অর্জনকারী মানেই বিপ্র নয়। যে যে চলনায় চ'লে একজন ব্রহ্মজ্ঞান অর্জন করেছে সেই সেই চলনায় চ'লে জন্মবিজ্ঞানকে মেনে বংশ পরম্পরায় সাত পুরুষ চলার পর উন্নত চিন্তাভাবনা ও বিশেষ জ্ঞানের অধিকারী হ'য়ে ক্রমবর্ধনের পথে চ'লে রক্ত শোধনের মাধ্যমে বিপ্রত্ব অর্জন হয়। তখন একজনকে বিপ্র ব'লে অভিহিত করা হয়। তার রক্তের মধ্যে সেই বৃদ্ধি পাওয়ার গুণাবলীগুলি বইতে থাকে; যাকে সংস্কার বলা হয়। তখন সেইগুলিই হ'য়ে দাঁড়ায় তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। আবার একজন বিপ্র সে যদি বাঁচাবাড়ার উল্টো পথে চলে তাহলে সে ধীরে ধীরে ব্রহ্মজ্ঞান হারাতে থাকে, ম্লেচ্ছতে পরিণত হয়। কিন্তু রক্তের মধ্যে বইতে থাকে সেই পিতৃপুরুষের গুণাবলী। যে কোনও মুহুর্তে সাধনার দ্বারা পুনরায় সেই চাপা পড়া বৈশিষ্ট্যগুলিকে পুনরায় জাগাতে পারে। তবে অনেক পুরুষ ধ'রে বাঁচাবাড়ার উল্টো পথে চ'লে এবং জন্মবিজ্ঞানকে অস্বীকার করার ফলে সেই ব্রহ্মজ্ঞান লুপ্ত হ'য়ে যায়। কিন্তু ইচ্ছা করলেই শূদ্র, বৈশ্য, ক্ষত্রিয় বিপ্রত্ব অর্জন করতে পারে না। তার জন্য কয়েক পুরুষ নিজ জন্মগত বৈশিষ্ট্যের উপর দাঁড়িয়ে কঠিন নিখুঁত সাধনার দ্বারা চ'লে অন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হওয়া যায়। তার বিধান হিন্দুধর্মে আছে। কিন্তু ব্রহ্মজ্ঞান যে কোনও বর্ণের উপর দাঁড়িয়ে অর্জন করা যায় আর তখন তাকেই ব্রাহ্মণ বলে। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ বিবেকানন্দ।
তাই পৈতেধারী হ'লেই বা বিপ্র হ'লেই ব্রাহ্মণ হওয়া যায় না যদি না ব্রহ্মজ্ঞান প্রাপ্ত হয়। ব্রহ্মজ্ঞান মানে বৃদ্ধির জ্ঞান, স্বপারিপার্শ্বিক বাঁচা ও বাড়ার জ্ঞান। বিবেকানন্দকে শূদ্র ব'লে তৎকালীন সময়ে উচ্চবর্ণের কারা কারা কোন কোন বিপ্র অপমান করেছিল তাতে বিবেকানন্দের কিছু আসে যায় নি। তিনি তাঁর সাধনার দ্বারা ব্রহ্মজ্ঞান অর্থাৎ পারিপার্শ্বিক সহ বেঁচে থাকা ও বেড়ে ওঠার জ্ঞান অর্জন করেছিল যা তথাকথিত পোষাকে আশাকে সাজা ব্রাহ্মণরা পারেনি। বিবেকানন্দ তাঁর ইষ্টদেবতার সংস্পর্শে থেকে সেই জ্ঞান অর্জন ক'রে বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠা লাভের মাধ্যমে তথাকথিত ব্রাহ্মণদের অর্থাৎ যারা ব্রাহ্মণ নয় সেই বিপ্রদের গালে বিরাশী সিক্কার কষে থাপ্পড় কষিয়েছিলেন। আর সাজা সাধুর মত পৈতে সর্ব্বস্ব তথাকথিত সাজুগুজু ব্রাহ্মণদের মুখ বুঝে তা হজম করতে হয়েছিল। অথচ সর্ব্বশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ জীবন্ত ঈশ্বর পরমপুরুষ পুরুষোত্তম শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের প্রাণের মানুষ পরম ভক্ত ছিলেন সমাজ কথিত শূদ্র বিবেকানন্দ!
কিন্তু দুঃখের বিষয় এই সমস্ত জলের মত ধর্ম সংক্রান্ত পরিস্কার বিষয় সাধারণ মানুষ জানলো না, বরং আরো স্পষ্ট ক'রে বললে বলা যেতে পারে সমস্ত সম্প্রদায়ের সমস্ত শ্রেণীর মানুষকে জানানো হ' লো না। ধর্ম যে জবড়জং জটিল কিছু নয় মানুষকে বাঁচতে গেলে ও বাড়তে গেলে যা যা লাগে তাই-ই যে ধর্ম এই সহজ সরল কথাটা মানুষকে বোঝানো যায়নি বা আরো স্পষ্ট ক'রে বললে বলা যেতে পারে ধর্ম জগতের স্বার্থান্বেষী মহল নিজেদের কায়েমী স্বার্থ বজায় রাখার জন্য ধর্ম বিশ্বাসী মানুষকে ধর্ম সম্পর্কে শিক্ষিত ক'রে তোলেনি। আর মানুষও চায়নি বুঝতে। সস্তায় না ক'রে পাওয়ার বুদ্ধি, জল ঘোলা ক'রে খাওয়ার গাধার বুদ্ধি, তুকতাক, ঝাড়ফুঁক, ভড়, আংটি, তাবিজ, মাদুলী, লালনীল কালো সুতোর বাঁধন ইত্যাদির ওপর আকর্ষণ, নির্ভরতা, অন্ধবিশ্বাস মানুষকে স্বচ্ছ, পরিস্কার ঝকঝকে সুন্দর ধর্মের অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে দেয়নি। ধর্ম পালন মানে যে বিধি মাফিক চলা, নিয়ম মাফিক চলা, যে আচার আচরণ, খাদ্যখানা, জীবনযাপন, চিন্তাভাবনা, কর্মানুষ্টান আমার পারিপার্শ্বকের সবাইকে নিয়ে বাঁচাবাড়াকে ধ'রে রাখে তা সে পৃথিবীর যে প্রান্তের যে ধর্ম বা মত বা যে সম্প্রদায়ের হ'ক না কেন তাই-ই ধর্ম এই সহজ কথাটা শেখাবার ইচ্ছা ছিল না ধর্মের মাতব্বরদের। আর আচরণহীন নিয়ম সর্বস্ব কর্মানুষ্টান ও একটা ভয় ভীতির মধ্যে আচ্ছন্ন থেকে ধর্ম পালন করতো তথাকথিত ধর্ম ও ঈশ্বর বিশ্বাসী মানুষ। আরও পরিস্কার ক'রে বললে বলা যেতে পারে এরকম ধর্মের নামে অধর্মীয় আচরণ পালন করতে বাধ্য করা হ'তো; যা এখনও হ'য়ে চলেছে। ফলে গরীব মানুষ, অত্যাচারিত, শোষিত,অপমানিত লেখাপড়া না জানাওয়ালা ও ধর্মের প্রকৃত অর্থ না জানা মানুষ সমাজের ভন্ড প্রতারক অশিক্ষিত ধার্মিকদের তৈরী করা ধর্মান্তরের ফাঁদে পা দিয়ে চলেছে।-----প্রবি।
ক্রমশঃ পরবর্তী অংশ, ধর্ম ও ধর্মান্তর ৪।
( লেখা ২২শে অক্টোবর'২০২২)

No comments:

Post a Comment