সৎসঙ্গী সেজো না, সৎসঙ্গী হওয়ার চেষ্টা করো।
জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। সেই যে ছোটোবেলা থেকে দেখে আসছি আর আজও দেখছি জীবনের এই বয়স পর্যন্ত পোশাক সত্যি সত্যিই ম্যাটার করে। নিজের মনের ওপর ও পারিপার্শ্বিকের ওপর পোশাকের একটা বিরাট ভুমিকা আছে; ভূমিকা আছে মানসিক শান্তি প্রাপ্তির ওপর। ঠিক একইভাবে পুরুষের মতো নারী যখন আসে সৎসঙ্গে তখনও একইরকমভাবে নারীর সুন্দর পোশাক পরিবেশের ওপর প্রভাব পড়ে, মাতৃভাবের সৃষ্টি করে।
এ প্রসঙ্গে শ্রদ্ধেয়া বড়বৌদির কথা মনে পড়ে গেল। সময়টা ২০১৬-১৭ হবে। তাঁর সামনে বসে আছি। কথা হচ্ছে মায়েদের পোশাক নিয়ে। তখন দু'টো কেন্দ্রে ( কেন্দ্রের নাম উহ্য রাখলাম) মাতৃসম্মেলনে পড়ার জন্য মায়েদের শাড়ির আলাদা আলাদা ব্যবস্থা হয়েছিল। একইরকম শাড়ি সব মায়েরা পড়ে আসবে মাতৃসম্মেলনে। একটা কেন্দ্রে একরকম, আর একটা কেন্দ্রে আর একরকমের শাড়ি। একটা ব্যবসা শুরু ক'রে দিয়েছিল কিছু সাজা সৎসঙ্গী। সেটা বলাতে আমি সাজা সৎসঙ্গীদের চক্ষুশূল হয়েছিলাম।
যাই হ'ক, বড়বৌদিকে আমি ও আমার স্ত্রী জিজ্ঞেস করেছিলাম মাতৃসম্মেলনে এক এক কেন্দ্রে এক একরকম শাড়ি আর সেই একইরকমের শাড়ি সবাই মাতৃসম্মেলনে পড়ে আসবে এমন কোনও নির্দেশ ঠাকুরবাড়ি থেকে আছে কিনা। একথা শুনে বড়বৌদির আকাশ থেকে পড়ার অবস্থা। তিনি প্রথমে কথাটা বুঝতে না পারায় আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগান ইত্যাদি ক্লাবের জার্সির মত মাতৃসম্মেলনের জন্য কেন্দ্র অনুযায়ী কোনও আলাদা আলাদা একইরকম শাড়ি পড়ার নির্দেশ অর্থাৎ কোনও ড্রেস কোড আছে আছে কিনা। তখন তিনি বলেছিলেন, এ আবার কি অদ্ভুত কথা! তাহ'লে কে ক'টা শাড়ি কিনবে? এমন কোনও অদ্ভুত নির্দেশ ঠাকুরবাড়ি থেকে নেই। কোন কেন্দ্রে এমন ব্যবস্থা? তখন সেই সেই কেন্দ্রের নাম বলেছিলাম আর তা শুনে অবাক বিস্ময়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছিল বড়বৌদি। তখন আমার স্ত্রী বলল, তাহ'লে কি সাদা লাল পাড়ের শাড়ি পড়ে আসবে? তার উত্তরে তিনি বলেছিলেন, কার কত পয়সা আছে যে শুধু মাতৃসম্মেলনের জন্য আলাদা ক'রে একটা লাল পাড়ের শাড়ি কিনে আলমারিতে তুলে রাখবে? ঘরে যে শাড়ি থাকবে তাই-ই পড়বে। যে শাড়ি পড়লে মায়েদের মাতৃভাব ফুটে ওঠে, মিষ্টি লাগে, সুন্দর লাগে, স্নিগ্ধ লাগে সেই শাড়ি পড়বে। তা সে যতই কম দামের হ'ক আর যাই হ'ক পরিস্কার আর সুন্দর হ'লেই হ'লো। আর মাতৃভাব পোশাকের সঙ্গে আচরণেও যেন ফুটে ওঠে খেয়াল রাখতে হবে।" পরবর্তীতে একইরকম শাড়ি পড়ার আঞ্চলিক সিদ্ধান্ত দুই কেন্দ্রেই বন্ধ হ'য়ে গেছিল। ফলে ব্যবসা হয়েছিল বন্ধ।
তাই সৎসঙ্গে একসঙ্গে অনেকে সাদা ধুতি আর ফতুয়া পড়লে একটা শান্ত সৌম্য ভাব আসে, সুন্দর লাগে। পরিবেশের ওপর তার প্রভাব পড়ে। সৎসঙ্গীদের আলাদা একটা পরিচিতি হয়।
কিন্তু আমাদের মাথায় রাখতে হবে সাদা পোশাকের মর্যাদা রক্ষা না হ'লে সাদা পোশাক তার গৌরব হারায়। এখন সাদা পোশাক প্রায় সব রাজনৈতিক দল ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ধ'রে ফেলেছে। যেখানেই যে দলের কেন্দ্রীয় অনুষ্ঠান হয় সবাই সাদা পোশাকে সুসজ্জিত হ'য়েই মারণ যজ্ঞের ছক কষে। ফলে গেরুয়া পোশাকের মতো সাদা পোশাকও এখন প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে। গেরুয়া পোশাকের আর আগের মতো জৌলুশ নেই। যে গেরুয়া পোশাক ছিল ত্যাগের প্রতীক সেই পোশাক আজ ত্যাগের ওপর প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দিয়েছে। আর এঁকে দেওয়ার কাজটা একশ্রেণীর গেরুয়াধারীরা নিজেরাই করেছে। ঠিক তেমনি যেখানে যত রাজনৈতিক নোংরামো সেখানে তত সাদা পোশাকের ঝলকানি।
তাই আমরাও যারা সৎসঙ্গী তারা যেন সাদা পোশাকের মর্যাদা রক্ষা করি। ইদানিং দেখি সবাই সাদা পোশাকের সঙ্গে কাঁধে একটা একই রকমের কালো ব্যাগ ঝুলিয়ে তাকে সাদা পোশাকের সঙ্গী ক'রে নিয়েছি। সেই কবে বর্তমান শ্রীশ্রীআচার্যদেব কাঁধে একটা কালো ব্যাগ ঝুলিয়ে এয়ারপোর্টে বসেছিল তারপর থেকে সেই একই ডিজাইনের কালো ব্যাগ হ'য়ে গেল সৎসঙ্গীদের চলার সঙ্গী। হু হু ক'রে বিক্রি হ'তে লাগলো। ব্যবসা বুদ্ধি চাগাড় দিয়ে উঠলো।
ভালো অনুসরণ ভালো। কিন্তু তা যেমন পোশাকে পরিচ্ছদে ঠিক তেমনি যেন চরিত্র গঠনেও হয়। আমরা যেন প্রত্যেকেই শ্রীশ্রীবাবাইদাদার ব্যাগ অনুসরণের মতো তাঁর মনের মতো হ'য়ে উঠতে পারি। নতুবা সাজা সাধুর মতো সাজা সৎসঙ্গী হ'য়ে যাবো। আর এই সাজা সাধুর মতো সাজা সৎসঙ্গীর পোশাক প্রবণতা সুদুর প্রসারী হ'য়ে ভন্ডামীর পোশাকে গিয়ে দাঁড়াবে। মানুষের ওপর তার উল্টো প্রভাব পড়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে। সাদা পোশাকের প্রতি মানুষ বিশ্বাস হারিয়ে ফেলবে। ভবিষ্যতে সাদা রঙ তার পবিত্রতা হারিয়ে সৎসঙ্গীদের বিরোধীদের প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেবে। আমরা যেন সতর্ক থাকি। নিজের ভেতরে যেন ঝাঁক মেরে দেখি আমি সত্যি সত্যিই সৎসঙ্গী তো; সাজা সৎসঙ্গী নই তো?
শ্রীশ্রীঠাকুরের বাণী তখন সত্য হ'য়ে "সাধু সেজো না, সাধু হওয়ার চেষ্টা করো"-র বাণীর মতো 'সৎসঙ্গী সেজো না, সৎসঙ্গী হওয়ার চেষ্টা করো' বাণী বুমেরাং হ'য়ে ফিরে আসবে।
শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র আরো বললেন,
"বকলমা যদি না-ই দিস নকল সাধু সাজিস না,
সাধু সেজে গুরু হ'য়ে মানুষ নিকেশ করিস না।"
সাধু ধাঁচের কায়দা-কথা মতলববাজী অন্তরে,
ইষ্টস্বার্থে মিথ্যা উদার নাশক জানিস সেই নরে।
ইষ্টস্বার্থী ঝোঁক নাই প্রেষ্ঠকথায় হামবড়াই
নিশ্চয় জানিস ভন্ড তা'রা উদ্দেশ্য ঠক সাধু সাজাই।"
প্রবি।
No comments:
Post a Comment