১১/১১/২২ শুক্রবার থেকে ১৩/১১/২২ রবিবার যাওয়া আসা নিয়ে তিনদিনের জন্য দেওঘর গিয়েছিলাম আচার্যদেবের কাছে বিশেষ নিবেদনের উদ্দেশ্যে। আমাদের পরিবারের সঙ্গে গিয়েছিল কলকাতা থেকে গুরুবোন সোনাই ঢালি। কিন্তু খবর নিয়ে জানলাম আচার্যদেব ব্যাঙ্গালোরের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছেন সেখান থেকে যাবেন উড়িষ্যা। সম্ভবত ফিরবেন ২০তারিখ রবিবার। ইতিমধ্যে আমাদের টিকিট কাটা হ'য়ে গেছে! তাই ঠাকুরবাড়ি যাবার জন্য যখন মন স্থির করেছি তখন যাওয়াটাকেই প্রাধান্য দিলাম। তাই আর টিকিট ক্যান্সেল করলাম না। শনিবার ১২/১১/২২ সকালবেলা পূজনীয় বিঙ্কিদার দর্শন, প্রণাম ও দীর্ঘ সময় আলোচনা এবং রাতে পূজনীয় অবিনদাদার দর্শন, প্রণাম ও আলোচনায় মনপ্রাণ ভরে গেল। এবার রবিবারে ফেরার পালা। ভোর ৫টা ৫মিঃ-এ ট্রেন। উঠেছিলাম চৌধুরী ভিলায়। এবার আসি ফেরার অভিজ্ঞতায়।
শ্রীশ্রীঠাকুরের কয়েকটি প্রিয় কোটেশানের মধ্যে একটি ছিল শেক্সপিয়ারের 'হ্যামলেট' নাটকের একটি সংলাপ। সেটি হ'লো,
"There are more things in heaven and earth, Horatio, than are dreamt of in your philosophy." এর ভাবার্থ হ'লো, "স্বর্গ ও পৃথিবীর মাঝখানে আরও বহু জিনিস আছে, হোরেশিও, যা তোমার দর্শনের পাল্লার বাইরে ও অতীত।"
ফেরার সময় সত্যি অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞতা হ'লো!!!!!! যা আমার দর্শনের পাল্লার বাইরে ও অতীত! সত্যি সত্যি দয়াল সব অ্যারেঞ্জ ক'রে রেখেছেন!!!!
বাড়ি ফেরার সময় দূরন্ত লেট করার পিছনে কি কারণ ছিল আমার জানা নেই কিন্তু আমার বিশ্বাস এটা দয়ালের দয়ায় সম্ভব হয়েছে। আর আমি জানি, গভীর বিশ্বাস আর আকুল প্রার্থনায় অনেক অসম্ভব সম্ভব হয়।
আমার মনে আছে দূরন্তর জসিডি থেকে সম্ভবত ৫টা ৫মিঃ ছাড়ার কথা ছিল। কিন্তু ট্রেন লেট ছিল প্রায় ৩ঘন্টা। সেটা কভার ক'রে শেষ টাইম নেটে যা দেখিয়েছিল তা ছিল ৭টা ৫মিঃ-এ জসিডিতে আসবে। কিন্তু হঠাৎ নেট জানায় ট্রেন ৬টা ৩০মিঃ ঢুকবে মানে আরও ৩০মিঃ কভার ক'রে ফেলেছে দূরন্ত। সারা রাত কেউ ঘুমাতে পারিনি বারবার ট্রেনের টাইম দেখবার জন্য।
যাই হ'ক সময় হিসেব ক'রে সবাই চৌধুরী ভিলা থেকে বেরোয়। আমার একটু দেরী হয়েছিল বেরোতে। আমার জন্য লেট হওয়াতে মনে একটা অপরাধ বোধ জন্মেছিল। পথে শেষ আশ্রয় নাম করতে করতে যাচ্ছিলাম। অটো ছুটে চলেছে সঙ্গে ছুটে চলেছে ট্রেন মিস করার একটা আশঙ্কা। প্রাণপণে নাম করছিলাম সবাই। মাঝে মাঝে অটো ধীরগতিতে ছুটছে তখন টেনশন বেড়ে দশগুণ। অটো চালককে বলছিলাম জোড়ে চালাবার কথা কিন্তু ব্যাটারি সমস্যার কারণে মাঝে মাঝে স্লো হ'য়ে যাচ্ছে। ফলে ঐ সকালে সকলেই ঠান্ডায় উত্তেজনায় ভয়ে টেনশানে প্রায় ঘেমে যাচ্ছি।
যখন আমরা প্ল্যাটফর্মে পৌঁছলাম তখন দুরন্তর সময় অনুযায়ী ট্রেন না পাওয়ার কথা। প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা। সময় প্রায় ৬টা ৫০মিঃ। অটো থেকে নেবে তাড়াহুড়োয় ব্যাগ নিয়ে দৌড়ে আসতে যেয়ে মেয়ে আর বৌমার শরীর খারাপ হ'লো। প্রত্যেকেই যার যার ব্যাগ নিয়ে হন্তদন্ত হ'য়ে ঠাকুরের নাম করতে করতে দৌড়ে প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে শুনলাম ট্রেন এখনও স্টেশনে আসেনি। দেখলাম প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে রয়েছে অন্য একটি ট্রেন। হঠাৎ অনুভব করলাম বি-রা-ট একটা বোঝা ঝপ ক'রে মাথা থেকে কাঁধ বেয়ে নীচে নেবে গেল। শরীরটা হালকা বোধ হ'লো। মেয়ে বৌমার শরীর ভালো বোধ হ'তে লাগলো। বৌ, ছেলে, জামাই সবাই টেনশন মুক্ত হ'লো। নিজের অজান্তে উর্ধ্বে মাথা তুলে শুধু বিস্ময়ে হতবাক আমি ছলছল চোখে শুধু বললাম, 'হে দয়াল!!!!!
প্ল্যাটফর্মের গেট দিয়ে ঢুকতেই সামনেই যে বসার জায়গা ছিল সেখানে সোনাই বসেছিল মায়েদের রক্সালে তুলে দিয়ে আমাদের অপেক্ষায়। সোনাইয়ের মা আর মায়েদের একটা দল এসেছিল ঠাকুরবাড়ি। তাঁরা ফিরে যাচ্ছে রক্সালে। অদ্ভুত তাদের কারোও ফেরার টিকিট কাটা ছিল না। সোনাই ভেবেছিল, জসিডি-কলকাতা ট্রেনে তাঁরা ফিরে যাবে। সোনাইয়ের কথামতো তাঁরা এসেছিল। কিন্তু আগেরদিন রাতে যখন শুনলো সকালে জসিডি-কলকাতা ট্রেন যাবে না তখন নিজেদের মধ্যে একটু গন্ডগোল হয়েছিল। সমস্ত দোষ এসে পড়েছিল সোনাইয়ের উপর। আগের দিন রাতে জামতলা ঘরে ঠাকুরের সামনে বসে অনেকক্ষণ কেঁদেছিল সোনাই। কারণ তার কনফার্ম টিকিট আছে দুরন্ততে, সে যাবে আরামে কিন্তু অতগুলো বয়স্ক মানুষ তাদের কারোও টিকিট নেই, কি ক'রে ফিরে যাবে, সে জানতো না যে জসিডি-কলকাতা রবিবার যাবে না এই চিন্তায় চিন্তায় সে কেঁদে ভাসিয়েছিল ঠাকুরের সামনে। কিন্তু কি আশ্চর্য আজ যখন সকালে মায়েদের তুলে দিতে স্টেশনে এসেছিল তখন দেখলো কুম্ভ রক্সালের জেনারেল একদম ফাঁকা!!!! জেনারেলে মায়েদের তুলে দিয়ে নিশ্চিন্তে আমাদের অপেক্ষায় বসেছিল স্টেশনের গেট দিয়ে ঢুকতেই সামনের বসার জায়গায়।
সোনাই ঢালি সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনটাকে দেখিয়ে বলেছিলে, 'এই ট্রেনটা ছাড়তে লেট করছে তাই দূরন্ত প্ল্যাটফর্মে ঢুকতে পারছে না।' আমি বিস্ময়ে আবার বললাম, দয়াল! তুমি এত দয়াময়!? তখন সোনাই বলেছিলে, 'দয়ালের উপর অনেক চাপ দিচ্ছি আমরা।'
আর তখনি আমরা স্টেশনে পৌছনোর সঙ্গে সঙ্গেই স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনটি ছেড়ে দিল। ট্রেন স্টেশন ছেড়ে চলে যাবার পরেই মাইকে দূরন্তর প্ল্যাটফর্মে ঢোকার ঘোষণা দিল। 'ট্রেনটা কেন ছাড়তে দেরী করলো'-কথাটা ভাবতে ভাবতে আমরা আমাদের কামরার নির্দিষ্ট জায়গার দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে চললাম। যখন নির্দিষ্ট জায়গায় এসে দাঁড়ালাম দেখলাম ট্রেন প্ল্যাটফর্মে ঢুকছে। ট্রেন আসার পর আমরা ট্রেনে উঠে আমাদের নির্দিষ্ট সিটে বসলাম। তারপর ট্রেন ছেড়ে দিল; জসিডিকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যেতে থাকলো। দু'হাত তুলে দয়ালকে প্রণাম জানালাম। কিন্তু সারাক্ষণ ঘটে যাওয়া বিষয়টাকে ঘিরে একটা বিস্ময় আমাকে আচ্ছন্ন ক'রে রাখলো আর মনটা খচখচ করতে লাগলো সোনাই-এর বলা 'ঠাকুরের ওপর অনেক চাপ দিচ্ছি আমরা' কথাটায়। সারা রাস্তা ভুলতে চেষ্টা করলাম অনেক কিন্তু পারছিলাম না।
মনে পড়লো আবার দয়াল ঠাকুরের প্রিয় উপরের কোটেশানটাঃ
"There are more things in heaven and earth, Horatio, than are dreamt of in your philosophy." এর ভাবার্থ হ'লো, "স্বর্গ ও পৃথিবীর মাঝখানে আরও বহু জিনিস আছে, হোরেশিও, যা তোমার দর্শনের পাল্লার বাইরে ও অতীত।"
আর মনে পড়লো দয়ালের বলা কথা, "প্রতিমুহূর্তে কত ছোটো ছোটো দয়া তোমাদের যে রক্ষা করছে তা তোমরা জানো না।"
একটা অপরাধবোধ চোখকে ভিজিয়ে দিতে লাগলো বারেবারে। রুমাল দিয়ে চোখটাকে আড়াল করলাম আমি।-----প্রবি।
No comments:
Post a Comment