Powered By Blogger

Saturday, September 10, 2022

গল্পঃ ত্রিফলার ত্রিবর্ণ!!!!!!!! (৩)

ট্রেন থেকে নেমে ভিড় এড়িয়ে উত্তরপাড়া প্ল্যাটফর্মের একধারে দাঁড়িয়ে স্ত্রীর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। স্ত্রী ট্রেনের পিছনদিকে লেডিস কম্পার্ট্মেন্টে উঠেছিল। যাত্রীরা একে একে সবাই দ্রুত পা চালিয়ে চলে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে ভিড় কমে এলো। মেয়েটিও ফোনে মায়ের সাথে কথা বলতে বলতে দ্রুত পা চালিয়ে ক্রমশঃ দূর থেকে দূরে  ভিড়ের মাঝে মিশে গেল। সকালের অল্প বয়সী স্কুল ছেলেটির অসম্মানজনক আচরণের যে প্রলেপটা মাথার মধ্যে দম বন্ধ করা এক অস্বস্তির ছাপ ফেলেছিল সেই ছাপের ওপর যেন তীরের ওপর আছড়ে পড়া সমুদ্রের জলরাশির ছোঁয়ায় বালির বিচিত্র নানা আঁকিবুঁকি যেমন মুছে যায় ঠিক তেমনি মেয়েটির আন্তরিকতাপূর্ণ মধুর ব্যবহার প্রলেপ এঁকে দিয়ে যেন ব'লে গেল 'মেয়েই তো মা'!!!!!!! এক ঝলক দখিনা বাতাস যেন মনের মধ্যে আছড়ে পড়ে মনের গুমোট অবস্থাটা কাটিয়ে দিয়ে গেল। একটা আচ্ছন্ন অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলাম আমি, হঠাৎ স্ত্রীর ডাকে সম্বিত ফিরে পেলাম। স্ত্রীকে বললাম, বাসের মেয়েটা উত্তরপাড়া স্টেশনেই নেবেছে। সামনে দূরের দিকে হাত দেখিয়ে দেখালাম। মেয়েটি ওই ভিড়ের মাঝে হারিয়ে গেল। স্ত্রীও আফসোস করলো মেয়েটিকে মিস করার জন্য। 

যাই হ'ক আমরা ধীরে ধীরে হাঁটতে  লাগলাম স্টেশনের সামনের দিকে। হাঁটতে হাঁটতে এসে দাঁড়ালাম কাঁঠাল বাগান রিক্সা স্ট্যান্ডে। দেখলাম অনেক রিক্সা নেই, ভাড়ায় চলে গেছে। যে কটা আছে সেগুলিতে হয় লোক নেই,নয়তো একজন দুজ্ন বসে আছে সীটের ওপর পায়ের ওপর পা তুলে! যাত্রী এলো কি গেল তা'তে কোনো হেলদোল নেই, বসে আছে সিটের ওপর মাথা নিচু ক'রে। এদের মধ্যে একজন দাঁড়িয়ে আছে রিক্সা ধ'রে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, যাবে? সে না শোনার ভান ক'রে রইলো। আবার তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কিগো যাবে? কোনো উত্তর দিল না। কিছুক্ষণ কাটার পর রিক্সাওয়ালা নিজেই  মুখ  খুললো। বলল, কোথায় যাবেন? বলাটার মাঝে যেন একটা ঔদ্ধত্ব ঝ'ড়ে পড়লো। আমি বুঝতে পারলাম ভাড়া কাটার ইচ্ছে নেই। পছন্দের জায়গা হ'লে আর দূরত্ব অনুযায়ী ভাড়ার পরিমাণ মন মত হ'লে গেলেও যেতে পারে। আমি এই স্ট্যান্ড থেকে সবসময় যাতায়াত করি; যখনই যাই ভাড়া নিয়ে কখনোই ঝামেলা হয় না, যা ভাড়া তার থেকে অনেক বেশী পরিমানেই দিয়ে থাকি। এইখানে অনেক রিক্সা আছে যারা নিজেরাই এগিয়ে আসে যাবার জন্য। আজ একজন দু'জন ছাড়া রিক্সাস্ট্যান্ড ফাঁকা। আমি শান্ত ভাবে বললাম, তুমি কি যাবে? তোমার যাওয়ার ইচ্ছে আছে? যদি যাও তো এসো। নিজে তো বুঝি না তবুও কথাটায় মনে হ'ল যেন যাদু ছিল। আর কোনো কথা না ব'লে রিক্সা নিয়ে কাছে এলো। কাছে এসেই একটু ঝাঁঝালো স্বরে আবার কথাটা উগরে দিল, কোথায় যাবেন সেটা বলবেন তো। ঝাঁঝালো স্বরটাকে হজম ক'রে রিক্সায় উঠতে উঠতে বললাম, কোথায় আর যাবো ভাই; আর যেখানেই নিয়ে যাই তোমায়, রিষড়া, শ্রীরামপুর নিয়ে যাবো না। তারপরে বললাম, ড্রাগল্যান্ড ওষুধের দোকানের পাশ দিয়ে গিয়ে একটু এগিয়ে নামবো। গম্ভীরভাবে মুখের দিকে তাকিয়ে 'ভাড়া বেশী লাগবে' বলেই রিক্সা চালাতে লাগলো। রিক্সা এগিয়ে চলেছে, আমরা স্বামী স্ত্রী দু'জনে বসে আছি চুপ ক'রে; একটু এগিয়ে যেতেই স্ত্রী  নাকে হাত দিয়ে ইশারা ক'রে যা বলল তার মানে হচ্ছে, রিক্সাচালক ড্রিঙ্ক ক'রে আছে আর বাতাসে তার গন্ধ নাকে এসে লাগছে। আমি প্রথমে ব্যাপারটা লক্ষ্য না করলেও পরে দেখলাম কথাটা ঠিকই। রিক্সার বেগ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাওয়ার বেগও বেড়ে গেল আর গন্ধটা এসে লাগছে চোখেমুখে তীব্রভাবে। স্ত্রীর মুখচোখ দেখে বুঝলাম ভীষণ বিরক্ত বোধ করছে। চাপা স্বরে বলল, না দেখে যার তার রিক্সায় উঠে পড়, এখন দুর্গন্ধ ভোগ কর'। যাই হ'ক রিক্সা এসে থামলো বাড়ির সামনে। রিক্সাচালককে বললাম, কত দেব ভাই? ৩০টাকা দিন। গম্ভীর একটা স্বর ভেসে এলো রিক্সাচালকের গলা দিয়ে। রিক্সাচালকের অকারণ রুক্ষ ব্যবহার মনটাকে অস্থির ক'রে তুলছে ক্রমশঃ। আমি বললাম, ভাই ৩০টাকা কি ভাড়া? ভাড়া তো ২০টাকা। আমার দিকে চোখ পাকিয়ে বলল, মোরের মাথা পর্যন্ত ২০টাকা,  ভিতরে এলে আরও ১০টাকা বেশী দিতে হবে। আমি বললাম, ভাই আমি কি নতুন লোক যে তুমি আমাকে কত ভাড়া সেটা শেখাচ্ছো? এখানে ভাড়া ২০টাকা আর তুমি চাইছো ৩০টাকা, তাও ভালো মুখে নয়; পরিস্কার তুমি দাবড়ে বেশী টাকা নিতে চাইছো, এটা ঠিক নয়। রিক্সাচালক চোখ পাকিয়ে বিকৃত মুখ ভঙ্গী ক’রে বলল, ঠিক বেঠিক বুঝি না, ৩০টাকা ভাড়া দিয়ে দিন চলে যাই। কথাটা বেশ জোরের সঙ্গে ব’লে কি যেন বিড়বিড় ক’রল। স্ত্রী বলল, ৩০টাকা দিয়ে দাও। এদের সঙ্গে কথা বললে মান সম্মান আর থাকবে না, কেননা দেখে বোঝাই যাচ্ছে স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। আমি আর কথা না বাড়িয়ে ৩০টাকা দিয়ে দিলাম। টাকাটা হাতে নিয়ে সে চোখ পাকিয়ে কর্কশ গলায় বলল, যা ভাড়া তাই নিয়েছি, আপনি বেশী দিয়েছেন নাকি? তার লাল চোখ পাকানো বাঁকানো মুখের দিকে তাকিয়ে অনেকক্ষণ ধ’রে সহ্য করা ভিতরের চাপা রাগটা বেরিয়ে আসতে চাইলো। মনে হ'ল ভিতর থেকে যেন বাঁধ ভাঙ্গা জলের স্রোতের মত একটা রাগের স্রোত ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে আছড়ে পড়তে চাইছে দুর্বিনীত উদ্ধত রিক্সাচালকের ওপর। রাগে সর্বাঙ্গ কাঁপতে লাগলো।  নিজেকে সংযত ক'রে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করলাম। জোর ক'রে ১০টাকা তো বেশী নিলই তার উপরে এমন বর্বর আচরণে নিজেকে অসহায় মনে হ'ল। নিজের প্রতি যখন বিশ্বাস হারিয়ে ফেলতে চলেছি ঠিক তখনই মনে পড়ল ঠাকুরের বাণীটাঃ

"তোমার কোন কু-অভ্যাস
কিংবা কাম, ক্রোধ ইত্যাদী --------
যাহা তোমাকে দুর্ব্বল ও খিন্ন করিতে চায়
তাহা যদি ত্যাগ করিতেই চাও ----
যখনই তাহার সম্বেগ যে-মহূর্ত্তে
কার্য্যে রত করাইতে যাইতেছে
সেই মুহূর্ত্তেই
তাহা হইতে বিরত হইও ,
কিংবা সেই মুহূর্ত্তে বিরত হইয়াই
ঐ সম্বেগকে
এমন কোন চিন্তা ও কর্ম্মে
নিয়োজিত করিও
যাহা তোমার পক্ষে মঙ্গলপ্রদ -----
আর , ইহা ততদিন পর্য্যন্ত চালাইও
যতদিন ইহা তোমার সম্যক
আয়ত্তের ভিতর না আসে ;----
দেখিও কিছুদিন অভ্যাস করিলেই
অভ্যাস বা রিপুদিগকে
এমনতর আয়ত্ত করিতে পারিবে যে
তাহারা ক্রীতদাসের মত
নতজানু হইয়া
তোমার উপাসনায় মুগ্ধ থাকিবে ; ------
ইহা না করিয়া শুধু ত্যাগের চিন্তায়
ত্যাগ তো করিতে পারিবেই না
বরং আরো আবিষ্ট হইয়া পড়িবে।"

মনটা খানিকটা শান্ত হ'ল। মনকে অন্যত্র সরিয়ে নেবার চেষ্টা করলাম। মনে মনে ভাবতে লাগলাম আগামী ৩০শে ভাদ্র (১৫ই সেপ্টেম্বর'১৬) ভদ্রকালী সৎসঙ্গ কেন্দ্রে ঠাকুরের জন্মদিবসের অনুষ্ঠানের কথাটা। আর কিছু না ব'লে রিক্সা থেকে নাবতে যাবার মুহুর্তে তার শরীরের আর মুখের ভাষা লাগামছাড়া হ'তে চাইলো। মনে হ'ল যেন বিশ্ব জয়  ক'রে ফেলেছে। আলেকজান্ডারিয় মেজাজে টাকাটা গুনতে গুনতে বলল, যা ভাড়া তাই নিয়েছি এতে এত কথার কি আছে? তাড়াতাড়ি নাবুন। নাবার মুখে তার মুখের মদের তীব্র দুর্গন্ধে মেজাজটা নড়ে গেল। মেজাজটা ধ'রে রাখার চেষ্টা ক'রেও আর ধ'রে রাখতে পারলাম না। রিক্সা থেকে নেবে তার বাঁ হাতের কব্জিটা চেপে ধরলাম। হাতে ধরা ৩০টা টাকা।  টাকাটা সে কিছুতেই দেবে না। মনে হ'ল একটা বিরাশী সিক্কার থাপ্পর মারি। মারবার জন্য হাত তুললাম কিন্তু ভেতর থেকে সায় পেলাম না। মন বলল এক কিন্তু বিবেক সাড়া দিল না। রাগে সর্বাঙ্গ কাঁপছে কিন্তু কেমন জানি নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে না। সে হাত ছাড়াতে চাইলো কিন্তু আমার হাতের মুঠিটা যেন তার কব্জির ওপর বজ্র আঁটুনির মত চেপে বসেছে কিন্তু মাথার মধ্যে কে যেন বলছে, সাবধান! কব্জি যেন ভেঙ্গে বা মুচড়ে না যায়। অনেক কথা বললাম বেআদবকে আদব শেখাবার জন্য। ততক্ষণে তার মদের নেশা ভয়ে অনেকটা কেটে গেছে। সে তখন কাঁচুমাচু হ'য়ে ক্ষমা চেয়ে নিয় বলল, আপনি টাকা নিয়ে নিন, আমার লাগবে না। আমাকে যেতে দিন। আমার ভুল হ'য়ে গেছে। আমি বললাম, আমি তোর টাকা নেব কেন? তুই যদি আমার কাছ হাসি মুখে ৫০টাকা চাইতি আমি তোকে ৫০টাকা দিতাম। তো স্ট্যান্ডে গিয়ে জিজ্ঞেস করবি আমি কত ভাড়া দিই। তুই নতুন? মদ খেয়ে রিক্সা চালাচ্ছিস? যাত্রীদের কুকুর ছাগল মনে করিস? মদ খেয়ে চোখ পাকিয়ে ভয় দেখিয়ে ডবল ভাড়া নিস? যা আজ তোকে ছেড়ে দিলাম।  আমার এখনও মুখ কথা বলছে; হাত কথা বলার আগে এখান থেকে এই মুহুর্তে চলে যাবি।  এই কথা ব'লে ওর হাতটা ছেড়ে দিলাম। ও হাত ছাড়া পেয়ে রিক্সা নিয়ে চলে যেতে চাইলো। আমি বললাম, না না! ওটা হচ্ছে না। তোকে ছেড়ে দিয়েছি এমনি চলে যাবার জন্য, রিক্সা নিয়ে যাবার জন্য নয়। রিক্সা পাবি না। যে গাড়ি দিয়ে তুই রোজগার করিস সেই গাড়ি ছাড়া তুই রোজগার কর দেখি। কথাটা বলেই তাকে ধাক্কা দিয়ে চলে যেতে বললাম। সে তখন মুখে ম্লান হাসি ফুটিয়ে বলল, আমি তো বললাম আমার ভুল হ'য়ে গেছে। আপনার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলাম। ক্ষমা চাওয়ার পরেও আপনি মাপ করবেন না? রিক্সা ছাড়া আমি খাবো কি? আমি তখন তাকে বললাম, এই কথাটাই ভুলে গেছিলি আর যাত্রীকে মনে করেছিলি কুকুর ছাগল। কোনোদিন মিষ্টি ক'রে হাসি মুখে কারো কাছে সত্যি ভাড়ার কথা ব'লে বেশী ভাড়া চেয়ে দেখেছিস? সবাইকে একই রকম মনে করিস? এখন বিপদে পড়ে ভোল পাল্টাচ্ছিস। এই ভোলটাই বরাবরের জন্য ব্যবহারের মধ্যে ফুটিয়ে তোল। দেখবি লাভ বৈ ক্ষতি হবে না। বিশ্বাস না হয় রিক্সাস্ট্যান্ডে গিয়ে আমার পরিচিত অন্য রিক্সাচালকদের গিয়ে জিজ্ঞেস ক'রে দেখতে পারিস। একবার পরীক্ষা করেই দ্যাখ না।

রিক্সাচালক চুপ ক'রে আমার কথা গুলি শুনলো। আমি বললাম, যা রিক্সা নিয়ে চলে যা। সে মাথা নিচু ক'রে ধীরে ধীরে রিক্সা নিয়ে এগিয়ে গেল। দেখলাম একটু আগে যাকে নেশাগ্রস্থ, দুর্বিনীত ব'লে মনে হচ্ছিল এখন তাকে কত ধীরস্থির শান্ত লাগছে। পেছন থেকে ডেকে দাঁড় করালাম। বললাম, একটা কথা বলি, যদি পারো মনে রেখো। আর মদ খেয়ো না। মদ বড় বদ, মদে সব নষ্ট। আর সব নষ্ট হ'লেই জীবনে, সংসারে নেবে আসে সীমাহীন কষ্ট, যার শেষ মৃত্যুতে, শ্মশানে। 

কথাগুলি দাঁড়িয়ে মন দিয়ে শুনলো তারপর ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। আমি ওর চলে যাবার পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম। রিক্সাটা রাস্তার বাঁক ঘুরে দৃষ্টির বাইরে চলে গেল। আমি ক্লান্ত বিধ্বস্ত আর মোহগ্রস্থ হ;য়ে ফিরে চললাম বাড়ির দিকে আর মনে মনে ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা জানালাম, ঠাকুর ওর মঙ্গল ক'র।

(লেখা ১০ই সেপ্টেম্বর'২০১৬)

No comments:

Post a Comment