দেওঘর ঠাকুরবাড়িতে দোল উৎসবের আনন্দে মেতে উঠেছিল সকল ইস্টপ্রাণ দাদারা ও মায়েরা। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা বাবা মায়েদের সাথে নির্মল আনন্দে মেতে উঠেছিল। চারিদিকে হাজার হাজার নারীপুরুষ দোল উৎসবে এসে যোগ দিয়েছিল। এমনিতেই প্রতিদিনই হাজার হাজার সৎসঙ্গীদের আগমনে গমগম করতে থাকে সৎসঙ্গ নগর। তার উপর ১৩ তারিখ বৃহস্পতিবার থেকে গিজগিজ করতে থাকে আশ্রম প্রাঙ্গণ। লোকে লোকারণ্য ছিল রাস্তাঘাট, আশ্রমের চারপাশ। ঠাকুরবাড়ি থেকে ঘর বুকিং বন্ধ ক'রে দেওয়া হয়েছিল। আশেপাশে যত হোটেল ও প্রাইভেট ভাড়া বাড়ি ঘর ছিল সব হ'য়ে গিয়েছিল পরিপূর্ণ।
মনে প্রশ্ন জাগে, এই যে এত হাজার হাজার মানুষ ছুটে আসে প্রতিদিন, লক্ষ লক্ষ মানুষ ছুটে আসে ঠাকুরবাড়ির নানা উৎসবের সময় তারা কারা? কারা আসে ছুটে ছুটে ভারত তথা বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে? কেন আসে? কিসের জন্য আসে? কার টানে আসে? এই প্রশ্নগুলি স্বাভাবিকভাবেই আমার মাথায় আসে। মাথায় আসে ভারত তথা বিশ্বের অন্য সব জায়গায় অবস্থিত শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের নামে যে সব কেন্দ্র মন্দির 'সৎসঙ্গ' বিরোধীদের দ্বারা গড়ে উঠেছে সেইসব কেন্দ্র মন্দিরের সঙ্গে শ্রীশ্রীঠাকুর প্রতিষ্ঠিত এক ও একমাত্র কেন্দ্র, দেওঘর মূল কেন্দ্র 'সৎসঙ্গ'-এর তফাৎ দেখে? এই তফাৎ কিসের? আসুন একটু আলোচনা করা।
প্রথমে আলোচনা করা যাক দেওঘরে প্রতিদিন ও উৎসবের দিনগুলিতে হাজার হাজার ও লক্ষ লক্ষ মানুষ যে ছুটে আসে তারা কারা?
এককথায় বলতে পারি পর্যটক। পর্যটক কথাটা আংশিক ঠিক, পুরোপুরি নয়। যারা আসেন তাদের মধ্যে ইষ্টপ্রাণ ভক্তমন্ডলীও আছেন। পর্যটক যারা তারা আসে বিনোদন বা ভ্রমণের উদ্দেশ্যে। দীক্ষিত ও অদীক্ষিত যারা আসে তারা ঠাকুরবাড়ি ভ্রমণ ও দর্শনের সঙ্গে সঙ্গে আশেপাশের আরও অনেক কিছু যেমন ত্রিকূট পাহাড়, বৈদ্যনাথ ধাম ইত্যাদি ভ্রমণ ও দর্শনেও আসেন। অনেক দীক্ষিত আসেন শুধু ঠাকুরবাড়ির উদ্দেশ্যে। আর, আসেন আর্ত, অর্থার্থী, জ্ঞানী ও জিজ্ঞাসু।
এখন এই যে ঠাকুরবাড়ির উদ্দেশ্যে যারা আসেন তারা আসেন ঠাকুর ও ঠাকুরবাড়ির অন্যান্যদের প্রণামের উদ্দেশ্যে।
এই যে আর্ত, অর্থার্থী, জ্ঞানী, জিজ্ঞাসু মানুষের কথা বললাম এরা আসতেন পরমপুরুষ পুরুষোত্তম পরমপ্রেমময় শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের কাছে, যখন তিনি দেহ্রূপে ছিলেন। যুগে যুগে যতবার ঈশ্বর মাটির বুকে মানুষের রূপ ধ'রে মানুষের মাঝে মানুষ মায়ের গর্ভে নেমে এসেছেন রাম, কৃষ্ণ, বুদ্ধ, যীশু, মহম্মদ, মহাপ্রভু, রামকৃষ্ণ রূপে ততবারই আর্ত, অর্থার্থী, জ্ঞানী, জিজ্ঞাসু ব্যক্তিরা ছুটে ছুটে এসেছিলেন তাঁদের কাছে। কিন্তু এখন তো শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র দেহরূপে নেই তাহ'লে এখনও সেই ট্রাডিশান কি ক'রে ব'য়ে চলেছে দেওঘরের বুকে? এখনও হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ উৎসবের দিনগুলিতে ছুটে ছুটে আসেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে, কেন? কিসের টানে? কার কাছে? কারা আসেন? এখন তো ঠাকুর নেই? তাহ'লে কি পর্যটক হিসেবে আসেন দর্শনার্থীরা?
শ্রীশ্রীঠাকুর দেহ রেখেছেন ১৯৬৯ সালে, আর, এখন ২০২৪ সাল। এই দীর্ঘ ৫৫বছরে পর্যটক, দর্শনার্থী, ভক্তের সংখ্যা বেড়েছে শ্রীশ্রীঠাকুর দেহরূপে থাকাকালীন আগত পর্যটক, দর্শনার্থী, ভক্তের সংখ্যার কয়েকগুণ বেশী।
আর, এখন যে আর্ত, অর্থার্থী, জ্ঞানী, জিজ্ঞাসু ব্যক্তিরা ছুটে ছুটে আসেন, তারা কার কাছে আসেন? এখন তো শ্রীশ্রীঠাকুর দেহরূপে নেই। কেন আসেন? কেন আর্ত, অর্থার্থী, জ্ঞানী, জিজ্ঞাসু ব্যক্তিদের সংখ্যা বেড়ে গেল? মূল কেন্দ্র সৎসঙ্গ দ্বারা পরিচালিত ভারত সহ বিশ্বের অন্যান্য সমস্ত কেন্দ্র মন্দিরগুলিতে এবং মূল কেন্দ্র বিরোধী শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র নামাঙ্কিত মন্দিরগুলিতে শ্রীশ্রীঠাকুরের জন্মমহোৎসব পালনের দিনগুলি ছাড়া বছরের অন্যান্য সময়গুলিতে কেন্দ্র মন্দিরগুলি ফাঁকা পড়ে থাকে। কেন? কেন সেখানে বছরের ৩৬৪ বা ৩৬৩ দিন সকাল বিকাল প্রার্থনাতেই ভক্ত সমাগম হয় না? অথচ দেওঘরে উৎসব ব্যতিত বছরের অন্যান্য দিনগুলিতেও প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের ঢল লেগেই আছে। কেন?
দেওঘর সৎসঙ্গ আশ্রমে বছরে বড় দুটি উৎসব পালিত হয়। বাংলা নববর্ষে (এপ্রিল) ‘পুরুষোত্তম স্বস্তিতীর্থ-মহাযজ্ঞ’ এবং শারদীয়া দুর্গোৎসবের পর ‘শ্রীশ্রীঠাকুরের শুভ জন্ম-মহামহোৎসব’। কখনও কখনও নববর্ষ উৎসব আশ্রমের বাইরে দেশের বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত হয়। আশ্রমে শ্রীশ্রীঠাকুর, শ্রীশ্রীবড়মা, শ্রীশ্রীবড়দা ও শ্রীশ্রীদাদার জন্মতিথি ও আবির্ভাব দিবসগুলি সাড়ম্বরে উদযাপিত হয়। এছাড়াও উদযাপিত হয় শ্রীশ্রীঠাকুরের-পুণ্যস্নানোৎসব, পাবনা থেকে দেওঘর আগমন স্মরণোৎসব, মানিকপুরে বনভোজন উৎসব, দোল উৎসব। এছাড়া বর্তমান আচার্যদেব শ্রীশ্রীবাবাইদাদার জন্মদিবস এবং সৎসঙ্গ জগতের লক্ষ লক্ষ যুবকযুবতীর, ইয়ং জেনারেশরেন হার্টথ্রব শ্রীশ্রীঅবিনদাদার জন্মদিন পালন হয়। এই উৎসব পালনের দিনগুলিতে অগণিত লক্ষ লক্ষ লোকের সমাগম হয়।
কিন্তু মনে প্রশ্ন জাগে, এই বিশেষ দিনগুলিতে না হয় দেশ বিদেশের লক্ষ লক্ষ দীক্ষিত-অদীক্ষিত মানুষ, পর্যটক, ইষ্টপ্রাণ ভক্তমন্ডলী, আর্ত, অর্থার্থী, জ্ঞানী, জিজ্ঞাসু ছুটে আসে উৎসবকে কেন্দ্র ক'রে আনন্দ উপভোগ করতে, কৌতুহল মেটাতে এবং সমস্যা সমাধানের পথ পেতে। কিন্তু এই বিশেষ দিনগুলি ছাড়া বছরের অন্যান্য সাধারণ দিনগুলিতে প্রতিদিন এত হাজার হাজার আর্ত, অর্থার্থী, জ্ঞানী, জিজ্ঞাসু মানুষের কেন দেওঘরে সমাগম হয় যা' অন্য কোনও সৎসঙ্গ মন্দিরে বা সৎসঙ্গ বিরোধীদের দ্বারা নির্মিত কেন্দ্র মন্দিরগুলিতে হয় না? কে আছেন দেওঘরে যাঁর কাছে আর্ত, অর্থার্থী, জ্ঞানী, জিজ্ঞাসু মানুষেরা ছুটে আসেন তাঁদের সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়ার জন্য? শ্রীশ্রীঠাকুর তো নেই দেহরূপে সেখানে! তাহ'লে কে দেবেন সমাধান? কে দেখাবেন পথ? আর্ত, অর্থার্থীদের কথা না হয় ছেড়ে দিলাম তারা যেখানে সেখানে ছুটে যান বাঁচার টানে খড় কুটোকে আঁকড়ে ধ'রে ডুবন্ত মানুষের বাঁচার মত। নদীর জলে ডুবন্ত মানুষ বাঁচার টানে সামনে দিয়ে ভেসে যাওয়া খড় কুটোকে যেমন বৃথা আঁকড়ে ধরে ঠিক তেমনি ধর্মজগতের বিভিন্ন কপট, ভন্ড, অসৎ, প্রতারক, ছদ্মবেশী গোঁসাই, গোবিন্দ, যোগী, ধ্যানী, সাধু, সন্ত, বাবাজী, মাতাজীর খপ্পরে পড়ে ধর্ম ও ঈশ্বর বিশ্বাসী সাধারণ সহজ, সরল, বোকা, মূর্খ, ভীরু, দূর্বল, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, অজ্ঞ, বেকুব এবং তথাকথিত লেখাপড়াজানাওয়ালা সীমাহীন ভাঙাচোরা মানুষ। ঠিক তেমনি দেওঘরেও না-হয় ছুটে আসেন এইসমস্ত আর্ত ও অর্থার্থীদের দল। এইকথা বলতে পারেন অপপ্রচারকারী, তর্কবাগীশ এবং যুক্তি বিজ্ঞানবাদীদের দল। তাদের এই কথা মেনে নিলা্ম।
কিন্তু শ্রীশ্রীঠাকুর দেহরূপে না থাকা সত্ত্বেও দীক্ষিত-অদীক্ষিত জ্ঞানী ও জিজ্ঞাসুরা প্রতিদিন কেন এখনও ছুটে ছুটে আসেন দেশ বিদেশ থেকে দেওঘরে? কেন আসেন? কার কাছে আসেন তাঁরা? কেন আজও শিক্ষিতরা দেওঘরে এসে আরও পরিশীলিত হন ও হওয়ার আশায় ছুটে আসেন?
এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন নিয়ে পরবর্তী পর্বে আলোচনা করবো। আমার পাঠক ও সৎসঙ্গী গুরুভাইবোনের কাছে আমার একান্ত অনুরোধ ও প্রত্যাশা আপনার আমার সঙ্গে থাকবেন এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে। আজকের মত বিদায়।
( লেখা ২০শে মার্চ' ২০২৫)
No comments:
Post a Comment