Powered By Blogger

Saturday, August 23, 2014

হিন্দুস্তান মোটর্সঃ একটি স্বপ্নের মৃত্যু-



ভারতের প্রথম একমাত্র স্বয়ংসম্পুর্ণ মোটরগাড়ীর কারখানা হিন্দুস্তান মোটর্স বন্ধ বন্ধ শ্রমিক পরিবারে প্রাণের কলতান! নীরবে নিভৃতে ঘরে ঘরে বয়ে যায় শ্রমিকের চোখের জল আর বাইরে রাজ্য জুড়ে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ক্রীড়ানুষ্টান ইত্যাদি আরও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দাপাদাপি! কে কার খবর রাখে! আমার গায়ে আঁচ না লাগে ফুরিয়ে যাবে মামলা

হিন্দুস্তান মোটরস বন্ধ হওয়ার অনেক আগে থেকেই এই কারখানার শ্রমিকের জীবনে নেবে এসেছিল অন্ধকার আর শ্রমিকের জীবনের এই অন্ধকারকে মূলধন করে ময়দানে নেবে পড়েছিল পুরোন নতুন সমস্ত শ্রমিক সংগঠন তাদের ছোট বড় নতুন পুরাতন সমস্ত বিপ্লবী নেতারা শ্রমিকদের মসীহা য়ে! ইউনিয়ন নেতাদের কারখানা জুড়ে কত আন্দোলন, কত প্রতিবাদ, কত মিছিল, কত মিটিং, কত অনশন, কত সরকারি স্তরে ত্রিপাক্ষিক আলোচনা ইত্যাদির রগরগে নাটক মাসের পর মাস, বছরের পর বছর দেখে দেখে ক্লান্ত বিধ্বস্ত শ্রমিকের জীবনে নেবে এসেছিল ঘোর অন্ধকার কারখানার মালিক সি কে বিড়লা কারখানার দায়িত্ব নেবার পর সালটা ছিল ১৯৮০

প্রথম অন্ধকারের মেঘ ঘনিয়ে এল কারখানার বুকে কারখানার প্রেসিডেন্ট এস এল ভাট্টারের অপসারণের মধ্যে দিয়ে যার হাত দিয়ে বিশাল এই অটোমোবাইল কারখানার উত্তরণ, প্রসার; যার হাত রে আজকের মালিক সেদিনের বালক সি কে বিড়লার কারখানা পরিদর্শন, যার হাত রে অ্যাম্বাসাডারের প্রতিনিয়ত পরিবর্তন পরিবর্ধন এবং ভারতের গাড়ীর বাজারে পরিবহনের উপযোগী ট্রেকার, আধুনিক কন্টেসার আবির্ভাব, যার উপস্থিতিতে শ্রমিক-কর্মচারী নিয়োগ, শ্রমিক-মালিকের দাবী আদায়ের লড়াই আন্দোলনের সমাধান সেই কৃতি পুরুষ মোটরশিল্পে প্রবীন অভিজ্ঞ এস এল ভাট্টারকে অবশেষে নিজের হাতে তৈরী সাজানো বাগানের মালীর অবস্থান থেকে সরে দাঁড়াতে হয়েছিল সেদিনের এতবড় টাইটানিক জাহাজের মত বিশাল ঐতিহ্যপূর্ণ শিল্পে কোন অবদান না থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র মালিক হওয়ার অধিকারে অধিকারী বালক থেকে যুবকে উত্তরণ তাজা টগবগে বছর চব্বিশের সি কে বিড়লার অপছন্দের কারণে মালিকের দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র এক যুগের ব্যবধানে! তারপর শুরু কালের নিয়মে শিল্প ধ্বংসের পান্ডুলিপি লিখন!

প্রেসিডেন্ট এস এল ভাট্টারের অপসারণের পর সেইপ্রদীপ নিভে যাবার আগে দপ রে জ্বলে ওঠেপ্রবাদের মত কারখানার উৎপাদন সাময়িক বৃদ্ধি পেয়েছিল আর সেই অদ্ভুতভাবে হঠাৎ সমস্ত গাড়ীর উৎপাদন বৃদ্ধি পাবার পিছনে ছিল অদ্ভুত এক রহস্যজনক খেলা!

১৯৮০ সালে মোট শ্রমিক-কর্মচারীর সংখ্যা ছিল প্রায় ১৭০০০ হাজার তখন প্রেসিডেন্ট এস এল ভাট্টারের নেতৃত্বে মাসে ২৫০০ অ্যামবাসাডার, ১৫০টি কন্টেসা, ২৫টি পোর্টার উৎপাদন মাসে স্পেয়ার পার্টসএর উৎপাদনও প্রায় দুকোটি টাকার মত ১৯৮০-৮১ নিট সালে লাভ হয় ১১২ কোটি টাকা এই উত্তরপাড়া প্ল্যান্ট থেকে এরকম লাভের ঊর্ধ্বগতি চলতে থাকে গোটা দশক জুড়ে

পরবর্তী ১৯৯২-৯৩ সালে অ্যাম্বাসাডারের উৎপাদন কমে যায় বছরে অ্যাম্বাসাডার উৎপাদন হয় প্রায় ২০,০০০ হাজার, কন্টেসা উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৩০০০, অন্যান্য সব মিলিয়ে মোট উৎপাদন হয় প্রায় ২৪০০০ হাজার কিন্তু পরবর্তী সময়ে ১৯৯৪ সালে মালিক সি কে বিড়লা প্রকাশ্য সভায় ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দের সামনে শ্রমিকদের কাছে উৎপাদন বৃদ্ধির আবেদন জানায় সেই আবেদনে শ্রমিক-কর্মচারী আনন্দের সঙ্গে সাড়া দেয় ১৯৯৫-৯৬ সালে উৎপাদন এক লাফে বেড়ে দাঁড়ায় বছরে অ্যাম্বাসাডার ২৪০০০ হাজার, কন্টেসা প্রায় ৪০০০ হাজার, ট্রাক প্রায় ৫০০টি সব মিলিয়ে বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৩২০০০ হাজার গাড়ি
কিন্তু গাড়ীর উৎপাদন বেড়ে পেলেও কারখানার কর্মী সংখ্যা অদ্ভুতভাবে হ্রাস পেতে থাকে কিন্তু এই কর্মী সঙ্কোচন শ্রমিকদের মধ্যে কোন প্রভাব ফেলে না তখন শ্রমিকরা মত্ত থাকে তাদের মাইনে বৃদ্ধির আন্দোলনে এবং মাইনে বৃদ্ধি হয় বদলী স্থায়ীকরণ চালু থাকে শ্রমিক-কর্মচারী আনন্দিত হয়! আর সান্তারামের নেতৃত্বে না-কি দখিনা বাতাস বইতে শুরু করেছে হিন্দমোটরের আকাশে
আর পাশাপাশি প্রচার চলতে থাকে গাড়ি বিক্রির প্রতিযোগীতার বাজারে হিন্দমোটর দ্রুতগতিতে পিছিয়ে যাচ্ছে অ্যাম্বাসাডারের মডেল মানুষের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে, মারুতির আধুনিক মডেলের ছোটো গাড়ীর যুগে অ্যাম্বাসাডারের মত পুরোনো বেঢপ মডেল কন্টেসার মত বড় গাড়ীর কোন চাহিদাই না-কি নেই! নেই অদ্ভুত দর্শন ট্রেকারের কোন ভবিষ্যত, টাটা ট্রাক-এর সামনে বেড ফোর্ড-এর তেমন না-কি বাজার নেই, বাংলাদেশের মত ছোট দেশও হিন্দমোটরের তৈরী উন্নত মানের ট্রাকম্যাসকট’-এর অর্ডার- না-কি বাতিল রে দেয় ফলে ম্যাসকটের উৎপাদনও অপ্রাসঙ্গিক য়ে পড়ে কালবৈশাখীর ঝড়ের মতো এই প্রচার ছড়িয়ে পড়ে কারখানার আকাশে বাতাসে!

অতএব কোম্পানীকে বাজারে টিকে থাকতে লে নতুন কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে আর তা একমাত্র করতে পারেন কোম্পানীর পরিত্রাতা আধুনিক ম্যানেজমেন্টের রুপকার অরণ্যদেব আর সান্তারাম!

তাই কোম্পানীকে প্রতিযোগীতার বাজারে টিকিয়ে রাখার জন্য আর সান্তারামের ম্যানেজমেন্ট ম্যাকিন্সে কনসালটেন্সিকে নিয়োগ করে ম্যাকিন্সে এসে যেটা করলেন বা যে বুদ্ধি দিলেন মালিক সি কে বিড়লাকে তা ভারতবর্ষের প্রথম স্বয়ংসম্পুর্ণ মোটর গাড়ীর কারখানা হিন্দুস্তান মোটরসকে সিঙ্গুরে প্রস্তাবিত টাটার ন্যানো কারখানার মত শুধুমাত্র অ্যাসেম্বলি প্ল্যান্টে পরিণত করতে হবে! পরিবর্তে যেটা হবে তাহ গাড়ি তৈরীর যন্ত্রাংশ উৎপাদনের বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট যেমন বিশাল ফাউন্ড্রি, ফোর্জ প্ল্যান্ট, ইঞ্জিন প্ল্যান্ট, মেশিন শপ, প্রেস শপ, প্লেটিং শপ সহ বড়ো ছোট অনেক ডিপার্টমেন্টকে বন্ধ রে দিতে হবে! বি এম বিড়লার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এবং কারখানার প্রেসিডেন্ট এস এল ভাট্টারের প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষনে বেড়ে ওঠা এশিয়ার একসময়ের বৃহৎ ভারতবর্ষের একমাত্র স্বয়ংসম্পুর্ণ মোটর কারখানা তার গাড়ীর যন্ত্রাংশ তৈরীর আভিজাত্য, গৌরব, ঐতিহ্য, ইজ্জৎ, অহংকার মর্যাদাকে একনিমেষে পথের ধুলায় লুটিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে যন্ত্রাংশ আমদানি রে অ্যাসেম্বলি করতে হবে ফলে অকেজো য়ে যাওয়া ডিপার্টমেন্টগুলির হাজার হাজার শ্রমিক-কর্মচারীকে হারাতে হবে তাদের কাজ ম্যাকিন্সের মুল্যবান তত্ত্ব অনুযায়ী মোটরগাড়ি তৈরীর শিল্পে পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষের গর্ব বিশাল হিন্দমোটর কারখানা পরিণত হবে ছোট শিল্পে!

বিশাল হিন্দমোটর কারখানার রুপকার কোম্পানীর প্রেসিডেন্ট এস এল ভাট্টারের বিদায়ের পর সাজানো বাগানে ফুল তোলার মানসিকতা নিয়ে আসা কারখানা সংকোচনের নতুন সর্বাধিনায়ক শঙ্করনারায়নন আর সান্তারামের যৌথ নেতৃত্বে শুরু ম্যাকিন্সে কনসালটেন্সির দেওয়া পরামর্শকে বাস্তবায়িত করার মহাযজ্ঞ! উত্তরাধিকার সূত্রে ফোকটে পাওয়া মালিকানার অহঙ্কারে মত্ত সি কে বিড়লা আর সাজানো বাগানের ফুল তোলার মানসিকতাসম্পন্ন উচ্চ পদাধিকারীর মেলবন্ধনে কারখানার আকাশে দেখা দিল ভয়ঙ্কর অশনিপাতের সংকেত! আধুনিক ম্যানেজমেন্টের রুপকার এই দুই মহারথীর এক মহারথী আর সান্তারাম হিন্দমোটর কারখানায় শ্রমিকদের মাঝে অরণ্যদেব হিসাবে আত্মপ্রকাশ করলেন শুরু তাঁর বিশাল হিন্দমোটর বাগানের যত্রতত্র বিচরণ আর নির্দয়ভাবে নির্দ্বিধায় গাছের ফুল উৎপাটন!

ম্যাকিন্সে কনসালটেন্সির দেওয়া পরামর্শ অনুযায়ী নতুন দুই মহারথীর নেতৃত্বে শুরু নতুন ব্যবস্থায় কারখানা পরিচালন! হিন্দমোটরের শ্রমিক-কর্মচারী দেখলো অতি আধুনিক পরিচালন ব্যবস্থা কাকে বলে! দেখলো উচ্চশিক্ষিত দুই আধুনিক ম্যানেজমেন্টের প্রতিনিধির দ্বারা প্রবর্তিত আধুনিক ম্যানেজমেন্টের রুপ! ম্যাকিন্সের তত্ত্ব অনুযায়ী গাড়ী তৈরীর প্রতিযোগীতার বাজারে টিকে থাকার জন্য নতুন ব্যবস্থায় যদি গাড়ীর যন্ত্রাংশ আমদানি করা হয় তাহলে যন্ত্রাংশ তৈরীর বিপুল পরিমাণ ব্যয় কমবে! কমবে অপচয়, আসবে ১০০ভাগ নিখুঁত যন্ত্রাংশ! কমবে অকারণ বিদ্যুৎ, জল ইত্যাদি ইত্যাদি খরচ! বিপুল পরিমানে কমে যাবে অপ্রয়োজনীয় শ্রমিক-কর্মচারীর দায়-দায়িত্বের বোঝা! বেঁচে যাবে হিন্দমোটর কারখানা! মোটা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কারখানাকে গম্ভীর পর্যবেক্ষণ, বিচার বিশ্লেষন বিবেচনা রে কারখানাকে বাঁচাবার ঠিকুজী কুষ্ঠি তৈরী রে এবং মন্ত্র জানিয়ে দিয়ে ফিরে গেল ম্যাকিন্সে! আর কারখানাকে বাঁচাবার সেই ঠিকুজী কুষ্ঠি নিয়ে বীর বিক্রমে মন্ত্র জপতে জপতে কারখানাকে বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন কারখানার অভ্যন্তরে কারখানার বুকে নতুন নাম পাওয়া অরণ্যদেব রুপী আর সান্তারাম! অরণ্যদেবের আগমনে শ্রমিক-কর্মচারী নতুন রে স্বপ্ন দেখতে লাগলেন বাঁচার! কিন্তু সেদিনের শ্রমিক-কর্মচারী বুঝতে পারেনি ম্যাকিন্সের তত্ত্ব দুই মহাতারকার আগমন তাদের বেঁচে থাকা বেড়ে ওঠার আশাকে সমূলে উৎপাটিত রে কফিনে ঢুকিয়ে পেরেক পুঁতে দিয়ে চিরতরে কবরে ঢুকিয়ে দিয়ে যাবে! বুঝতে পারেনি সেদিন স্বয়ং ষোলোয়ানা ফোকটে পাওয়া মোটরশিল্পে নবীন অনভিজ্ঞ কারখানার মালিক সি কে বিড়লা! বুঝতে পারেননি সেদিন যৌবনের ছটফটানিতে ব্যস্ত-সমস্ত, মালিকানার অহংকারে মত্ত স্বয়ং সি কে বিড়লা, নিজের হাতে তিনি খুঁড়ে ফেলেছেন নিজের কবর! কতবড় ভুল তিনি করে ফেলেছেন আর সেই ভুলে তৈরী তে চলেছে বিরাট গহ্বর, খাদ, যেখান থেকে আর তিনি কোনোদিনই উঠে আসতে পারবেন না! শুধু সময়ের অপেক্ষা!

সেই ভুল তিনি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছিলেন কিন্তু আর সেই ভুল থেকে ফেরার আর কোন উপায় ছিল না! ততোক্ষণে ঘুণ পোকা ঝাঁঝরা রে দিয়েছে কারখানার সর্বাঙ্গ! সি কে বিড়লার সেই ভুল ছিল কারখানার প্রবীন অভিজ্ঞ মালী, কারখানার প্রাণভোমরা, কারখানা নিবেদিত প্রাণ কারখানার প্রেসিডেন্ট এস এল ভাট্টারকে ব্যক্তিত্বের অকারণ সংঘাতে, অহং-এর তুচ্ছ লড়াইয়ে কারখানা থেকে অপসারণ! সেদিন মোটরশিল্পে সম্পুর্ণ অনভিজ্ঞ নবীন যুবক চন্দ্রকান্তর পাশে কেউ ছিল না যে চাণক্যর ভুমিকায় অবতীর্ণ য়ে তাকে তার সাম্রাজ্যকে সঠিক সময়ে সঠিক পথে চালিত রে তাকে, তার সাম্রাজ্য তার প্রজাকে বাঁচাবে!

ক্রমশঃ
Written on 28th July.



No comments:

Post a Comment