শিল্প নিয়ে প্রশ্নের মুখে পশ্চিমবঙ্গ।

শিল্প নিয়ে প্রশ্নের মুখে পশ্চিমবঙ্গ।

Arunava Roy আমাকে আমার 'শিল্প বা কারখানা বন্ধ' হ'য়ে যাওয়া সম্পর্কিত লেখাগুলিতে FB-এ একটা প্রশ্ন করেছিল “আমরা বাংলায় কোনও শিল্পকে আকর্ষন করতে পারি না, কেন?” এই প্রশ্নে আমি আমার ব্যক্তিগত মতামতটা আমার Timeline-এ post করলাম প্রশ্নের গুরুত্ব উপলব্ধি ক'রে। অরুনাভ রায়-কে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ আমাকে এই প্রশ্নে ব্যতিব্যস্ত করার জন্য। হিন্দমোটর কারখানা নিয়ে লিখতে গিয়ে এরকম অনেক উৎসাহিত ও জিজ্ঞাসু পাঠকের আমি সাড়া পেয়েছি। তাদের সকলকেই আমার তরফ থেকে আন্তরিক ধন্যবাদ। ধন্যবাদ এই জন্য যে এখনও অনেক সিরিয়াস মানুষ আছেন যাদের জন্য FB-এর সঙ্গে জড়িত থাকার ইচ্ছেটাকে বাঁচিয়ে রাখা যায় এবং সমাজ সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে সিরিয়াস কিছু লেখা যায়।

অরুনাভ রায়ের প্রশ্নটা অনেক কিছু প্রশ্নের জন্ম দিতে পারে আবার এর উত্তর যেমন জটিল তেমনি সহজ। জটিল বা সহজ সবটাই নির্ভর করছে আমার মানসিক গঠন ও কেমনভাবে বিষয়টাকে আমি দেখছি তার ওপর। আমার চলা, আমার বলা, আমার করা, আমার দেখা, বোঝা, চিন্তা, ভাবনা কতটা স্বাধীন, কতটা আত্মস্বার্থ ও আত্মপ্রতিষ্ঠা মুক্ত, কতটা দূ্রদৃষ্টিসম্পন্ন, কতটা গভীর, কতটা পক্ষপাতশূন্য, কতটা সমাজ সম্পর্কিত, কতটা দেশপ্রেমযুক্ত, কতটা বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্ম স্বার্থান্বিত, কতটা জ্ঞান ও উপলব্ধি নির্ভর তার ওপর নির্ভর করে প্রশ্নের নিখুঁত ও চতুর উত্তর। চতুর অর্থে চালাকি নয়। চতুর অর্থে চার দিক দেখে উত্তর অর্থাৎ overall answer. প্রশ্নটা উঠে গেল perfection- এর প্রশ্নে।

যাইহোক, আপনার এই যে বাংলায় শিল্প না আসার বিষয়ে প্রশ্ন ‘কেন শিল্প আসছে না’ সে সম্পর্কে ‘নানা মুনির নানা মত’ থাকতেই পারে। ‘শিল্প কেন বাংলায় আসছে না’ প্রশ্নের আগে ‘কেন বাংলায় শিল্প টিকছে না’ নিয়ে যদি আলোচনা করা যায়, বিশ্লেষণ করা যায় তাহ’লে বাংলায় শিল্প না আসার প্রেক্ষাপট উন্মোচিত হ’তে পারে। যেসব শিল্প বাংলায় ছিল আজ আর নেই বা বন্ধ হ’য়ে গেছে, আর এখন যেসব শিল্পগুলি ‘উঠে যাবো, উঠে যাবো’ ক’রে ধুঁকছে সেগুলি কেন এমন অস্তিত্ব সংকটে পড়ল?

কার দোষ??????????????

মালিক? ম্যানেজমেন্ট? শ্রমিক-কর্মচারী? শ্রমিক ইউনিয়ন? রাজনৈতিক দল? রাজনৈতিক বা ট্রেড ইউনিয়ন নেতা? না-কি জনগণ?

প্রথমে দেখা যাক কতগুলি শিল্প বন্ধ।

বিধানসভায় শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসুর হিসাব অনুযায়ী চলতি বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে বড় ও মাঝারি পর্যায়ের বন্ধ কল কারখানার সংখ্যা ২৭৮টি। ছোটো কারখানাগুলিকে ধরলে সবমিলিয়ে সংখ্যাটা নিশ্চিতভাবেই ৫৫ হাজার হবে।

কেন এমন হ’ল?

শিল্প মহল ও বিরোধীদের মতে,

ষাটের দশকে বামপন্থী শ্রমিক সংগঠনগুলির জঙ্গি আন্দোলন একের পর এক শিল্পকে রাজ্য ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করে। পশ্চিমবঙ্গে সমস্ত রকম শিল্পের সুযোগ সুবিধা থাকা সত্ত্বেও এই নিয়ন্ত্রণহীন জঙ্গি আন্দোলনের ফলে পশ্চিমবঙ্গের প্রতি শিল্পপতিদের আস্থা চলে যেতে থাকে। বামপন্থীদের শ্রমিক রাজ কায়েম করার স্বপ্ন ও অবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব পশ্চিমবঙ্গে শিল্পপতিদের শিল্প স্থাপনে অনীহার কারণ হ’য়ে দাঁড়ায়। রাজনৈতিক অস্থিরতা রাজনীতি সচেতন এবং কৃষ্টি ও সংস্কৃতির পীঠস্থান পশ্চিমবঙ্গে চরম আকার ধারণ করে। এর ফলে লগ্নির ক্ষেত্রে ঝুঁকির পরিমাণ অত্যধিক বেশী হ’য়ে যাওয়ায় লোকসান ও ক্ষয়ক্ষতির ভয়ে পশ্চিমবঙ্গে শিল্পপতিরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।

এছাড়া বর্তমান রাজ্য সরকারের প্রতিশ্রুতি ‘ট্রেড ইউনিয়নের নামে শিল্পে জঙ্গি আন্দোলন বরদাস্ত করা হবে না’ এখনও খাতায় কলমে বন্দি। ফলে রাজ্য সরকারের সদিচ্ছার ওপর শিল্প মহলের বিশ্বাসে চিড় ধরে।

পশ্চিমবঙ্গে লগ্নি না করার অন্যতম কারণ হিসাবে বণিক সংগঠনগুলির দাবি, বাংলায় নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পরও রাজ্যে শিল্পের অবস্থা এমন কিছু উন্নতি লাভ করেনি। বিশেষত জমি পেতে পেতে এত সময় লাগে যে, বিরক্ত হয়ে শিল্পপতিরা এখানে বিনিয়োগ করতে চান না।

এখন প্রশ্ন শিল্পে আন্দোলন কেন হয়?

দাবি দাওয়ার ক্ষেত্রে শ্রমিকের সব দাবীই কি যুক্তিযুক্ত? কেন শ্রমিক আন্দোলন জঙ্গি আন্দোলনে রুপ নেয়? শ্রমিক আন্দোলন জঙ্গি আন্দোলনে রুপ নেওয়ার পিছনে মালিকের বা পরিচালনবর্গের বা ইউনিয়নের ভুমিকা কি বা কোন লুকানো এজেন্ডা থাকে কি? বামপন্থী শ্রমিক আন্দোলনগুলি কি সব শ্রমিক স্বার্থেই সংগঠিত হ’ত বা হয়েছিল? মালিকের শ্রমিকের প্রতি আচরণ ও মনোভাব কি সদর্থক? সামাজিক দায়বদ্ধতা ও দেশপ্রেম কি শিল্প মালিকের বিচার্য বিষয় নয়? না-কি একচেটিয়া মুনাফা-ই একমাত্র বিচার্য ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়? সব মালিকই কি রক্তচোষা বাদুড়? মালিকরা কি প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণে বিশ্বাসী ও আগ্রহী? আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী নেতারা কি আদর্শবান, সৎ ও সত্যবাদী যুধিষ্টির? শিল্পের পরিচালন ব্যবস্থায় নিযুক্ত পরিচালকরা কি সবাই মালিকদরদী, যোগ্য ও দক্ষ, সৎ ও শিল্পপ্রেমিক? শিল্প পরিচালকদের কোন সামাজিক দায়বদ্ধতা আছে কি? রাজনৈতিক ও শ্রমিক নেতারা কি প্রকৃতই মালিক, শ্রমিক ও শিল্প, সমাজ, রাষ্ট্র, পরবর্তী প্রজন্ম দরদী? শ্রমিক-কর্মচারীরা কি পরস্পর পরস্পরের প্রতি চিন্তা ও দয়াশীল এবং শিল্প সচেতন ও শিল্প রক্ষায় আগ্রহী?

এরকম অনেক প্রশ্নের জবাব কে দেবে?

কলে-কারখানায়, কর্পোরেট জগতে একটা কথা চালু আছে ‘প্রফেশনাল ম্যানেজমেন্ট’। প্রফেশনাল ম্যানেজমেন্টের আউটলুক কি প্রকৃতই শিল্প বা মালিকের অস্তিত্ব রক্ষা ও বৃদ্ধির স্বার্থে যুক্ত না-কি আত্মস্বার্থান্বিত?

এবার আসা যাক শিল্পপতিরা কি আগ্রহী পশ্চিমবঙ্গে?

যে সব মাপকাঠি বিচার করে শিল্পপতিরা কোনও রাজ্যে লগ্নি করতে উৎসাহিত হন তা হ’ল, উন্নত মানের পরিকাঠামো। জলের দরে শ্রম বা সস্তার শ্রমিক। শ্রমিক অশান্তি বিহীন শিল্পের পরিবেশ। রাজ্য জুড়ে রাজনৈতিক স্থিরতা ও শান্ত বাতাবরণ। অতি অল্প কর। সরাসরি সরকারী পৃষ্টপোষকতা ইত্যাদি ইত্যাদি।
শিল্পে লগ্নীকারীদের উপযুক্ত পরিবেশ, শিল্পপতিদের আস্থা অর্জন, উপযুক্ত পরিকাঠামো (বিমান বন্দর ও সমুদ্র বন্দর, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল), পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ, কয়লা, জল ইত্যাদি ইত্যাদি ঠিক ঠিক হ’লে শিল্পপতিরা আগ্রহী হয়।

পশ্চিমবঙ্গে শিল্প না আসার বা না টেকার জন্য কার দোষ???????

পরিশেষে এ কথা আসাই স্বাভাবিক যে কার দোষ? মালিকের? শ্রমিকের? ট্রেড ইউনিয়ন নেতার? রাজনৈতিক দল ও তাদের নেতৃবৃন্দর? শিল্প পরিচালনায় যুক্ত ‘প্রফেশনাল ম্যানেজমেন্টের’ উচ্চপদস্থ আধিকারিকের? সরকারী আমলা ও মন্ত্রীর?

রাজ্যে শিল্প ধ্বংসের ও শিল্প না আসার কারণ বৃত্তি প্রবৃত্তিতে ডুবে থাকা আদর্শহীন মানুষ! অদক্ষ, অযোগ্য ও অশিক্ষিত মানুষ! অকৃতজ্ঞ বেইমান মানুষ! স্বার্থপর লোভী হিংস্র মানুষ! অহংকারী, অজ্ঞানী সবজান্তা মানুষ! মুখোশধারী নেমকহারাম মানুষ! মুল্যবোধহীন নিম্ন মানসিকতার মানুষ!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!

এই ধরণের মানুষের, সে মালিক,পরিচালক, শ্রমিক-কর্মচারী, রাজনৈতিক জননেতা, ইউনিয়ন নেতা, সমাজের তথাকথিত লেখাপড়াজানাওয়ালা এলিট সম্প্রদায়ের মানুষ বা সাধারণ মানুষ সে যেই হ'ক না কেন, একটাই বুলি, ‘আমার গায়ে আঁচ না লাগে, ফুরিয়ে যাবে মামলা’।

কিন্তু পরিশেষে যা হয় তা হ’ল, এই আঁচে পুড়ে ছারখার হ’য়ে যায় মানুষ, সমাজ, সভ্যতা সব সবকিছু!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!