আজ একমাস অতিক্রম করে গেল হিন্দমোটর কারখানা বন্ধ হওয়ার
পর। কারখানা খোলা
নিয়ে সরকার পক্ষের সঙ্গে কারখানা কর্তৃপক্ষের পরবর্তী বৈঠকের দিনক্ষণ এখনও ঠিক হয়নি। আতঙ্কে, হতাশায় দিন কাটাচ্ছে শ্রমিক-কর্মচারী ও তাদের পরিবার। ইতিমধ্যে ম্যানেজার ও এগজিকিউটিভ পদের কর্মীদেরও কাজে না আসার নোটিস
ধরিয়ে দেন কোম্পানি কর্তৃপক্ষ৷ সব মিলিয়ে এক চরম যন্ত্রণার বাতাবরণ হিন্দমোটরের আকাশে বাতাসে, ঘরে ঘরে!
কিন্তু কারও কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। পরিবর্তনের বাংলায় চিরসমাধি হ’য়ে গেল বলা চলে একসময়ের এশিয়ার বৃহৎ
মোটর শিল্পের!
তবুও স্বপ্ন নিয়ে
বেঁচে থাকা। পরিবর্তনের বাংলায় আজ না হয় কাল খুলবে, নিশ্চয়ই খুলবে শ্রমমন্ত্রীর হাত ধ'রে বাংলার সম্পদ প্রাচীন এই কারখানা।
যে কারখানা একদিন
ফোর্জ শপ, ফাউন্ড্রী, মেশিন শপ, ইঞ্জিন প্ল্যান্ট, অ্যাক্সেল প্ল্যান্ট, পেইন্টস শপ, স্ট্রং আর এন ডি ডিপার্টমেন্ট সহ আরও বহু ছোট বড় সহায়ক ডিপার্টমেন্ট নিয়ে
গঠিত হিন্দমোটর কারখানা উত্তরপাড়ার বুকে ভারতের প্রথম
স্বয়ং সম্পুর্ণ মোটর শিল্প (The first and only integrated
automobile plant in India, the Uttarpara factory, popularly known as Hind
Motor, also manufactures automotive and forged components) হিসাবে গড়ে উঠেছিল সেই কারখানা আজ প্রায় ৬৫বছর পর একেবারে বন্ধ হ’য়ে গেল!? এই কারখানায় গাড়ীর যন্ত্রাংশ তৈরী হওয়া থেকে
শুরু ক’রে গাড়ীর সমস্ত অংশ একসঙ্গে যুক্ত করার
মধ্যে দিয়ে সম্পূর্ণ একটি গাড়িতে পরিণত
হ’য়ে বেরিয়ে আসার যে বিশাল
কর্মযজ্ঞ চলেছিল দীর্ঘ
৬০ বছর সেই কর্মযজ্ঞে ছেদ পড়েছিল প্রথম হিন্দমোটরের মালিক সি কে বিড়লার প্রত্যক্ষ মদতে প্রেসিডেন্ট এস এল ভাট্টারের নেতৃত্ব-কে অপসাররণ করার মধ্যে দিয়ে। আর পরবর্তীকালে মালিক সি কে বিড়লা
দ্বারা নিযুক্ত ম্যাকিন্সে কনসালটেন্সির দেওয়া পরামর্শ রুপায়নের মধ্যে দিয়ে
রচিত হ’ল আজকের হিন্দমোটরের সমাধি!
কি ছিল ম্যাকিন্সে কনসালটেন্সির সেই পরামর্শ?
ম্যাকিন্সের প্রথম বুদ্ধিদীপ্ত(?)পরামর্শ ছিল কারখানা যদি বাঁচাতে হয় এবং প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে
থাকতে হয় তাহ’লে কারখানার দীর্ঘদিনের যন্ত্রাংশ উৎপাদন ও অ্যাসেম্বল এই দুই ব্যবস্থার মধ্যে যন্ত্রাংশ উৎপাদন ব্যবস্থাকে বন্ধ ক’রে দিয়ে যন্ত্রাংশ আমদানির মাধ্যমে অ্যাসেম্বলি ব্যবস্থাকে শুধু চালু
রাখতে হবে! ঐ কনসালটেন্সি মোটা টাকার
পারিশ্রমিকের বিনিময়ে হিন্দমোটরের মালিক সি কে বিড়লাকে স্বয়ং সম্পুর্ণ অটোমোবাইল কারখানা হিন্দুস্তান মোটর্সকে যন্ত্রাংশ উৎপাদন ব্যবস্থা বন্ধ ক’রে যন্ত্রাংশ আমদানির মাধ্যমে শুধুমাত্র গাড়ী তৈরীর
অ্যাসেম্বলি প্ল্যান্টে পরিণত করার বুদ্ধি দিয়েছিল।
শুধু অ্যাসেম্বলি ব্যবস্থা চালু
হ’লে কি হবে?
ফলে বিশাল ফাউন্ড্রি, ফোর্জ প্ল্যান্ট, ইঞ্জিন প্ল্যান্ট, মেশিন শপ, প্রেস শপ, প্লেটিং শপ সহ বহু ডিপার্টমেন্ট বন্ধ হ’য়ে যাবে। আর ম্যাকেন্সি কনসালটেন্সির পরামর্শ ছিল গাড়ি তৈরীর বিভিন্ন যন্ত্রাংশ আমদানি করা হ’ক আর অ্যাসেম্বলি প্ল্যান্টের জন্য কারখানার ১২হাজার শ্রমিক-কর্মচারীর মধ্যে ৩হাজার শ্রমিকের বেশী লাগবে
না।
তৎকালীন সরকার ও শাসক গোষ্ঠীর এবং অন্যান্য শ্রমিক সংগঠনের অভিমত কি ছিল?
ম্যাকেন্সি কনসালটেন্সির মতের সঙ্গে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মতের মিল ছিল। তিনি বলেছিলেন, দশ বারো হাজার
শ্রমিক কর্মচারী নিয়ে কারখানা চালানোর সময় এখন নয়। একই সঙ্গে সিআইটিইউ-র সর্বভারতীয় সভাপতি চিত্তব্রত মজুমদারও বললেন, বর্তমান উদারনীতির যুগে হিন্দমোটরের মতো কারখানাগুলির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। বাকী সমস্ত শ্রমিক সংগঠনগুলির ভুমিকা ছিল রহস্যজনকভাবে নীরব! ব্যস
ফলে যা হবার
তাই হ’ল।
ম্যাকিন্সের সময়োচিত মুল্যবান পরামর্শ (?) এবং সেই পরামর্শকে তৎকালীন বাংলার সরকার ও শ্রমিক সংগঠনের প্রধান-এর মিলিত যৌথ সমর্থন এবং অন্যান্য শ্রমিক সংগঠনের মৌনতার সীলমোহর খাদের কিনারায় এনে দাঁড় করিয়ে দিল একসময়ের এশিয়ার বৃহৎ
অটোমোবাইল শিল্প হিন্দুস্তান মোটর্স কারখানাকে। আর সেই খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে বেহালা হাতে নিরোরুপী সি কে বিড়লা
বিভোর হয়ে রইলেন
বিশাল টাইটানিক জাহাজরুপী স্বয়ং
সম্পুর্ণ কারখানাকে সঙ্কুচিত করার
সুর সাধনার মধ্যে
দিয়ে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বপ্নে!
অতঃপর ম্যাকিন্সের পরামর্শ অনুযায়ী শুরু হ’ল পথ চলা। তখন হিন্দমোটরের আকাশে বাতাসে একটাই কথা ভেসে
বেড়াচ্ছে হিন্দুস্তান মোটর্স কে গাড়ি তৈরির
প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে
থাকতে হ’লে এই পথ দিয়ে
চলা শুরু করতে
হবে। আর শান্তানাম হ’লেন আধুনিক ম্যানেজমেন্টের অরণ্যদেব! সেখানে প্রাচীন মানসিকতার বয়স হ’য়ে যাওয়া
প্রায় ২০হাজার শ্রমিক-কর্মচারীর প্রতিষ্ঠান বি-শা-ল হিন্দমোটরের রুপকার এস এল ভাট্টার না-কি বেমানান!!
যাই হোক, ম্যাকিন্সের দেখানো পথে ১৯৯৮-৯৯ সালে সি কে বিড়লার প্রত্যক্ষ মদতে শঙ্কর নারায়ণন ও সান্তানামের যৌথ নেতৃত্বে শুরু হ’ল বিশাল টাইটানিক জাহাজরুপী ভারতের প্রথম
ও এশিয়ার বৃহৎ
মোটর শিল্প হিন্দুস্তান মোটর্স ধ্বংসের কর্মযজ্ঞ!
কেমন ছিল সেই ধ্বংসের ব্লূ প্রিন্ট?????
ক্রমশঃ
Written on 30th June' 2014
No comments:
Post a Comment