আজ
রবিবার শ্রী কৃষ্ণের জন্মদিন। দেশজুড়ে পালন হচ্ছে তাঁর জন্মদিন। তাঁর গীতায় বলা
বাণী স্মরণ করছে শ্রদ্ধার সঙ্গে কৃষ্ণভক্ত, ঈশ্বরবিশ্বাসী মানুষ!
“যদা
যদাহি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মনং সৃজাম্যহম্।
পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্ ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।'
অর্থাৎ যখন যখন ধর্মের
গ্লানি হয়, অধর্মের
উত্থান ঘটে, তখন তখন
সজ্জনদের পরিত্রাণ, দুষ্কৃতকারীদের
বিনাশ এবং ধর্ম সংস্থাপনের জন্য, অন্যায়ের প্রতিবিধান করে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার জন্য ভগবান জীবদেহ ধারণ
করে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন।
কিন্তু
আমরা কি এই বাণীর মর্মার্থ কি তা’ বুঝি, মানি বা
বিশ্বাস করি? যদি এর
মানে বুঝবোই, এই কথা
মানবোই এবং বিশ্বাস করবোই তাহ’লে আজ ধর্মের এই অবস্থা কেন? কেন ঈশ্বর বিশ্বাসী মানুষের আজ করুণ অবস্থা?
প্রশ্ন জাগে মনে
আমরা ঈশ্বর বিশ্বাসী মানুষেরা, কৃষ্ণপ্রেমীরা কি এই বাণীর মর্মাথ সত্যি সত্যিই বুঝেছি??????? তাহ'লে তাঁর বারবার ফিরে আসা সত্ত্বেও ধর্মের,
ধর্ম বিশ্বাসী
মানুষের আজ এই করূণ অবস্থা কেন? না-কি সবটাই অজ্ঞানতার অন্ধকারে ডুব দিয়ে, তাত্ত্বিক আমেজে মজে গিয়ে নিছক ভালোবাসা
কিম্বা ভন্ডামি??????????
শ্রীকৃষ্ণ শৈশবেই দুর্ধর্ষ আর অপ্রতিরোধ্য প্রকৃতির ছিলেন। পুতনা রাক্ষসী সহ অন্যান্য রাক্ষসদের এবং কালীয় নাগকে হত্যা ক’রে তিনি নিজের ও বৃন্দাবনবাসীর জীবনরক্ষা করে শৈশবেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে তিনি নিছকই একজন সাধারণ মানুষ নন! রহস্যময় তাঁর জীবনের প্রতি অধ্যায়ে অধ্যায়ে লুকিয়ে আছে ঘটনার ঘনঘটা! যৌবনে কৃষ্ণ তাঁর মামা কংসের অনুগামীদের দ্বারা সংঘটিত বহু হত্যার ষড়যন্ত্র থেকে আত্মরক্ষা ক’রে কংসকে বধ করেন এবং সেখানে কংসের পিতা উগ্রসেনকে পুনরায় যাদবকুলের রাজা হিসেবে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করেন এবং নিজে সেখানে অন্যতম যুবরাজ হিসেবে অবস্থান করেন। এই ধরণের ভয়ঙ্কর শত্রুদের বিরুদ্ধে কৃষ্ণের একক কৌশলী লড়াই ও তাদের পরাস্ত করা প্রমাণ করে কৃষ্ণ অসাধারণ চৌকশ মেধাবী শক্তিশালী প্রখর কূটবুদ্ধিসম্পন্ন পুরুষ ছিলেন যা বর্তমান উন্নত সামরিক শক্তিসম্পন্ন যে কোন দেশের যে কোন মিলিটারি জেনারেলের দুর্ধর্ষতাকে হার মানায়। এইখানে একটা লক্ষ্যনীয় বিষয় হ’ল ইচ্ছে করলে তিনি নিজেই স্বাভাবিক নিয়মেই মথুরার সিংহাসনে বসতে পারতেন কিন্তু তা’ তিনি করেননি। চেদি দেশের রাজা শিশুপালের একশত ঘৃণ্য অপরাধ সহ্য করা এবং তাকে ক্ষমা ক’রে শুধরে যাবার সু্যোগ দেওয়ার মধ্যে দিয়ে কৃষ্ণের চূড়ান্ত সহনশীলতা ও সংশোধনের মাধ্যমে ‘বেঁচে থাকা ও বেড়ে ওঠা’-র মানসিকতার প্রমাণ পাওয়া যায় এবং এর সাথে এও প্রমাণ পাওয়া যায় একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর সমাজের স্বার্থে, মানবজাতির স্বার্থে সঠিক সময়ে প্রয়োজনে তিনি কতটা ভয়ংকর হ’য়ে উঠতে পারেন। শিশুপালের একশো একটা অপরাধের পর কৃষ্ণের ভয়ংকর হ’য়ে ওঠা এবং পরিশেষে নির্মম হত্যা প্রমান করে যে তার সীমাহীন চরম সহনশিলতা এবং নিজেকে সংশোধনের মাধ্যমে বেঁচে থাকা ও বেড়ে ওঠার জন্য সুযোগ দেওয়াকে যেন কেউ তার চরিত্রের দুর্বলতা বলে মনে না করে। এখানেই তিনি প্রমাণ করেছিলেন কেন তাঁকে পরমপুরুষ বলা হয়ে থাকে।
পরবর্তী সময়ে প্রাচীন গুজরাটে শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকা নামে রাজ্য প্রতিষ্টিত করেন। ঠিক ঐ সময় কামরুপের রাজা ছিলেন অত্যাচারী, ধর্মদ্রোহী, নারী হরণকারী নরকাসুর। তিনি তার রাজত্বকালে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে মানবতা বিরোধী চরম অত্যাচার চালিয়ে মানব সমাজের অস্তিত্বকে বিপন্ন ক’রে তোলেন। তিনি এতটাই নারকীয় আসুরিক ক্রিয়াকলাপে যুক্ত থাকতেন যে তাকে শুধু ‘অসুর’ না একেবারে সরাসরি নরকের অসুর ‘নরকাসুর’ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। তিনি ভৌতিক শক্তি বলে বিভিন্ন রাজ্য থেকে নারী অপহরণ ক’রে ভোগের উদ্দেশ্যে নিজের কারাগারে বন্দী করে রাখতেন। সেই সময় প্রবল পরাক্রান্ত এমন কেউ ছিল না যে এমন ভয়ংকর নরপিশাচের হাত থেকে নারীদের তথা সমাজকে রক্ষা করে। আজকের এই বিজ্ঞানের চরম উন্নতির সময়ে, নানা 'বাদ'-এর উপস্থিতিতে বিশ্বে কোন দেশে এমনকেউ প্রবল পরাক্রান্ত ব্যক্তিত্ব আছেন না-কি যে নরপিশাচের হাত থেকে নারীদের তথা সমাজকে রক্ষা করবে?
যাই হ'ক, এরপরই ঐ ভয়ংকর নরপিশাচের মানবতা বিরোধী নারকীয় ক্রিয়াকলাপে কৃষ্ণ ভয়ংকর ক্রুদ্ধ হ’য়ে ওঠেন ও তাকে হত্যা করে সমাজে সুখ শান্তি ফিরিয়ে আনেন এবং নরকাসুরের কারাগারে বন্দী ১৬১০০ নারীকে উদ্ধার করেন। নরকাসুরকে হত্যা করার পর কৃষ্ণ কামরূপের যুবরাজ ভগদত্তকে ঐ সিংহাসনে প্রতিষ্টিত করেন। কিন্তু সেই সময়ে বন্দী নারীদের সমাজে কোন সম্মান ছিল না এবং তাঁদের সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে এনে তাদের পুনরায় বিবাহের মাধ্যমে গার্হস্থ্য জীবনে প্রবেশের কোন উপায় ছিল না। তাই কৃষ্ণ সেই অসুরের কারাগার থেকে উদ্ধার করা অসহায় নারীদের সম্মান রক্ষার্থে এবং সমাজের কুটিল আবর্তে আবার হারিয়ে যাবার আগেই সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে এনে তাঁদের সম্মানের সঙ্গে মাথা উচু ক’রে বাঁচা ও বেড়ে ওঠার সুযোগ ক’রে দেবার মহৎ উদ্দেশ্যে তাদের বিবাহ করেন। সেই সময় কৃষ্ণের সমস্ত মহিষীগণই দেবী লক্ষ্মীর অবতার হিসাবে সমাজে পুজিত হতেন। এইখানেই, যুবরাজ ভগদত্তকে কামরুপ রাজ্যের রাজা হিসাবে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করা এবং ১৬১০০ নারীর সম্ভ্রম রক্ষা ক’রে তাঁদের লক্ষীর অবতার হিসাবে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার মধ্যে দিয়ে আবার তিনি প্রমান করেন কেন তাঁকে জীবনস্বামী বলা হয়।
মহাভারতের যুদ্ধ এবং তার পরিণতিতে কৃষ্ণের প্রভাব ছিল গভীর, তীব্র। মহাভারতের যুদ্ধকে থামাবার জন্য দু’পক্ষের মধ্যে শান্তি স্থাপনের আপ্রাণ চেষ্টা যখন তাঁর ব্যর্থ হ’ল তখন কৃষ্ণের প্রখর কূটবুদ্ধির পরিচয় পেল সমগ্র মানবকূল! তাঁর ক্রূর কূটনীতিকের ভুমিকা মহাভারতের ভয়ংকর মহাযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সমস্ত রাজ্যের তাবড় তাবড় মহাবীর যোদ্ধাদের স্তম্ভিত ক’রে দিল! অথচ সেই ভয়ংকর নির্ম্মম কুটিল ঘোর মহাযুদ্ধে কৃষ্ণ যুদ্ধ করা তো দূরের কথা কোন অস্ত্রই হাতে নেননি! উপরন্তু সেই যুদ্ধে তিনি অর্জুনের রথের সারথীর ভুমিকা পালন করেছিলেন মাত্র! যুদ্ধ শুরুর সময় থেকে হতবল অর্জুনের মনোবলকে চাঙ্গা করার জন্য জীবন সম্পর্কে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ থেকে শুরু ক’রে একে একে ভীষ্ম, দ্রোণাচার্য, কর্ণ, জয়দ্রত এবং কৌরব প্রধান দূর্যোধন সহ সকল সেনাপ্রধানকে বধ করার অতুলনীয় ও অপ্রতিরোধ্য ক্রূর কৌশল পৃথিবীর ইতিহাসে আজও বিস্ময়ের সঙ্গে স্মরণ করা হয়ে থাকে! আঠেরো দিন ধরে চলা এই সংহারক যুদ্ধে ভারতবর্ষের বহু রাজার প্রাণ যায়। যুদ্ধ শেষে আবার রাজত্ব ফিরে পান জ্যেষ্ঠ পাণ্ডুপুত্র যুধিষ্ঠির।
মূলতঃ কৌরব ও পাণ্ডবদের গৃহবিবাদ থেকেই এই মহাভারতের যুদ্ধ শুরু। এই গৃহযুদ্ধকে ঠেকাতে গিয়েই কৃষ্ণ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়েন এবং মহান মানবতা রক্ষার স্বার্থেই তিনি এই যুদ্ধকে পরিচালনা করেন। কিন্তু যুদ্ধে তিনি কখনোই অস্ত্র ধারণ করেননি। একবার মাত্র তিনি একটি রথের চাকাকে চক্রে পরিণত ক’রে ভীষ্মকে আক্রমণ করতে উদ্যত হয়েছিলেন। এর পিছনেও ছিল তাঁর ক্রূর কূটিল চাল। পিতামহ ভীষ্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধে দ্বিধাগ্রস্থ অর্জুন ভীষ্মের ভয়ঙ্কর আক্রমণে যখন পর্যুদস্ত ঠিক সেই সময় অর্জুনকে রক্ষা করতে কৃষ্ণ ঢাল হয়ে অর্জুনকে ভীষ্মের হাত থেকে বাঁচান। এর ফলে আঘাতপ্রাপ্ত কৃষ্ণ ভীষ্মকে ক্রোধে আক্রমণ করতে উদ্যত হন। এতে অর্জুন লজ্জিত হন এবং নিজের কৃতকর্মের জন্য কৃষ্ণের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং পূর্ণ উদ্যম নিয়ে যুদ্ধ করার প্রতিজ্ঞা করেন। এখানে একসঙ্গে কৃষ্ণ দু’টি নিদর্শন স্থাপন করলেন। এক, নিজে অস্ত্র ধারণ করার মধ্যে দিয়ে তিনি অর্জুনের অর্জুনত্বকে আঘাত ক’রে তাঁর চেতনাকে জাগ্রত করলেন অন্যদিকে তিনি সামান্য রথের চাকারুপী অস্ত্র ধারণ করলে কি মহাপ্রলয় হ’তে পারে তারও ঈঙ্গিত দিয়েছিলেন! কিন্তু তিনি অস্ত্র ধরেননি কারণ তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন মানবজাতীকে আঠেরোদিনের যুদ্ধের প্রতিদিনের ধর্মের জয় আর অধর্মের পরাজয়ের জীবন্ত ছবি! এর মধ্যে দিয়ে তিনি বারেবারে প্রমান করেছিলেন কেন তাঁকে পুরুষোত্তম বলা হয়!
বৃষ্ণি বংশীয় সত্রাজিত ছিলেন দ্বারকার বিশিষ্ট নাগরিক। সূর্যদেব সত্রাজিতের ভ্রাতা প্রসেনকে স্যমন্তক মণি উপহার দেন। শ্রীকৃষ্ণ সত্রাজিতের কাছে স্যমন্তক মণি দেখতে চাইলে সত্রাজিত তাঁকে মণিটি দেখান এবং শ্রী কৃষ্ণ চলে গেলে সত্রাজিত ভাই প্রসেনকে স্যমন্তক মণিটি দিয়ে তাকে আত্মগোপন করে থাকতে বললেন এবং পরে প্রচার ক’রে দেন যে শ্রী কৃষ্ণ মণিটি দেখে চলে যাবার পর মণিটি আর পাওয়া যাচ্ছে না। এই বদনাম কৃষ্ণকে অনুপ্রাণিত করে মণিটি খুঁজে বার করার জন্য। পরে তিনি অনেক অনুসন্ধানের পর ভল্লুকরাজ জাম্ববানের কাছে স্যমন্তক মণির সন্ধান পেলেন। সেখান থেকে মণিটি উদ্ধার ক’রে এনে তিনি দ্বারকার সকল বিশিষ্ট নাগরিকের সামনে ঘটনাটি তুলে ধরেন এবং দ্বারকার সকল বিশিষ্ট নাগরিকের দেওয়া রায় সত্ত্বেও শ্রীকৃষ্ণ স্যমন্তক মণি গ্রহণ করেননি, ফিরিয়ে দিয়েছিলেন সত্রাজিতকে। এখানেও প্রমাণ হয় বৃত্তি-প্রবৃত্তির কতটা উর্ধ্বে তিনি বিচরণ করেন এবং কেন তাঁকে মানবজাতির মুক্তির প্রাণপুরুষ বলা হয়!
কিন্তু ধর্ম ও ঈশ্বর বিশ্বাসী সাধারণ অজ্ঞ মানুষ, চূড়ান্ত বৃত্তি-প্রবৃত্তিতে ডুবে থাকা রিপু তাড়িত ভাঙ্গাচোরা মানুষ আজ কৃষ্ণকে নিয়ে শুধু 'বালগোপাল, বালগোপাল' খেলা-ই করে আর লাড্ডু, মালপোয়ার মধ্যে তাঁর জীবন দর্শন খুঁজে পায়!!!!!!!!! তাঁর বাণী "যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত........................সম্ভবামি যুগে যুগে" প্রয়োগ করে যত্রতত্র এবং যেকোনও ব্যক্তির মধ্যে তাঁর প্রতিফলন দেখতে পান!!!!!!!!!!!
আজ শুধু ভারাক্রান্ত হৃদয়ে এই টুকুই বলতে ইচ্ছে করে, "পঞ্চ ভুতের ফাঁদে, বহ্মা পড়ে কাঁদে"! হে ঈশ্বর তুমি আমাদের অজ্ঞানতাকে, অহংকারকে ক্ষমা ক'রো!
কেন
শ্রীকৃষ্ণকে পরমপুরুষ, জীবনস্বামী,
পুরুষোত্তম ও
মানবজাতির মুক্তির প্রাণপুরুষ বলা হয়?
শ্রীকৃষ্ণ শৈশবেই দুর্ধর্ষ আর অপ্রতিরোধ্য প্রকৃতির ছিলেন। পুতনা রাক্ষসী সহ অন্যান্য রাক্ষসদের এবং কালীয় নাগকে হত্যা ক’রে তিনি নিজের ও বৃন্দাবনবাসীর জীবনরক্ষা করে শৈশবেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে তিনি নিছকই একজন সাধারণ মানুষ নন! রহস্যময় তাঁর জীবনের প্রতি অধ্যায়ে অধ্যায়ে লুকিয়ে আছে ঘটনার ঘনঘটা! যৌবনে কৃষ্ণ তাঁর মামা কংসের অনুগামীদের দ্বারা সংঘটিত বহু হত্যার ষড়যন্ত্র থেকে আত্মরক্ষা ক’রে কংসকে বধ করেন এবং সেখানে কংসের পিতা উগ্রসেনকে পুনরায় যাদবকুলের রাজা হিসেবে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করেন এবং নিজে সেখানে অন্যতম যুবরাজ হিসেবে অবস্থান করেন। এই ধরণের ভয়ঙ্কর শত্রুদের বিরুদ্ধে কৃষ্ণের একক কৌশলী লড়াই ও তাদের পরাস্ত করা প্রমাণ করে কৃষ্ণ অসাধারণ চৌকশ মেধাবী শক্তিশালী প্রখর কূটবুদ্ধিসম্পন্ন পুরুষ ছিলেন যা বর্তমান উন্নত সামরিক শক্তিসম্পন্ন যে কোন দেশের যে কোন মিলিটারি জেনারেলের দুর্ধর্ষতাকে হার মানায়। এইখানে একটা লক্ষ্যনীয় বিষয় হ’ল ইচ্ছে করলে তিনি নিজেই স্বাভাবিক নিয়মেই মথুরার সিংহাসনে বসতে পারতেন কিন্তু তা’ তিনি করেননি। চেদি দেশের রাজা শিশুপালের একশত ঘৃণ্য অপরাধ সহ্য করা এবং তাকে ক্ষমা ক’রে শুধরে যাবার সু্যোগ দেওয়ার মধ্যে দিয়ে কৃষ্ণের চূড়ান্ত সহনশীলতা ও সংশোধনের মাধ্যমে ‘বেঁচে থাকা ও বেড়ে ওঠা’-র মানসিকতার প্রমাণ পাওয়া যায় এবং এর সাথে এও প্রমাণ পাওয়া যায় একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর সমাজের স্বার্থে, মানবজাতির স্বার্থে সঠিক সময়ে প্রয়োজনে তিনি কতটা ভয়ংকর হ’য়ে উঠতে পারেন। শিশুপালের একশো একটা অপরাধের পর কৃষ্ণের ভয়ংকর হ’য়ে ওঠা এবং পরিশেষে নির্মম হত্যা প্রমান করে যে তার সীমাহীন চরম সহনশিলতা এবং নিজেকে সংশোধনের মাধ্যমে বেঁচে থাকা ও বেড়ে ওঠার জন্য সুযোগ দেওয়াকে যেন কেউ তার চরিত্রের দুর্বলতা বলে মনে না করে। এখানেই তিনি প্রমাণ করেছিলেন কেন তাঁকে পরমপুরুষ বলা হয়ে থাকে।
পরবর্তী সময়ে প্রাচীন গুজরাটে শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকা নামে রাজ্য প্রতিষ্টিত করেন। ঠিক ঐ সময় কামরুপের রাজা ছিলেন অত্যাচারী, ধর্মদ্রোহী, নারী হরণকারী নরকাসুর। তিনি তার রাজত্বকালে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে মানবতা বিরোধী চরম অত্যাচার চালিয়ে মানব সমাজের অস্তিত্বকে বিপন্ন ক’রে তোলেন। তিনি এতটাই নারকীয় আসুরিক ক্রিয়াকলাপে যুক্ত থাকতেন যে তাকে শুধু ‘অসুর’ না একেবারে সরাসরি নরকের অসুর ‘নরকাসুর’ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। তিনি ভৌতিক শক্তি বলে বিভিন্ন রাজ্য থেকে নারী অপহরণ ক’রে ভোগের উদ্দেশ্যে নিজের কারাগারে বন্দী করে রাখতেন। সেই সময় প্রবল পরাক্রান্ত এমন কেউ ছিল না যে এমন ভয়ংকর নরপিশাচের হাত থেকে নারীদের তথা সমাজকে রক্ষা করে। আজকের এই বিজ্ঞানের চরম উন্নতির সময়ে, নানা 'বাদ'-এর উপস্থিতিতে বিশ্বে কোন দেশে এমনকেউ প্রবল পরাক্রান্ত ব্যক্তিত্ব আছেন না-কি যে নরপিশাচের হাত থেকে নারীদের তথা সমাজকে রক্ষা করবে?
যাই হ'ক, এরপরই ঐ ভয়ংকর নরপিশাচের মানবতা বিরোধী নারকীয় ক্রিয়াকলাপে কৃষ্ণ ভয়ংকর ক্রুদ্ধ হ’য়ে ওঠেন ও তাকে হত্যা করে সমাজে সুখ শান্তি ফিরিয়ে আনেন এবং নরকাসুরের কারাগারে বন্দী ১৬১০০ নারীকে উদ্ধার করেন। নরকাসুরকে হত্যা করার পর কৃষ্ণ কামরূপের যুবরাজ ভগদত্তকে ঐ সিংহাসনে প্রতিষ্টিত করেন। কিন্তু সেই সময়ে বন্দী নারীদের সমাজে কোন সম্মান ছিল না এবং তাঁদের সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে এনে তাদের পুনরায় বিবাহের মাধ্যমে গার্হস্থ্য জীবনে প্রবেশের কোন উপায় ছিল না। তাই কৃষ্ণ সেই অসুরের কারাগার থেকে উদ্ধার করা অসহায় নারীদের সম্মান রক্ষার্থে এবং সমাজের কুটিল আবর্তে আবার হারিয়ে যাবার আগেই সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে এনে তাঁদের সম্মানের সঙ্গে মাথা উচু ক’রে বাঁচা ও বেড়ে ওঠার সুযোগ ক’রে দেবার মহৎ উদ্দেশ্যে তাদের বিবাহ করেন। সেই সময় কৃষ্ণের সমস্ত মহিষীগণই দেবী লক্ষ্মীর অবতার হিসাবে সমাজে পুজিত হতেন। এইখানেই, যুবরাজ ভগদত্তকে কামরুপ রাজ্যের রাজা হিসাবে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করা এবং ১৬১০০ নারীর সম্ভ্রম রক্ষা ক’রে তাঁদের লক্ষীর অবতার হিসাবে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার মধ্যে দিয়ে আবার তিনি প্রমান করেন কেন তাঁকে জীবনস্বামী বলা হয়।
মহাভারতের যুদ্ধ এবং তার পরিণতিতে কৃষ্ণের প্রভাব ছিল গভীর, তীব্র। মহাভারতের যুদ্ধকে থামাবার জন্য দু’পক্ষের মধ্যে শান্তি স্থাপনের আপ্রাণ চেষ্টা যখন তাঁর ব্যর্থ হ’ল তখন কৃষ্ণের প্রখর কূটবুদ্ধির পরিচয় পেল সমগ্র মানবকূল! তাঁর ক্রূর কূটনীতিকের ভুমিকা মহাভারতের ভয়ংকর মহাযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সমস্ত রাজ্যের তাবড় তাবড় মহাবীর যোদ্ধাদের স্তম্ভিত ক’রে দিল! অথচ সেই ভয়ংকর নির্ম্মম কুটিল ঘোর মহাযুদ্ধে কৃষ্ণ যুদ্ধ করা তো দূরের কথা কোন অস্ত্রই হাতে নেননি! উপরন্তু সেই যুদ্ধে তিনি অর্জুনের রথের সারথীর ভুমিকা পালন করেছিলেন মাত্র! যুদ্ধ শুরুর সময় থেকে হতবল অর্জুনের মনোবলকে চাঙ্গা করার জন্য জীবন সম্পর্কে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ থেকে শুরু ক’রে একে একে ভীষ্ম, দ্রোণাচার্য, কর্ণ, জয়দ্রত এবং কৌরব প্রধান দূর্যোধন সহ সকল সেনাপ্রধানকে বধ করার অতুলনীয় ও অপ্রতিরোধ্য ক্রূর কৌশল পৃথিবীর ইতিহাসে আজও বিস্ময়ের সঙ্গে স্মরণ করা হয়ে থাকে! আঠেরো দিন ধরে চলা এই সংহারক যুদ্ধে ভারতবর্ষের বহু রাজার প্রাণ যায়। যুদ্ধ শেষে আবার রাজত্ব ফিরে পান জ্যেষ্ঠ পাণ্ডুপুত্র যুধিষ্ঠির।
মূলতঃ কৌরব ও পাণ্ডবদের গৃহবিবাদ থেকেই এই মহাভারতের যুদ্ধ শুরু। এই গৃহযুদ্ধকে ঠেকাতে গিয়েই কৃষ্ণ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়েন এবং মহান মানবতা রক্ষার স্বার্থেই তিনি এই যুদ্ধকে পরিচালনা করেন। কিন্তু যুদ্ধে তিনি কখনোই অস্ত্র ধারণ করেননি। একবার মাত্র তিনি একটি রথের চাকাকে চক্রে পরিণত ক’রে ভীষ্মকে আক্রমণ করতে উদ্যত হয়েছিলেন। এর পিছনেও ছিল তাঁর ক্রূর কূটিল চাল। পিতামহ ভীষ্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধে দ্বিধাগ্রস্থ অর্জুন ভীষ্মের ভয়ঙ্কর আক্রমণে যখন পর্যুদস্ত ঠিক সেই সময় অর্জুনকে রক্ষা করতে কৃষ্ণ ঢাল হয়ে অর্জুনকে ভীষ্মের হাত থেকে বাঁচান। এর ফলে আঘাতপ্রাপ্ত কৃষ্ণ ভীষ্মকে ক্রোধে আক্রমণ করতে উদ্যত হন। এতে অর্জুন লজ্জিত হন এবং নিজের কৃতকর্মের জন্য কৃষ্ণের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং পূর্ণ উদ্যম নিয়ে যুদ্ধ করার প্রতিজ্ঞা করেন। এখানে একসঙ্গে কৃষ্ণ দু’টি নিদর্শন স্থাপন করলেন। এক, নিজে অস্ত্র ধারণ করার মধ্যে দিয়ে তিনি অর্জুনের অর্জুনত্বকে আঘাত ক’রে তাঁর চেতনাকে জাগ্রত করলেন অন্যদিকে তিনি সামান্য রথের চাকারুপী অস্ত্র ধারণ করলে কি মহাপ্রলয় হ’তে পারে তারও ঈঙ্গিত দিয়েছিলেন! কিন্তু তিনি অস্ত্র ধরেননি কারণ তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন মানবজাতীকে আঠেরোদিনের যুদ্ধের প্রতিদিনের ধর্মের জয় আর অধর্মের পরাজয়ের জীবন্ত ছবি! এর মধ্যে দিয়ে তিনি বারেবারে প্রমান করেছিলেন কেন তাঁকে পুরুষোত্তম বলা হয়!
বৃষ্ণি বংশীয় সত্রাজিত ছিলেন দ্বারকার বিশিষ্ট নাগরিক। সূর্যদেব সত্রাজিতের ভ্রাতা প্রসেনকে স্যমন্তক মণি উপহার দেন। শ্রীকৃষ্ণ সত্রাজিতের কাছে স্যমন্তক মণি দেখতে চাইলে সত্রাজিত তাঁকে মণিটি দেখান এবং শ্রী কৃষ্ণ চলে গেলে সত্রাজিত ভাই প্রসেনকে স্যমন্তক মণিটি দিয়ে তাকে আত্মগোপন করে থাকতে বললেন এবং পরে প্রচার ক’রে দেন যে শ্রী কৃষ্ণ মণিটি দেখে চলে যাবার পর মণিটি আর পাওয়া যাচ্ছে না। এই বদনাম কৃষ্ণকে অনুপ্রাণিত করে মণিটি খুঁজে বার করার জন্য। পরে তিনি অনেক অনুসন্ধানের পর ভল্লুকরাজ জাম্ববানের কাছে স্যমন্তক মণির সন্ধান পেলেন। সেখান থেকে মণিটি উদ্ধার ক’রে এনে তিনি দ্বারকার সকল বিশিষ্ট নাগরিকের সামনে ঘটনাটি তুলে ধরেন এবং দ্বারকার সকল বিশিষ্ট নাগরিকের দেওয়া রায় সত্ত্বেও শ্রীকৃষ্ণ স্যমন্তক মণি গ্রহণ করেননি, ফিরিয়ে দিয়েছিলেন সত্রাজিতকে। এখানেও প্রমাণ হয় বৃত্তি-প্রবৃত্তির কতটা উর্ধ্বে তিনি বিচরণ করেন এবং কেন তাঁকে মানবজাতির মুক্তির প্রাণপুরুষ বলা হয়!
কিন্তু ধর্ম ও ঈশ্বর বিশ্বাসী সাধারণ অজ্ঞ মানুষ, চূড়ান্ত বৃত্তি-প্রবৃত্তিতে ডুবে থাকা রিপু তাড়িত ভাঙ্গাচোরা মানুষ আজ কৃষ্ণকে নিয়ে শুধু 'বালগোপাল, বালগোপাল' খেলা-ই করে আর লাড্ডু, মালপোয়ার মধ্যে তাঁর জীবন দর্শন খুঁজে পায়!!!!!!!!! তাঁর বাণী "যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত........................সম্ভবামি যুগে যুগে" প্রয়োগ করে যত্রতত্র এবং যেকোনও ব্যক্তির মধ্যে তাঁর প্রতিফলন দেখতে পান!!!!!!!!!!!
আজ শুধু ভারাক্রান্ত হৃদয়ে এই টুকুই বলতে ইচ্ছে করে, "পঞ্চ ভুতের ফাঁদে, বহ্মা পড়ে কাঁদে"! হে ঈশ্বর তুমি আমাদের অজ্ঞানতাকে, অহংকারকে ক্ষমা ক'রো!
No comments:
Post a Comment