হঠাৎ করেই দুঃসময়ের মাঝে দুঃসংবাদটা এসেছিলো। সালটা ১৯৭৯। তারিখটা মনে নেই। শুধু মনে আছে সেদিন আমার পিতৃদেবের শ্রাদ্ধের দিন। শ্রাদ্ধবাসরে বড়দা বসে পিতৃশ্রাদ্ধের কাজ করছেন। ঘরে লোকজনে ভর্তি। আমরা পাঁচ ভাই ও একবোন। সবাই নানা কাজে ব্যস্ত। আমি সবার ছোটো। আমার তেমন কোনও কাজ নেই। বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজন যারা আসছে তাদের সাথে বসে কথা বলছি। এমন সময় পোষ্টম্যান এলো। আমার নাম ধ'রে ডাকলো। বললো, রেজিস্ট্রি চিঠি এসেছে। উঠে গেলাম। সই ক'রে খামটা নিলাম। খামের ওপরে দেখলাম কোম্পানীর নাম লেখা। খামটা নিয়ে এসে ঘরে বসলাম। কয়েকদিন আগে কর্মস্থলে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা মনে ভেসে উঠলো। খাম খুলে চিঠি হাতে নিয়ে হঠাৎ একটা ধাক্কা খেলাম। চোখের কোণটা খচখচ ক'রে উঠলো। ওদিকে পুরোহিতের উচ্চারিত মন্ত্র আর চিঠির কথাগুলি সব মিশে গিয়ে একাকার হ'য়ে গেল।
কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে উঠে চলে গেলাম পাশের ঘরে। চোখটা জলে ভরে উঠলো। একফোটা জল গড়িয়ে পড়লো। তাড়াতাড়ি চোখটা মুছে নিজেকে স্বাভাবিক ক'রে নেবার চেষ্টা করলাম যাতে কেউ কিছু বুঝতে না পারে। তারপর চিঠিটা খামে ঢুকিয়ে খামটা রেখে দিলাম বইয়ের ভাঁজে। বাড়িতে এটাকে স্বাভাবিক চিঠি আসার ব্যাপার মনে করে সবাই শ্রাদ্ধের কাজে ব্যস্ত হ'য়ে পড়লো। একদিকে শ্রাদ্ধের কাজ অন্যদিকে দুপুরের রান্না হ'য়ে চলেছে সঙ্গে চলছে অতিথি আপ্যায়ন। এসবের ভিড়ে আমিও সব ভুলে যাবার চেষ্টা করলাম। আস্তে আস্তে শ্রাদ্ধকাজ সম্পন্ন হ'লো, সম্পন্ন হ'লো দুপুরের খাওয়া দাওয়া। ধীরে ধীরে সবাই চলে গেলেও বাড়ির লোকেদের ভিড়ে আর ফিরে দেখা হয়নি চিঠিটা। রাত্রিবেলা যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়েছিল তখন আঁধার রাতে উঠে বইয়ের ভাঁজ থেকে চিঠিটা বের ক'রে ভালো ক'রে পড়লাম। তা'তে দেখলাম কর্মস্থলের ঘটনার কারণে আমাকে চাকরী থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে এবং শো কজ করা হয়েছে কেন আমাকে সাসস্পেন্ড করা হবে না তার উত্তর দিতে হবে পনেরো দিনের মধ্যে।
সারা রাত ঘুম হ'লো না। এই প্রথম বাবার অভাব অনুভব করলাম। ভালো ক'রে বাবার ফটোর দিকে চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগলাম মুখটা। মনে হ'লো কতদিন যেন বাবাকে দেখিনি। বাবার ছবির দিকে চেয়ে অনুশোচনায় চোখের জলে ঝাপসা হ'য়ে গেল দৃষ্টিটা। আর, সেখানে ভেসে উঠতে লাগলো ছোটোবেলার বাবার সঙ্গে সময় কাটানোর কত ছবি। আমার মাথার ওপর থেকে কে যেন ছাদটা কেড়ে নিল। আমি একা আর মাথার ওপর বিশাল এক শূন্যতা যেন আমাকে গ্রাস করতে আসছে। বাবার ছবিটা বুকে নিয়ে পড়ে রইলাম বিছানায়। নিজেকে নিসঙ্গ মনে হ'লো। বুঝতে পারলাম বাবা কেন বটগাছ।
প্রবি।
(লেখা ১০ই জুন, ২০২৩)
No comments:
Post a Comment