Powered By Blogger

Friday, October 7, 2022

প্রবন্ধঃ কার অনুসারিঃ ঠাকুর অনুসারী না বড়দা অনুসারী ( ১ )

গগনদার পোষ্টটা নিয়ে নিজেদের মধ্যে একটা বিতর্ক দানা বাঁধায় স্বাভাবিকভাবেই নজরটা গিয়ে পড়লো পোষ্টটাতে। দেখলাম এবং বুঝলাম বিতর্কের বিষয় একটা শব্দ চয়নকে ঘিরে তৈরি হয়েছে। শব্দটা ‘অনুসারী’। বিষয়ঃ “শ্রীশ্রীবড়দার অনুসারীরা আসল সৎসঙ্গী”। অনুসারী শব্দের মানে যদি করি তাহ’লে যেটা পায় তাহ’লো অনুসরণকারী, অনুযায়ী। তাহ’লে এখানে বিতর্কটা কোন জায়গায় ও কি নিয়ে? বিতর্কঃ আমরা ঠাকুর অনুসারী না বড়দা অনুসারী?  যদি বলা হয় আমরা ঠাকুর অনুসারী। তাহ’লে ভুল বা ঠিকটা কোথায়? ভুলের প্রশ্নতো এখানে আসেই না, অর্থহীন। আমরা শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের মন্ত্রশিষ্য, অনুগামী ও ভক্ত। ঠাকুরকেই আমরা কায়মনোবাক্যে অনুসরণ ক’রে চলি। অর্থাৎ দেহে, মনে ও কথায় অর্থাৎ সর্বোতভাবে ঠাকুরকেই শয়নে, স্বপনে ও জাগরণে মেনে চলার অর্থই হ’লো তাঁর অনুসারী হওয়া। এই অর্থে ঠাকুরের মন্ত্রশিষ্য মাত্রই অনুকূলচন্দ্রের অনুসারী তা’ সে ঠাকুর সৃষ্ট মূল কেন্দ্র ‘সৎসঙ্গ দেওঘর’-এর সঙ্গে যুক্ত শিষ্যবর্গ হ’ক বা অন্যান্য ব্যক্তি দ্বারা সৃষ্ট ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের নানা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত শিষ্যবর্গই হ’ক। আর এখানে বলে রাখা ভালো বৈধ শিষ্য বা অবৈধ শিষ্য এই বিষয় সম্পূর্ণ আলাদা আলোচনার বিষয়। এখানে এই আলোচনার ক্ষেত্রে এই প্রশ্ন প্রসঙ্গবহির্ভূত। এই বিষয়ে পরে আলোচনা করা যাতে পারে। আপাতদৃষ্টিতে দীক্ষিত-অদীক্ষিত আম জনতার কাছে, তামাম দেশবাসী ও বিশ্ববাসীর কাছে এককথায় ব্যাপক অর্থে সমস্ত শিষ্য মাত্রই ‘ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের অনুসারী ও সৎসঙ্গী কারণ বহির্বিশ্ব সৎসঙ্গের আভ্যন্তরীণ বিষয় সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল নন। 

কিন্তু গগনদা যেটা বলতে চেয়েছেন সেই বক্তব্য বিষয়কে যদি বর্তমান জটিল সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে একটু গভীরে গিয়ে পর্যালোচনা করা যায় তাহ’লে কি দেখা যাবে?    

গগনদা বলেছেন, শ্রীশ্রীবড়দার অনুসারীরা আসল সৎসঙ্গী। প্রথম কথা হচ্ছে ‘বড়দা অনুসারী’ বলতে কি বোঝানো হয়েছে? ‘বড়দা অনুসারী’ মানে বড়দা অনুসরণকারী। প্রশ্ন হচ্ছে, বড়দাকে অনুসরণ করবো কেন? আমার ইষ্ট বা মঙ্গল বা আদর্শ কে? ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র যদি আমার ইষ্ট বা মঙ্গল বা জীবন্ত আদর্শ হয় তাহ’লে বড়দাকে অনুসরণ করার কথা আসে কোথা থেকে? আমার গোল বা লক্ষ্য কে? ঠাকুর অনুকুলচন্দ্র না-কি বড়দা? ঠাকুর যদি আমার গোল হয় তাহ’লে ঠাকুরকে অনুসরণ ক’রে চলাই আমার জীবনের এক ও একমাত্র কর্ম। আমরা তো বড়দাকে অনুসরণ করার জন্য ঠাকুরের শিষ্যত্ব গ্রহণ করিনি, সৎসঙ্গের পতাকার তলায় আসিনি। এসেছি কি? তাহ’লে গগনদার এই কথার অর্থ কি? 

উপরিউক্ত কথাকে যদি মেনে নিই তাহ’লে গগনদার পোষ্টের বিরোধিতা ক’রে সুকৃতি সুন্দরদার বলা “আমরা সবাই ঠাকুর অনুসারী কেউই বড়দা অনুসারী ন’ই” কথাটা ঠিক। তাহ’লে গগনদার কথাটা কি ভুল বা বেঠিক? আসুন, দেখা যাক গগনদার বিশ্বাস “শ্রীশ্রীবড়দার অনুসারীরা আসল সৎসঙ্গী” কথাটার যদি পোষ্টমর্টেম করা যায় তাহ’লে কি পাওয়া যায়। গগনদার বক্তব্যকে যদি তত্ত্ব ও তথ্য সহযোগে সংশ্লেষণী ও বিশ্লেষণী দৃষ্টিতে সমুদ্রমন্থনের মত মন্থন করা যায় তাহ’লে সমুদ্রমন্থনে অমৃতের ভান্ড উঠে আসার মত ঠাকুরের ১৯৪৬ সালে দেশত্যাগের পরবর্তী সময়ের ঘটনাবলী ও ১৯৬৯ সালে দেহত্যাগের পরবর্তী সময়ে সৎসঙ্গ কেন্দ্রের উপর ও শ্রীশ্রীবড়দার উপর ঘটে যাওয়া দুঃখ ও অপমানজনক ঘটনাবলি মন্থনে গগনদার বক্তব্যের গভীরে অন্তঃসলিলার মত শ্রীশ্রীবড়দার জীবনের যে চলনামৃত বয়ে যাচ্ছে সেই অমৃতের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে যা’ কিনা স্বাভাবিকভাবেই আমাদের প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিতে পারে যে সত্যিই কি শ্রীশ্রীবড়দার অনুসারী হওয়া উচিত কি উচিত নয়।  

১৯৪৭ সালের দেশভাগের যে পটভূমি ব্রিটিশের চক্রান্তের ফলে সৃষ্টি হয়েছিল ভারতের মাটিতে তার আঁচ দেশভাগের অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিলেন ঠাকুর আর তার জন্য তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন তৎকালীন নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনায় দেশভাগকে রুখতে। অনেক আগে থেকেই তিনি তাঁর অতীন্দ্রিয় শক্তির বলে দেশভাগের চক্রান্ত ও সাম্প্রদায়িক সংঘাতের ভয়ংকর আঁচ পেয়েছিলেন এবং সেইমত তিনি চেষ্টা করেছিলেন দেশভাগ রুখতে ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার ফর্মুলাও তিনি দিয়েছিলেন তৎকালীন দেশবরেণ্য নেতৃবর্গকে কিন্তু কে কার কথা শোনে। সবাই সবার ধান্দায় মত্ত তখন। দেশভাগের চক্রান্তের ডামাডোলের মধ্যে তীব্র মানসিক চাপে দিন দিন ঠাকুরের শরীর খারাপ হ’তে থাকে; ফলস্বরুপ হাওয়া বদলের জন্য তাঁকে অন্যত্র নিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেন আশ্রমের বিশিষ্ট জনেরা।        

এই সময় থেকেই অর্থাৎ দেশভাগের চক্রান্ত  ও ঠাকুরের মানসিক যন্ত্রণা কিছু কপট ধান্দাবাজ সৎসঙ্গীকে উৎসাহিত ক’রে তোলে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায়। তারা বুঝতে পারে ঠাকুর শরীর খারাপের কারণে হাওয়া বদলের জন্য সপরিবারে দেশত্যাগ করলে এই শুনশান ঠাকুর পরিবারহীন বাংলার মাটিতে এই সুযোগে ঠাকুরকে আয়ের উপকরণ বানিয়ে ঠাকুরের নামে বেকুব আম সৎসঙ্গীকে বোকা বানিয়ে ইষ্টের সুড়সুড়ি দিয়ে মৌরসি পাট্টা জমিয়ে বসা যাবে। আর শুরুও হ’য়ে যায় সেই ‘মারি তো গন্ডার, লুটি তো ভান্ডার’ পরিকল্পনা। সব ভক্তরুপী শকুনরা অপেক্ষা করতে থাকে চেটেপুটে খাওয়ার কখন সেই মোক্ষম দিনটা আসবে। এইজন্য একদিকে শুরু হ’য়ে যায় তলে তলে নানারকম ষড়যন্ত্র। ঘুঁটি সাজানো শুরু হ’য়ে যায় পরিকল্পিতভাবে। আর অন্যদিকে হাওয়া বদলের কারণে দেওঘরের বুকে স্থানান্তরিত সৎসঙ্গের পরবর্তী কার্যধারা অত্যন্ত দ্রুতগতিতে চলতে থাকে ঠাকুরের নির্দেশে বড়দার প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণে। তখনই দূরদৃষ্টির অধিকারী ধান্দাবাজ সৎসঙ্গীরা শ্রীশ্রীবড়দার প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণের সময়কালে বুঝতে পেরে যায় ভয়ংকর কঠিন এক বাধার সম্মুখীন হ’তে হবে ষড়যন্ত্রকারীদের। আর সে ভয়ঙ্কর বাধার পাহাড় হ’য়ে সামনে দাঁড়াবে ঠাকুরের আত্মজ ও আদরের প্রথম ও জেষ্ঠ্য সন্তান এ যুগের হনূমান শ্রীশ্রীবড়দা। তাই ইষ্টস্বার্থপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অবিচল ‘মৃদুনি কুসুমাদপি, বজ্রাদপি কঠোরানি’ অর্থাৎ একদিকে ফুলের মত নরম, সুন্দর অন্যদিকে বজ্রের চেয়েও কঠিন এ হেন চরিত্রের অধিকারী শ্রীশ্রীবড়দার সঙ্গে আত্মস্বার্থপ্রতিষ্ঠাকারীরা সুবিধা করতে পারবে না জেনেই পরিকল্পিতভাবে ষড়যন্ত্রকারীদের শুরু হ’য়ে গেল ধীরে ধীরে সুকৌশলে শ্রীশ্রীবড়দা বিরোধী অভিযান। এই অভিযান শুধু বাংলাদেশের বুকেই সীমাবদ্ধ ছিল না খোদ দেওঘরের বুকেও ধীরে ধীরে ডালপালা বিস্তার লাভ করছিল এবং ছড়িয়ে পড়ছিল এ পার বাংলা তথা দেশ বিদেশের কতিপয় জায়গায়। 

১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল দেওঘরের বুকে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে হ’য়ে চলেছিল নতুন ক’রে আশ্রম  গড়ে তোলার রাজসূয় যজ্ঞ। সঙ্গে চলছিল ঠাকুরের হাজার হাজার বাণীর ঠাকুরের জীবদ্দশায় বই আকারে প্রকাশের অমানুষিক কাজ। ছিল ক্রমবর্ধমান ভক্ত ও দর্শনার্থীদের আসার চাপ। চলছিল দেশ বিদেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের আশ্রমে ঠাকুর দর্শনে আসা-যাওয়া। আরও কত কত কাজ হ’য়ে চলেছিল দেওঘর আশ্রমের বুকে। ঠাকুরের প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশে বড়দার তত্ত্বাবধানে ও নেতৃত্বে হ’য়ে চলেছিল একে একে ঠাকুরের স্বপ্ন পূরণ!!!! ১৯৪৬ থেকে ১৯৬৯ এই ২৩ বছর ঠাকুরের কুকুর হ’য়ে ঠাকুরের পায়ে পায়ে লেগে থেকে সৎসঙ্গ জগতের সকলের চোখের মণি ঘোর কলি যুগের হনূমান শ্রীশ্রীবড়দা মগ্ন হ’য়ে ছিলেন বাধার পাহাড়কে বলিষ্ট দু’হাতে সরিয়ে দিয়ে খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে অটল, অটুট, অচ্যুত, অস্খলিত থাকার ভীষ্মের মত ভীষণ প্রতিজ্ঞা বুকে নিয়ে ঠাকুরের ইচ্ছা, ঠাকুরের স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে এক কঠিন ব্রত, অবদমিত সংকল্প নিয়ে অটুট, অচ্যুত ও অস্খলিত মনোভাবে!     

এমনিভাবে যখন এগিয়ে চলেছিল সৎসঙ্গের আন্দোলন ‘নূতন বৃন্দাবন’ দেওঘরের বুকে নানা বাধা-বিপত্তি, ঝড়-ঝঞ্ঝা, বিপদ-আপদ ইত্যাদি অজস্র প্রতিকূল প্রতিবন্ধকতাকে মোকাবিলা করতে করতে সেই সময় একদিন ঠাকুর বেঁচে থাকাকালীন ঠাকুরের সামনে দিয়ে ঠাকুরকে প্রণাম ক’রে একদল কপট ধান্দাবাজ অসৎ ভক্ত ঠাকুরের ফটো মাথায় নিয়ে ‘বন্দে পুরুষোত্তমম’ ধ্বনি দিয়ে লম্ফ দিয়ে ঝম্প মেরে বেরিয়ে গিয়ে প্রমাণ করেছিল ইষ্টের জীবিত অবস্থায় ইষ্টস্বার্থরক্ষা ও ইষ্টস্বার্থপ্রতিষ্ঠার নামে আত্মস্বার্থরক্ষা ও আত্মস্বার্থপ্রতিষ্ঠার মিশন কি চতুরতায় চালিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় অর্থনীতিতে কালো টাকা ও সাদা টাকার সমান্তরালভাবে অন্তর্ভুক্তির মত! আর এটা সম্ভব হয় কখন? যখন ঠাকুরের বাকী অনুগামীরা ঠাকুর সম্পর্কে থাকে উদাসীন, অজ্ঞ, বেকুব, ভীতু ও দুর্বল এবং হয় অবিশ্বাসী, ফাঁকিবাজ, কপট, ক্যালাস, অতিবোদ্ধা ও অতিচালাক। সেই সময়টা চলছিল বড়দা বিরোধিতার চরম যুগ। ঠাকুরের কাছে চলেছিল ভন্ড, কপট কেষ্ট দাসের মত অর্থ, মান, যশের বদ্ধ পাগল, ভন্ড, কপট ভক্তদের শ্রীশ্রীবড়দার নামে নানা মিথ্যে অভিযোগ। ঠাকুরের মুখ চেয়ে ঠাকুরের স্বপ্ন পূরণে নিবেদিত প্রাণ হ’য়ে অসীম ধৈর্য ও সহ্য শক্তি বুকে নিয়ে সমস্ত কিছু মুখ বুঝে সহ্য করেছিলেন শেষ জীবনে ঠাকুরকে স্বস্তি, শান্তি দেওয়ার একমুখী বাসনায় ঠাকুরের আদরের বড়খোকা, আমাদের সৎসঙ্গ জগতের অতি প্রিয়, চোখের মণি এ যুগের অর্জুন শ্রীশ্রীবড়দা। দ্বাপর যুগে যেমন শ্রীকৃষ্ণের পরম ভক্ত অর্জুন লক্ষ্যে স্থির থেকে অটল অটুটভাবে প্রতিপক্ষকে ছারখার ক’রে দিয়েছিল শ্রীকৃষ্ণের আদেশকে মাথায় নিয়ে ঠিক তেমনি এ যুগে শ্রীশ্রীবড়দা রূপে অর্জুন পুনরায় আত্মস্বার্থপ্রতিষ্ঠাকারীদের ষড়যন্ত্রের নিবিড় জালকে ছিন্নভিন্ন ক’রে ঠাকুরের ‘আশ্রয় দাও প্রশ্রয় দিও না’ আদেশকে মাথায় নিয়ে ঠাকুরের মিশনের পতাকাকে উর্ধে তুলে ধ’রে সারা বিশ্বের দিকে দিকে ছড়িয়ে দিয়েছিল। দেহ ত্যাগের আগে ঠাকুর দেখে গেছিলেন, জেনে গেছিলেন, বুঝে গেছিলেন যে এই বিশাল সৎসঙ্গ প্রতিষ্ঠানের অভিভাবক হিসাবে তীব্র প্রতিকূল পরিস্থিতির দুরন্ত গতিতে ছুটে আসা শয়তানী ঝড়, তুফানকে উপেক্ষা ক’রে অনায়াস ভঙ্গীতে অবহেলায় অবলীলায় ইষ্টস্বার্থপ্রতিষ্ঠা ও ইষ্টস্বার্থরক্ষা বিরোধী শত্রু  শক্তির মোকাবিলা ক’রে একটা স্তম্ভের মত নিজের শক্তিতে অটল হ’য়ে দাঁড়িয়ে থাকবে তাঁর বড় আদরের বড়খোকা, ‘সৎসঙ্গ’ জগতের সবার অতি প্রিয় শ্রীশ্রীবড়দা। ঠাকুর সেদিন শ্রীশ্রীবড়দার পাহাড়ের মত টানটান হ’য়ে আকাশের দিকে মুখ তুলে সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকা চখা আঁখি আর অবয়ব দেখে এবং বজ্রের মত কঠিন ও কুসুমের মত কোমল হৃদয় ও মন দেখে শান্তিতে চিরনিদ্রায় চলে গেছিলেন এই ভেবে যে তাঁর অনেক দুঃখ, অনেক কষ্ট, অনেক যন্ত্রণা, নিন্দা, অপবাদ, অপমান, বদনাম, লাঞ্ছনা ও গঞ্জনার মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠা পারিপার্শ্বিক সহ বেঁচে থাকা ও বেড়ে ওঠার বড় সাধের বিশ্বজুড়ে এক ও একমাত্র পীঠস্থান বিশাল ‘সৎসঙ্গ’-কে রক্ষা করা ও আরো থেকে আরোতর ক’রে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ার উপযুক্ত বিশাল বলিষ্ঠ শক্তিশালী কাঁধ তিনি রেখে যাচ্ছেন দেওঘরের পুণ্যভূমিতে; রেখে যাচ্ছেন তাঁর মিশনকে সামনে রেখে, তাঁর রেখে যাওয়া আগামী মানব সভ্যতা গঠনের নীল নকশাকে মাথায় নিয়ে আগামী পৃথিবী রচনার সূচনার কারিগরকে। ঠাকুর একবার তাঁর প্রধান পার্ষদদের সকলকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আচ্ছা এই যে আমি হাজার হাজার না-কি বাণী দিয়েছি, এই সব কার জন্য?” তখন সেই সময়ের প্রধান পার্ষদ তথা ভক্তমন্ডলীবর্গ বলেছিলেন, “এই সমস্ত দেশবাসীর জন্য, বিশ্ববাসীর জন্য, মানবজাতির জন্য।“ ঠাকুর কিন্তু এই উত্তরে খুশী হননি। তখন তিনি পরমপুজ্যপাদ শ্রীশ্রীবড়দাকে দেখে ডেকে বলেছিলেন, “হ্যাঁরে বড়খোকা, এরা কি কয়?” বড়দা বললেন, “কি বাবা?” ঠাকুর বললেন, এই যে আমি এত হাজার হাজার না-কি বাণী দিয়েছি এই সমস্ত কার জন্য?” তখন বড়দা হাতজোড় ক’রে হাঁটুগেড়ে বসে বলেছিলেন, “এই সমস্ত বাণী আমার জীবনের জন্য।“ এই কথায় ঠাকুর সেদিন শিশুর মত উল্লসিত হ’য়ে সবাইকে বলে উঠেছিলেন, “দেখেন, দেখেন বড়খোকা কি কয়?, বড় খোকা কি কয়?” সেদিন ঠাকুর তাঁর আদরের বড়খোকা তথা সৎসঙ্গীদের শ্রীশ্রীবড়দার কথায় খুব খুশী হয়েছিলেন। আনন্দাশ্রু বেরিয়ে এসেছিল তাঁর সেদিন দু’চোখ দিয়ে। আমাদের সংসারেও এমন হয়;  যখন আমাদের সন্তানেরাও আমাদের মনের কথা বুঝে নিয়েই বলতে পারে আমরা কি চাইছি। আর সেই আনন্দ যে পেয়েছে সেই একমাত্র বুঝতে পারবে ঠাকুরের আনন্দের পারদের মাত্রা। কিন্তু সচরাচর আমাদের সংসারে তা’ হয় না। আর তাই ঠাকুর আর ঠাকুরের বড় আদরের বড়খোকার সম্পর্কের রসায়ন বোঝে সে সাধ্য কার? তিনি নিজে না বোঝালে, বোঝে কোন জন? আর বুঝতে গেলেও চাই সেই আধার, চাই পরমাত্মামুখী শুদ্ধ জীবাত্মা। কথায় আছে, ‘বোঝে, প্রাণ বোঝে যার।‘ সেই প্রাণ কই? যে প্রাণ শুনতে পায় ঠাকুরের ইচ্ছা পূরণের জন্য বড়দার অন্তরের নিরন্তর কান্না? যারা ‘মারি তো গন্ডার, লুটি তো ভান্ডার’ স্বপ্নে বিভোর হ’য়ে ঠাকুরের ‘দেশত্যাগ এবং দেহত্যাগ’-এর সঙ্গে সঙ্গেই লম্ফ দিয়ে ঝম্প মেরেছিল ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হ’য়ে অর্থ, মান, যশের অধিকারী হবে ব’লে তারা শুনতে পাবে ঠাকুরের ‘অনুকূল রাজ্য’ গঠনের কান্না? তারা শুনতে পাবে বড়দার ঠাকুরের স্বপ্ন বাস্তবায়িত করার অন্তর উৎসারিত কান্না? তারা শুনতে পায় মহাশ্মশানের ওপার থেকে ভেসে আসা শয়তান কিল্ভিসের মৃত্যুর মহাসঙ্গীত।

যাই হ’ক, এই হলেন আমাদের শ্রীশ্রীবড়দা। ঠাকুরের সমস্ত বলাগুলি, বাণীগুলি বড়দার জীবনের জন্য। শ্রীশ্রীবড়দার মধ্যেই মূর্ত হ’য়ে উঠেছে সমস্ত বাণী। সত্যানুসরণের জীবন্ত রূপ বা চলমান সত্যানুসরণ হলেন আমাদের সকলের চোখের মণি শ্রীশ্রীবড়দা। তাই বড়দার পক্ষেই সম্ভব হয়েছে ‘সত্যানুসরণ’-এর বিশ্লেষণ যা’ আর কারও পক্ষে সম্ভব হ’য়ে ওঠেনি। তাত্ত্বিক আমেজে ডুবে থেকে, বিশাল পান্ডিত্যের অধিকারী হ’য়ে, বই পড়ে বই হ’য়ে যে ‘সত্যানুসরণ’-এর ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ করা যায় না তা’ টের পেয়েছেন ঠাকুরের দীক্ষিত-অদীক্ষিত বহু পন্ডিতবর্গ। 

ঠাকুরের বাণী, ঠাকুরের ‘সত্যানুসরণ’ বুঝতে হ’লে ঠাকুরের প্রতি Surrendered   (আত্মসমর্পিত) হ’তে হয়। অর্থাৎ ঠাকুরের কথা অনুযায়ী “Surrender (আত্মসমর্পণ) করলাম মানে আমি তাঁকে নিলাম। কেন নিলাম তাঁকে? Only to love and serve him অর্থাৎ কেবলমাত্র তাঁকে ভালোবাসা এবং সেবার জন্য তাঁকে নিলাম।“ ঠাকুর বললেন, Surrender কথাটার মধ্যে আছে ‘Sur’ যার মানে হ’ল ‘above’ অর্থাৎ উপরে আর  ‘render’ কথার মানে হ’ল ‘to give’ অর্থাৎ দেওয়া। ঠাকুর বললেন, ইষ্টের উপরে নিজেকে ন্যস্ত করতে হয়, নিবেদন করতে হয় অর্থাৎ সর্বোতভাবে  ইষ্টের হ’তে হয়। 

এইরকমভাবে আমাদের সকলের প্রাণপ্রিয় শ্রীশ্রীবড়দা নিজেকে ঠাকুরের উপরে ন্যস্ত করেছিলেন, নিজেকে নিবেদন করেছিলেন অর্থাৎ সৎসঙ্গ জগতে শ্রীশ্রীবড়দা সর্বোতভাবে ঠাকুরের হ’য়ে উঠেছিলেন। শ্রীশ্রীবড়দা ঠাকুরকে কেবলমাত্র ভালোবাসা ও সেবার জন্য জীবনে গ্রহণ করেছিলেন। আর তাই শ্রীশ্রীবড়দার চোখমুখ দিয়ে, সর্বাঙ্গ দিয়ে ছিটকে বেরোতো ঠাকুরের প্রতি একান্ত অনুরাগ। শ্রীশ্রীবড়দার জগন্নাথের মত চখা আঁখির দিকে মুখ তুলে বেশিক্ষণ চেয়ে থাকতে পারতো না কেউ। 

এইরকম জীবন্ত চলমান ‘সত্যানুসরণ’ শ্রীশ্রীবড়দা আমাদের চোখের সামনে ছিলেন বলেই সমস্ত রকম শয়তানী কর্মকান্ডকে নিরাশি নির্মম ভাবে পায়ে দ’লে এগিয়ে চলা পৃথিবী জুড়ে ব্যাপ্ত বিশাল বিখ্যাত ‘সৎসঙ্গ’ প্রতিষ্ঠানকে আমরা আজ অনুভব করতে পারছি, উপলব্ধি করতে পারছি কিন্তু শ্রীশ্রীবড়দার মূল্যায়ন করতে পারছি না। কেন? এই কেন উত্তরই লুকিয়ে আছে গগনদার “শ্রীশ্রীবড়দার অনুসারীরা আসল সৎসঙ্গী” কথাটার মধ্যে।

ক্রমশঃ।

(লেখা ৭ই অক্টোবর' ২০১৭)

No comments:

Post a Comment