কালীপুজো ও দীপাবলী এখন সব মিলেমিশে একাকার হ'য়ে গ্যাছে। আর এই একাকার বহুবছর আগেই হ'য়েছে। তবে কালীপূজা আর দীপাবলির মধ্যে একটা সূক্ষ্ম তফাৎ আছে। সেটা হচ্ছে কালিপুজো মূলতঃ হিন্দু বাঙালিদের মধ্যে প্রচলিত আর দীপাবলি সমগ্র হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে হ'লেও এখন দেশ-কাল-ধর্ম ভেদে ভারতে দীপাবলি ছড়িয়ে পড়েছে সমগ্র মানবজাতির মধ্যে। আর এরকম বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক ধর্মীয় মেলবন্ধন স্থান ভেদে দেখা যায়। যদিও হিন্দু বাঙালি কালীপুজো উপলক্ষে অমাবস্যার রাতকে আলোর সাজে আবাহন করে। কিন্তু দীপাবলি উপলক্ষে যে আলোর সাজ সে সম্পর্কে উপলব্ধি বা ধ্যান ধারণার অভাব আছে বাঙালি হিন্দুর মধ্যে এখনও। আর, তার কারণও বাঙালি হিন্দুদের মূর্তিপূজা আর মূর্তিপূজার প্রতি প্রাচীন কাল থেকে এই উপলব্ধি বা ধ্যান-ধারণার অভাব বাঙালি হিন্দুদের তীব্র। প্রজন্মের পর প্রজন্ম জন্ম থেকে বড় হয়েছে মূর্তি পূজার উপর ভিত্তি ক'রে। তাদের কাছে জীবন্ত ঈশ্বর ভগবান রামের প্রতি আকর্ষণ তীব্র নয়। তীব্র কথাটা বললেও মনে হবে আকর্ষণ কিছুটা হ'লেও আছে। বলতে দ্বিধা নেই আকর্ষণ নেই বললেই চলে। আলোর সাজ অনেক কারণেই প্রচলিত হ'য়ে আছে ভারতে। আর এখন যে-কোনও কারণেই আলোর রোশনাই, বাজির ধূমধুমা হ'য়ে থাকে। কিন্তু মূলতঃ ভারতে আলোর সাজ অর্থাৎ দীপাবলীর উৎস ভগবান শ্রীশ্রীরামচন্দ্রের দীর্ঘ ১৪বছর বনবাস শেষে যুদ্ধজয়ের পর মা সীতাকে নিয়ে অযোধ্যায় ফিরে আসার পর প্রভু ও প্রভু পত্নীকে বরণ ক'রে নেবার অনুষ্ঠানকে স্মরণীয় ক'রে রাখার জন্য আলো দিয়ে সাজানো হ'য়েছিল, মুড়ে দেওয়া হ'য়েছিল গোটা অযোধ্যা আর তার রেশ ছড়িয়ে পড়েছিল ধীরে ধীরে অযোধ্যার সীমানা ছাড়িয়ে দূরে, বহুদূরে। কিন্তু এই রেশের প্রচন্ডতা বা তীব্রতা ছিল বা আছে মূলতঃ প্রভু রামের জন্মভূমি ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল জুড়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে। আর এগুলি হয়েছে আঞ্চলিক মানসিকতাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে। আর তাই বাংলায় কালীপূজার তীব্রতা দীপাবলির থেকে বেশী স্বাভাবিক কারণেই।
এই যে প্রভু রামকে নিয়ে আঞ্চলিক প্রাধান্যতার মানসিকতা অর্থাৎ না ক'রে পাওয়ার বিলাসিতার প্রাধান্যতা মূর্তি পূজার মত বৃদ্ধি পেয়েছে। বৃদ্ধি পেয়েছে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে মানব জীবনে পুরুষোত্তম প্রভু রামের জীবনকে আদর্শ হিসাবে ছড়িয়ে না দিয়ে, মানব জীবনে তাঁর গ্রহণযোগ্যতার প্রয়োজনীয়তাকে অনুধাবন না করিয়ে মূর্তি পূজার মত পূজার চল সৃষ্টি ক'রে তাঁর চলন পূজার পরিবর্তে ধূপ-ধুনো-আরতি-ফুল-চন্দনে প্রভু রামের চরণ পূজার প্রচলন করানোর ফলে। একইভাবে মূর্তি পূজার অন্তর্নিহিত অর্থকে অনুধাবন না ক'রে নিষ্ক্রিয় ভক্তি-ভালোবাসার মধ্যে দিয়ে কামনা-বাসনা পূরণ করার লোভে ও লক্ষ্যে মূর্তি পূজার রমরমা আজ বাংলা তথা গোটা ভারত জুড়ে আর তার ছোঁয়া সংক্রামক ব্যাধির মত ছড়িয়ে পড়েছে ও পড়ছে আনাচে-কানাচে বিশ্বজুড়ে!
মূর্তি পূজার অন্তর্নিহিত অর্থকে অনুধাবন করার কথা বলছিলাম। এক্ষেত্রে অনুধাবন বললেও অত্যুক্তি হ'য়ে যাবে। অনুধাবন করার ইচ্ছেই নেই, আছে তীব্র ফুর্তির মানসিকতা আর না ক'রে ফোকটে জমিদারী মানসিকতায় সবকিছু পাওয়ার বাসনা। এই তীব্র ফুর্তির মানসিকতা ও না ক'রে পাওয়ার মানসিকতা মূর্তি বা জীবন্ত ঈশ্বর উভয়কেই আয়ের উপকরণ বানিয়ে গড়ে উঠেছে। আর এই যুগ যুগ ধ'রে বংশ পরম্পরায় ছোট থেকে ঘরে-বাইরে এই জটিল দুর্বোধ্য পরিবেশে বড় হ'তে হ'তে বাঙালী আজ কাঙালী বাঙালীতে পরিণত হয়েছে।
তাই বাংলার বুকে আজ যুগ যুগ ধ'রে মূর্তি পূজার অন্তর্নিহিত অর্থকে বলাৎকার ক'রে সমস্যা জর্জরিত জীবনে দ্রুত সমস্যা মুক্ত হওয়ার জন্য এবং ধর্ম বেওসায়ীদের বেওসার রমরমা বজায় রাখার জন্য সাথে পূজাকে কেন্দ্র ক'রে আনন্দ লাভ করার জন্য, মজা নেওয়ার জন্য কিংবা নির্ভেজাল ফুর্তির উদ্দেশ্যে মূর্তি পূজা হ'য়ে চলেছে।
অন্যান্য পূজার মত কালী পূজার আরাধনাও ঠিক তেমনি। তাই হিন্দু বাঙালি ভয়ে বা ভক্তিতে হ'ক, ফুর্তিতে হ'ক, বুঝে বা না-বুঝেই হ'ক, পাওয়ার আশা নিয়ে বা নির্ভেজাল আনন্দ নিয়েই হ'ক এই কালীপূজার দিনে যেমন আলো দিয়ে অমাবস্যার অন্ধকার দূর ক'রে ঘর সাজায়, বাহিরকে করে আলোকিত ঠিক তেমনি দীপাবলিও তাই। তফাৎ শুধু জীবন্ত ঈশ্বর আর কল্পনার ঈশ্বর বা মূর্তি পূজার। জীবন্ত ঈশ্বর অর্থাৎ দীপাবলি যাঁকে ঘিরে সেই প্রভু রামের প্রতি হিন্দু বাঙালি বিশেষত অবাঙালীর ভক্তি-ভালোবাসা-বিশ্বাস-নির্ভরতা সবই সেই মূর্তির চরণ পূজার মত। আর সেই দীপাবলির রাতেও কালীপূজার মত আলোর সাজ আর আলোর বাজি ও শব্দবাজির মাতামাতিও একই কারণে একই অর্থ বহন করে। তাই কালীপূজার রাত আর দীপাবলির রাত আমার কাছে একইরকম প্রচলিত ভাবনা নিয়ে আবির্ভুত হয়, ধরা দেয় না অন্তর্নিহিত অর্থ নিয়ে! তার কারণ সমাজপতিরা তাদের কর্তব্য-দায়িত্ব পালন করেনি অথচ সমাজের মাথায় ব'সে পতিগিরি ক'রে গ্যাছেন। আর এই মনোভাব সমস্ত সম্প্রদায়ের সমস্ত সমাজপতি ও ধর্মীয় নেতাদের।
তাই জীবন্ত ঈশ্বর বারবার মানব শরীরে আসার পরেও এবং মূর্তি পূজা এবং জীবন্ত ঈশ্বরের মধ্যে স্পষ্ট তফাৎ ব্যক্ত করা সত্ত্বেও সমাজপতি বা ধর্মীয় নেতাদের কারণে তাঁরা বা তাঁদের বলাগুলি মূর্তিপূজা বা তথাকথিত গুরুপূজার নীচে চাপা পড়ে গ্যাছে। আর তার পরিণতি অবশ্যম্ভাবী ধ্বংস।
(লেখা ২৯শে অক্টোবর '২০১৯)
No comments:
Post a Comment