Powered By Blogger

Thursday, October 6, 2022

অভিজ্ঞতাঃ ইহে হ্যায় পাবলিক!

অষ্টমীর সন্ধ্যা! বাড়ির সামনে মাঠ, সেই মাঠে স্থানীয় ক্লাবের পুজো হচ্ছে। সন্ধ্যে হ'তে না হতেই আলো জ্বলে উঠেছে পুজো মণ্ডপে, রাস্তায়, রাস্তার দুপাশের বাড়িগুলোতে সাজানো আলোর মালাগুলি! অপূর্ব সুন্দর আলো ঝলমলে লাগছে চারপাশটা! মনে হয় এমন যদি হ'তো সারাটা বছর আলো ঝলমলে চারপাশ! ক'দিন পরেই অন্ধকারে ডুবে যাবে চারপাশ। রাস্তার আলো কোনোটা জ্বলবে, কোনোটা জ্বলবে না। মাইকে ভেসে আসছে সানাইয়ের সুর! ভেসে আসছে পুজোর মূল ভাব, মূল আনন্দ ধ'রে রাখে, বেঁধে রাখে, ছড়িয়ে দেয় প্রাণে প্রাণে যে সুর সেই ঢাকের মিষ্টি বোল, মিষ্টি সুর ঢাক কুড়াকুর, কুড়াকুর ঢাক কুড়াকুর আওয়াজ! আজকাল আর প্যান্ডেলের ভিতর ছাড়া ঢাকের আওয়াজ বাইরে শোনা যায় না, ভেসে আসে না। প্যান্ডেলের ভিতরও শোনা যায় কখনো সখনো! ঢাকের শব্দ শুনতে পারবো একাদশীর সকালে; যখন ঢাকি বাড়ি বাড়ি আসবে টাকা, জামা-কাপড় সংগ্রহের জন্য! বাকি সময় বড় কাপড়ের দোকানের সামনে সেজেগুজে দাঁড়িয়ে থাকা বিজ্ঞাপনের স্ট্যাচুর মত প্যান্ডেলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কাঁধে ঢাক নিয়ে ঢাকি দেখলেও দেখতে পাওয়া যায় কোনো কোনো প্যান্ডেলে! কেন যে ক্লাব কর্মকর্তারা একটু ভেবে দেখে না বিষয়টা! পুজো প্যান্ডেলে মাইকের ব্যবস্থা থাকে ঘোষণার জন্য সেখানে মাইকের সামনে সকাল সন্ধ্যে ঢাকিকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে ঢাক বাজালে সেই ঢাকের সুমধুর আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ে আকাশে বাতাসে! দোলা লাগে প্রাণের ভিতরে! পুজোর গন্ধ, পুজোর আমেজ সকালের ঠান্ডা হাওয়ার সাথে সাথে ভেসে আসে ঘরের ভিতরে! কেন যে করে না! কেন যে ভাবে না! পুজো হয়, প্যান্ডেল-লাইট হয়, ঠাকুর আসে, আসে ঢাকি কিন্তু ঢাকের আওয়াজ কানে আসার আগেই পুজো শেষ হ'য়ে যায়!!!! বছর আসে বছর যায় কিন্তু ভেবে দেখার সময় হয় না কারও!

যাক যে কথাটা বলতে বসেছিলাম সেই কথায় আসি। অষ্টমীর সন্ধ্যায় সেই পুজো প্যান্ডেলে  বিতরণ হবে খিচুড়ি ভোগ। কিন্তু সকালের বেয়াদপ বৃষ্টির জলে প্যান্ডেলের সামনের ফাঁকা জায়গায় জল জমে থাকায় প্রসাদ বিতরণে অসুবিধা দেখা দিয়েছে। ঘরে বসে চা পান করতে করতে একটু লেখালেখি করছিলাম। ভাইপো এসে বললো জেঠু বলেছে পার্কের গেটের তালাটা খুলে দিতে। জিজ্ঞেস ক'রে জানলাম খিচুড়ি ভোগ বিতরণে অসুবিধা দেখা দেওয়ায় পার্কের সামনের রাস্তায় লাইন ক'রে দাঁড়িয়ে খিচুড়ি বিতরণ করবে আর সেই খিচুড়ি নিয়ে হাতে হাতে নিয়ে সবাই পার্কে বসে বা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেয়ে নেবে। এ কথা শুনে আমি বললাম, পার্ক যে নোংরা হ'য়ে যাবে! খিচুড়ি আর কাগজের থালা ছড়িয়ে ছিটিয়ে একাকার হ'য়ে নষ্ট হ'য়ে যাবে পার্কের সৌন্দর্য! পার্কের পাশে নর্দমায় কাগজের পাতা ফেলে বন্ধ হ'য়ে যাবে নর্দমা! ক্লাবের ছেলেরা একথা শুনে বললো, আমরা কাল সকালে পার্ক পরিষ্কার ক'রে দেবো আর কেউ পার্কে কাগজ ফেলবে না, ডাস্টবিন দিয়ে দেবো সামনে সেখানে ফেলবে। প্যান্ডেলের সামনে মাঠে প্রচুর জল জমে গ্যাছে, জল বের করার ব্যবস্থা করেছি তবুও অবস্থা আয়ত্তে আসেনি এই অবস্থায় শিবুদা বললো তোমার কাছে পার্কের চাবি আছে তাই এলাম। পার্কের চাবি আমার কাছেই থাকে। সময়মত খোলা বন্ধ করি আমি; কখনও কখনও বা আমার বউ, আমার বড়দা শিবুদা ও বাড়ির অন্যান্যরা। পার্কের গায়ে আমার বাড়ি তাই পার্ক খোলা-বন্ধ ও দেখাশোনা করি নিজের ইচ্ছেয়। আমার ভালো লাগে! ছোট পার্ক। বাচ্চারা আসে, বাচ্চাদের অভিভাবকরা আসেন, বাচ্চারা খেলাধুলা করে আর তাদের বাবা-মা-কাকা-জেঠু-দাদাদাদীরা পার্কের বেঞ্চে বসে থাকেন তারপর খেলা হ'য়ে গেলে যে যার মত চলে যায়। সেখানেও কেউ গেট খুলে রেখে চলে যায়, কেউ পাঁচিল টপকে আসে যায়, বাচ্চাদের মত বড়রাও টপকায়, বাচ্চাদের দোলনায় বড়রাও কখনও কখনও দোল খায়, কোলের বাচ্চাকেও দোল খাওয়াবার জন্যে মায়েরা নিজেরাও বসে পড়ে দোলনায়, দোলনা ভেঙে পড়ে যাবার ভয় থাকে, দল বেঁধে হুড়মুড় ক'রে উপড়ে উঠে যায় বাচ্চারা স্লিপারে স্লিপ খাবে ব'লে, সেখান থেকে ধাক্কাধাক্কিতে নীচে পড়ে যাবার সম্ভাবনা প্রবল! বড় বল নিয়ে আসে পার্কে বাচ্চারা খেলবে ব'লে, বলের ধাক্কা গিয়ে লাগে পার্কের সাজানো লাইটে, লাইট খারাপ হ'তে পারে! হয়ও! পার্কের পরিবেশ ভালো থাকলে বাচ্চারা ও বাচ্চাদের মায়েরা সেই পার্কে আসে। তাই পার্কের পরিবেশ যাতে ভালো থাকে সেদিকে পড়শীর দায়িত্বেই খেয়াল রাখি এই যা মাত্র! কখনো কখনো দুপুরে, রাতে পার্ক যখন বন্ধ থাকে তখন পাঁচিল টপকে ঢুকে পড়ে ছেলে ছোকরার দল। আড্ডা মারে, দোলনায় দোল খেতে খেতে সিগারেট-বিড়ি খায়, কখনো বা গাঁজা ভরে মনের সুখে সুখটান দিতে থাকে, কোলড্রিঙ্কস (?) খায়, নানারকম ভঙ্গিতে সেলফি তোলে! সঙ্গে কারও আবার সঙ্গিনীও থাকে! কখনও কখনও রাতে (১০টা) বাচ্চা নিয়ে হাজির হ'য়ে যায় কিছু আধুনিক পুরুষ! পাঁচিল টপকে ঢুকে পড়ে পার্কে অবলীলায়, অবহেলায় বাচ্চাদের দোলনা চড়াবে ব'লে! বললে বলে, অফিস কাছাড়ির জন্য আসতে পারে না তাই রাতে আসে! অদ্ভুত যুক্তি! কে কখন সময় পাবে, কে কখন আসবে তার জন্য পার্ক সবসময় খোলা রাখতে হবে তা নাহ'লে পাঁচিল টপকাবে বাচ্চাদের বাবারাও!!!

এই অবস্থায় বাচ্চারা যাতে পাঁচিল না টপকায়, ঝগড়াঝাঁটি না করে, বড়রা যাতে দোলনা না চড়ে, স্লিপারে না ওঠে, পার্কে যেন কোনও প্যাকেট, ঠোঙা না ফেলে, পার্ক যেন নোংরা না করে, পার্কে ঢোকা ও বেরোনোর সময় গেট সবসময় যেন বন্ধ রাখে, বাচ্চাদের পার্কে বড় ছেলেমেয়েরা যেন অশালীন আচরণ না করে, পার্কের বেঞ্চিতে না ঘুমোয়, বিড়ি-সিগারেট-গাঁজা-মদ পার্কে নিষিদ্ধ, নির্দিষ্ট সময় ছাড়া পার্কে যেন না আসে ইত্যাদি ইত্যাদি বোঝাতে বোঝাতে প্রাণ ওষ্ঠাগত! কতজনের কাছে যে খারাপ হ'য়ে গেলাম তার হিসাব নেই! যারা অশালীন আচরণকারী, যারা নেশা করে তাদের তো চক্ষুশূল কিন্তু যারা সাধারণ আম আদমী তারাও আমার উপর বিরক্ত গেট বন্ধ থাকা ও না থাকা অবস্থায় পাঁচিল টপকানোর কারনে, দোলনায় ও স্লিপারে চড়ায় বাধা পাওয়ায়!!!!! বিরক্ত আরও কিছু পাবলিক যারা পার্কে গরমকালে পার্কের ঘাসে জল দেওয়ার জন্য যে কল লাগানো হয়েছে সেই কলে স্নান করে, সেই কলে ব্যক্তিগত গাড়ি ধোওয়ার কাজ করে, তারা। সেখানে আগে কোনো কল ছিল না, কল লাগানোর পরে সেখানে সবসময় জলে ভিজে থাকে, জল জমে থাকে আর সেই জলে পার্কে দৌড়ে আসা বাচ্চারা পা পিছলে প'ড়ে যায় আর তাই বাধ্য হ'য়েই আমায় তাদের বিরুদ্ধে বলতে হয় পার্কের পরিস্থিতির গগুরুত্ব বোঝাতে। আর তার ফলে তাদের বিরক্তির কারণ আমি। যাক বাচ্চাদের কথা ভেবে ওইসব গায়ে লেগে না আমি।

তবুও আনন্দ হয় বাচ্চারা যখন আমার কথা শোনে, নতুন বাচ্চা যারা আসে তাদের পুরোনো যারা তারা ব'লে দেয় গেট বন্ধ রাখা, পাঁচিল না টপকানো ইত্যাদি অনুশাসনের কথা! না শুনলে, ঝগড়াঝাঁটি করলে এসে রিপোর্ট করে! এমনকি আশ্চর্যের বিষয় পার্কে কয়েকবার বাচ্চারা টাকাও পেয়েছে সেই টাকা এনে হাতে তুলে দিয়েছে আর আমি অবাক হ'য়ে ভেবেছি এদের সরলতার কথা! ভেবেছি সময় নামক চাবুকের কড়া আঘাতে এই সরলতা যখন ভেঙে চুরমার হ'য়ে যায় তার জন্য দায়ী কে! কে দায়ী! সমাজ!? সমাজ ব্যবস্থা!? দেশ!? দেশের নেতৃত্ব!? বাবা-মা!? বাড়ির পরিবেশ-শিক্ষা!? 

যাই হ'ক, তারপরে সেই টাকা দিয়ে তাদের লজেন্স, বিস্কুট কিনে এনে দিলে তারা সবাই মিলেমিশে ভাগাভাগি ক'রে খেলো, তাই দেখে মনটা ভরে গেলো আনন্দে! আরো ভালো লাগলো বাচ্চারা সেই বিস্কুট, লজেন্সের কাগজ যাতে পার্কে না প'ড়ে থাকে সেদিকেও নজর রেখেছে! মন বলল, বাচ্চাদের যা শেখানো যায় প্রায় ক্ষেত্রে বাচ্চারা তাই শেখে এবং তা ধ'রে রাখতেও পারে যদি ক্রমবর্ধমানতা বজায় রাখা যায় আর জন্মে যদি খুঁত না থাকে।

আবার ফিরে আসি অষ্টমীর সন্ধ্যায়। পার্কের গেট খুলে দেবার জন্য যখন ক্লাবের পক্ষ থেকে অনুরোধ এলো তখন তাৎক্ষণিক পরিস্থিতি বিচার ক'রে এবং ক্লাবের ছেলেদের পার্ক পরিষ্কার ক'রে দেবার কথায় গেট খুলে দিলাম। নিমেষের মধ্যে পার্ক ভরে গেল মানুষে। প্রত্যেকের হাতে অষ্টমী ভোগ। কাগজের থালায় দেওয়া হয়েছে সেই ভোগ। পার্কের বেঞ্চে বসে, পার্কের পাঁচিলের উপর থালা রেখে সবাই প্রসাদ খাচ্ছে। আমি ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম আর সকলকে অনুরোধ করতে লাগলাম পার্কে ও পার্কের বেঞ্চিতে, পাঁচিলের উপরে কেউ যেন পাতা, খিচুড়ি না ফেলে। যতটা সম্ভব চেষ্টা করলাম সবাইকে বোঝাতে, একটা শৃঙ্খলার চাপে রাখতে। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে সবাইকে যাদের খাওয়া হ'য়ে গেছে তাদের বললাম, দেখিয়ে দিলাম নির্দিষ্ট জায়গায় খাওয়া শেষ হ'লে পাতা ফেলতে। ক্লাবের ছেলেরাও একইভাবে ব'লে চলেছে। যেখানে প্রসাদ বিতরণ করা হচ্ছে সেইখানেই ক্লাবের ছেলেদের বললাম প্রসাদ দেওয়ার সময়ই কোথায় পাতা ফেলতে হবে তা ব'লে দিতে। সেইভাবে তারা তা বললো। এইভাবে অনেকক্ষন চলার পর একটু ভিড় হালকা হ'লে আমি ঘরে চলে এলাম। তারপরে বেশ কিছুক্ষণ পর প্রসাদ বিতরণ পর্ব শেষ হ'লে আমার স্ত্রী আমায় এসে জানালো পার্কে আর কেউ নেই কিন্তু পার্কের সামনে নর্দমার অবস্থা খারাপ! আমি পার্কে তালা দেবার জন্য আবার ঘর থেকে বেরোলাম। পার্কের সামনে গিয়ে দেখলাম পার্কের সামনে নর্দমায় স্তূপ হ'য়ে প'ড়ে রয়েছে এঁটো পাতা, রাস্তায় ও পার্কে ছড়িয়ে রয়েছে যত্রতত্র! 

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি আর ভাবছি যতক্ষণ গেটের সামনে দাঁড়িয়েছিলাম, পার্কের ভিতরে ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম আর সবাইকে বলছিলাম কোথায় পাতা ফেলতে হবে ততক্ষণ শৃঙ্খলা ছিল অটুট (তার মধ্যেও ফাঁকতালে একটা পাতা নর্দমায় ফেলেছে) কিন্তু স্থানত্যাগ করার পরমুহূর্তে এই অবস্থা!? শুধু মনে মনে বললাম, ইয়ে হ্যায় পাবলিক!

যাই হ'ক আজ নবমীর সকাল, দেখলাম কথা রেখেছে ক্লাব। ক্লাবের নাম ভদ্রকালী শিবাজী স্পোর্টিং ক্লাব। আমার বড়দা অর্থাৎ ক্লাবের সবার প্রিয় শিবুদা ক্লাবের সদস্যদের (নবীন, তিনু ইত্যাদি) নিয়ে পার্কের পূর্বের অবস্থা থেকেও আরো ঝকঝকে ক'রে দিয়েছে পার্ক, পার্ক সন্নিহিত রাস্তা ও নর্দমা! 

দাঁড়িয়ে দেখতে দেখতে মনে পড়ে গেলো পরম প্রেমময় শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের কথা যা প্রতিমুহূর্তে ঠাকুরবাড়ি থেকে আচার্যদেব শ্রীশ্রীঅশোকদাদা ও শ্রীশ্রীবাবাইদাদা মনে করিয়ে দিচ্ছেন: 

যার থেকে যে জিনিস ব্যবহারের জন্য নেব তা যেন ফিরিয়ে দেওয়ার সময় আরও সুন্দর, আরও পরিষ্কার ক'রে ফিরিয়ে দেওয়া হয়!

তারই বাস্তব রূপ দেখলাম এই পার্কে! ধন্য শিবাজী স্পোর্টিং ক্লাব! ধন্য! আমাকে দেওয়া কথা রাখার জন্য! পরমপিতা ক্লাবের সবার মঙ্গল করুক!

(লেখা ৭ই অক্টোবর' ২০১৯)

No comments:

Post a Comment