Powered By Blogger

Friday, October 25, 2024

প্রবন্ধঃ বাংলাদেশের চট্টগ্রামে জে এম সেন হলের দূর্গাপুজো মন্ডপে ইসলামী সঙ্গীত পরিবেশন ও সনাতনী বিতর্ক। (পর্ব ১)

বাংলাদেশের চট্টগ্রাম রহমতগঞ্জের যাত্রামোহন সেন হল অর্থাৎ জে.এম.সেন হলে দূর্গা পূজার মঞ্চে চট্টগ্রাম পূজা উদযাপন পরিষদের আমন্ত্রণে দূর্গামঞ্চে মুসলিম ভাইয়েরা সঙ্গীত পরিবেশন করে। কেউ বলছে পূজার মঞ্চে গজল পরিবেশন হয়েছিল। কেউ বা বলছে দেশাত্মবোধক গান, কেউ বা বলছে ইসলামিক সংগীত পরিবেশন করা হয়েছিল ও ইসলামি দাওয়াত দেওয়া হয়েছিল। কেউ কেউ বলছেন 'গ্রামের নওজোয়ান, হিন্দু মুসলমান' এই গানটা পরিবেশন হয়েছিল। কেউ কেউ বলছেন, যেটা দেখানো হচ্ছে ভিডিওতে সেটা ব্যাকগ্রাউন্ডে লাগিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়েছে৷ কেউ বলছেন ফেব্রিকেটেড ভিডিও সোশ্যাল সাইটে ছেড়ে দিচ্ছেন সেটার তদন্ত হওয়া উচিত। কেউ বলছেন, পূজা কমিটি এমন সম্প্রীতির নাটক বাদ দিয়ে প্রকৃত ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলুন তাতেই সবার মঙ্গল হবে! কেউ বলছেন, বেশ কিছুমাস আগে চট্রগ্রমের সীতাকুন্ডে চন্দ্রনাথ ধামে আজান দেওয়া হয়েছিলো! এটি একটি স্পষ্ট ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত ও হিন্দু ধর্মকে এভাবে পরিকল্পিতভাবে অসম্মান করার চক্রান্ত।

এই সঙ্গীত পরিবেশন করা নিয়ে বাংলাদেশে সনাতনীদের আবেগ নিয়ে নোংরামি করা হয়েছে বলে তীব্র বিতর্ক দানা বেঁধেছে। দাবী উঠেছে জে এম সেন হলের সকল আয়োজন বয়কট করার ও পূজা কমিটিকে সনাতনী সমাজ থেকে আজীবন বহিষ্কারের ঘোষণা করার ও গ্রেপ্তার ক'রে আইনের আওতায় আনার। দাবী উঠেছে চট্টগ্রাম পূজা উদযাপন পরিষদকে প্রকাশ্যে এসে ক্ষমা চাইতে হবে এবং পুজায় সনাতনী সংগীত, নৃত্য ও গীতাপাঠ ব্যতীত অন্য কিছু গ্রহণ যোগ্য হবে না। দাবী উঠেছে চট্টগ্রাম পূজা উদযাপন পরিষদের স্টেজে কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য হবে না। দূর্গাপূজার মঞ্চে এই ঘটনার জেরে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে।

এই নিয়ে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে উঠেছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।

১) পূজা মন্ডমে গান গাইতে মুসলিম শিল্পী নিতে হবে কেন?

২) বাংলাদেশে হিন্দু শিল্পীর অভাব হয়ে গেছে?

৩) দূর্গাপুজাতে কেন ইসলামিক গান করলো? ইসলামিক অনুষ্ঠানে কি হিন্দুদের গীতা পাঠ হয়? কেন সনাতন ধর্মকে অপমান করা হলো?

৪) পূজার প্যান্ডেলে উঠে ইসলামি দাওয়াত না দিয়ে সরাসরি জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করার ব্যবস্থা করা হ'ক।

৫) গান,বাজনা হারাম, পূজা হারাম, প্রতিমা দেখা হারাম, তাহলে তারা কেন ওখানে গেল? ওখানে ইবাদত করতে গেছে অর্থাৎ উপাসনা করতে গেছে? হিন্দুরা কোনও মসজিদে যায় না। ওরা কেন আসলো? আর, পূজা কমিটি এমন সম্প্রীতির নাটক বাদ দিয়ে প্রকৃত ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলুন। তাতেই সবার মঙ্গল হবে।

৬) বাংলাদেশ সনাতন জাগরণ মঞ্চের আয়োজনে মহা অষ্টমীতে নগরীর জে.এম.সেন হলে আগের দিনের ইসলামী গজলের পরিবর্তে ভক্তিমূলক গান ভজন পরিবেশন করেন ইসকন।

এই 'আমরা যাই না, ওরা কেন আসলো' প্রসঙ্গে "গ্রামের নওজোয়ান, হিন্দু মুসলমান' গানের কথাগুলি মনে পড়ে গেল। যা বৃটিশ পূর্ববর্তী অতীত অখন্ড ভারতকে মনে পড়িয়ে দিল।

শাহ আব্দুল করিমের হৃদয়স্পর্শী গান, 'আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম।'

আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম
আমরা আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম
গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান
মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদি গাইতাম
মিলিয়া বাউলা গান সারি গান গাইতাম
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম
আমরা আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম

হিন্দু বাড়িতে যাত্রা গান হইত
নিমন্ত্রণ দিত আমরা যাইতাম
জারি গান, বাউল গান
আনন্দের তুফান
গাইয়া সারি গান নৌকা দৌড়াইতাম
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম
আমরা আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম

বর্ষা যখন হইত,
গাজির গান আইত,
রংগে ঢংগে গাইত
আনন্দ পাইতাম
কে হবে মেম্বার,
কে বা সরকার
আমরা কি তার খবরও লইতাম
হায়রে আমরা কি তার খবরও লইতাম
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম।
করি যে ভাবনা
সেই দিন আর পাব নাহ
ছিল বাসনা সুখি হইতাম
দিন হইতে দিন
আসে যে কঠিন
করিম দীনহীন কোন পথে যাইতাম
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম….

আসুন আমরা আবার আলোচনায় ফিরে যায়।

ঠিক তেমনি মুসলিম সমাজের পক্ষ থেকে প্রশ্ন উঠেছে।

১) দুর্গা পূজায় ইসলামিক বিপ্লবের গান গেয়ে যারা ইসলাম ধর্ম কে প্রশ্নবিদ্ধ করছে তারা ইসলামের দুশমন, তারা ধর্ম ব্যবসায়ী। যারা এই নোংরা কাজে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় এনে কঠোর থেকে কঠোর সাজা দেওয়া হোক, যাতে ভবিষ্যতে আর কোন ধর্ম ব্যবসায়ী এমন জঘন্য কাজ করার মতো সাহস না পাই। ইসলাম সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম, ইসলাম মুসলমানদের আবেগ,ভালোবাসা, অনুভুতি সহ অনেক কিছু, তাই যারা ইসলাম কে ছোট করবে তাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করা হোক।

২) ইফতার প্রোগ্রামে এসে কেউ কীর্তন গেয়ে গেলে নিতে পারবেন? এই যে অন্য ধর্মাবলম্বীদের কে যে ট্রমা এর মধ্যে ফেলছি সেটা তাদের জুতায় পা দিয়ে দেখেন।

আবার কেউ কেউ বলেছেন,
১) চট্টগ্রাম মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের অনুষ্ঠানে ইসলামি দাওয়াত সংগীতের অনন্য পরিবেশনা।

২) পুজোয় গজল শুনলাম। দোষ তো সম্মানিত দর্শকদের যারা বসে হাতে তালি দিচ্ছিল।

এসব শুনতে শুনতে মাথাটা গুলিয়ে যাচ্ছিলো। Many men many mind, অনেক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট' প্রবাদের কথা মনে পড়ে গেল। মনের মধ্যে একসঙ্গে অনেক প্রশ্নের ঝড় উঠে গেল।

১) পুজো মন্ডপে মুসলিম শিল্পী আনা যাবে না? অন্যায়? পাপ? নাকি ফতোয়া? শিল্পীদের মধ্যে বিভেদ? একে অপরের ধর্মীয় উৎসবে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে, মানবতার উদ্দেশ্যে গান গাইতে পারবে না? সেটা অপমান? ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে, মানবতার উদ্দেশ্যে গাওয়া গানেও অপমান? বিভাজন? ধর্মকে প্রশ্নবিদ্ধ করে? গান গাওয়া নোংরা কাজ? এক ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মের মানুষের আরাধনার জায়গায় ঈশ্বর বা আল্লা বা গডের উদ্দেশ্যে গান গাওয়া অপরাধ? একে অপরের দুশমন? তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে? এর জন্য কোনও ধর্মমত ছোটো হয়? কোন ধর্মমত বড় আর কোন ধর্মমত ছোটো? সবই তো ঈশ্বরের প্রেরিত দূতের মত, যুগ অনুযায়ী মত। এই গান গাওয়ার আমন্ত্রণ জানানো ও গান গাওয়ার জন্য গ্রেপ্তার করতে হবে? প্রত্যেক সম্প্রদায়ের পালন করা ধর্মে আলাদা আলাদা ঈশ্বর আছে নাকি? প্রত্যেক সম্প্রদায়ের সৃষ্টিকর্তা আলাদা আলাদা? বিশ্বে মোট ধর্মের সংখ্যা ৪,৩০০টি। তাহ'লে কি এই প্রতিটি ধর্মের মানুষের জন্য আলাদা আলাদা ৪,৩০০টি সৃষ্টিকর্তা?

২) ধর্মান্তরের কথা উঠে এসেছে এই প্রসঙ্গে। এককথায় সৃষ্টিকর্তার দরবারে ধর্ম্মান্তর পাপ ও অধর্মীয় অনুশীলন।

৩) কারও কারও মতে ইসলাম ধর্মে গান,বাজনা হারাম, পূজা হারাম, প্রতিমা দেখা হারাম। অথচ পুজোর মঞ্চে যারা ঈশ্বরের গান বা মানবতার গান যে গান পরিবেশন করুক না কেন তারা তো ইসলামের অনুসারী হয়েও পরোক্ষে 'হারাম' প্রশ্নের বিরোধীতায় করেছেন। তাই নয় কি?
আর, দূর্গাপুজোর মন্ডপে ইসলামী গান গাওয়ায় জে, এম, সেন হলের কমিটির বিরুদ্ধে সম্প্রীতির নাটক বাদ দিয়ে প্রকৃত ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার কথা উঠেছে। একেবারে সঠিক কথাটা সঠিক সময়ে উঠে এসেছে। কিন্তু আমার জিজ্ঞাস্য, প্রকৃত ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার মধ্যে সম্প্রীতির কথা আছে কিনা। সম্প্রীতি আলাদা আর ধর্মীয় অনুশাসন আলাদা? ধর্মীয় অনুশাসন বলতে কি বোঝায়? কিসের বার্তা পৌঁছে দেয় মানুষের মধ্যে? মানবতার বার্তা, মিলনের বার্তা নাকি অমানবিক ও বিচ্ছেদের বার্তা পৌঁছে দেয় ধর্মীয় অনুশাসন? এই প্রশ্নে কি ভেবে দেখার এখনও সময় আসেনি সনাতন ধর্মের মানুষদের সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষের মনে?

৪) অষ্টমী পুজোয় জে, এম, সেন হলে আগের দিনে গজল পরিবেশনের উত্তরে ভজন পরিবেশন করেছেন ইসকন। মনে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, গজল গান কি হিন্দু ধর্মে বা সনাতন ধর্মে নিষিদ্ধ? যদি নিষিদ্ধ হয় তবে কেন নিষিদ্ধ? কোন যুক্তিতে নিষিদ্ধ? আর, ইসকন ভজন পরিবেশন করেছেন আনন্দের কথা। ভজন বলতে ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক ধারণা সহ যেকোন ভক্তিমূলক সঙ্গীতকে বোঝায়, বিশেষ করে ভারতীয় ধর্মের সঙ্গীত। ভজন শব্দের অর্থ শ্রদ্ধা। আর গজল? গজল আরব থেকে এর উৎপত্তি হলেও ফার্সি ভাষায় এটি বিশেষ বিকাশ লাভ করে। পরবর্তীতে উর্দু ভাষায় এটি সমধিক জনপ্রিয়তা পায়। আরবি, ফার্সি, পশতু, উর্দু ছাড়াও হিন্দি, পাঞ্জাবী, মারাঠি, বাংলা এমনকি ইংরেজিতেও গজল লেখা হয়। তা' গজল সঙ্গীতের মধ্যে দিয়ে ভজনের মতো ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক ধারণা সহ ঈশ্বরের কাছে পৌঁছনো যায় না? গজল ভক্তিমূলক সঙ্গীতকে বোঝায় না?

৫) যাই হ'ক, ইসকনের প্রতিষ্ঠাতা স্বামী প্রভুপাদ ও অমোঘ লীলা দাসের পরমপিতা পুরুষোত্তম শ্রীশ্রীঠাকুর রামকৃষ্ণ এবং তাঁর প্রধান ভক্ত শ্রীশ্রীবিবেকানন্দকে যখন চরম অপমান ও অশ্রদ্ধা করেছিলেন তখন সনাতন হিন্দু ধর্মের অস্তিত্বে আঘাত লাগেনি, অপমান মনে হয়নি? তখন সনাতন ধর্মের প্রবক্তারা আজকের মতো এরকম প্রতিবাদ করেছিলেন? অথচ আজ তাঁরা ভজন পরিবেশন করছেন ব'লে আহ্লাদে একেবারে গদগদ হ'য়ে গজলের বিরোধীতা ক'রে বসছেন একশ্রেণীর সনাতনী মানুষ।
৬) আর, যখন স্বঘোষিত সনাতনীরা The greatest phenomenon, The greatest wonder of the world বিশ্বজুড়ে সমস্ত সম্প্রদায়ের প্রায় ১০কোটিতে পৌঁছে যাওয়া ভক্তকূলের আরাধ্য পুরুষোত্তম পরমপিতা পরমপ্রেমময় শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রকে, তাঁর সৃষ্ট 'সৎসঙ্গ' প্রতিষ্ঠানকে, সৎসঙ্গীদের ফেসবুকে, ইউটিউবে দিনের পর দিন অপমান লাঞ্চনা করেন ও ক'রে চলেছেন তখন সেটা অপরাধ, অন্যায় নয়? তখন সেটা শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রকে, তাঁর সৃষ্ট প্রতিষ্ঠান সৎসঙ্গকে এবং কোটি কোটিকে সৎসঙ্গীকে অপমান নয়? প্রতিবাদ করেছিলেন স্বঘোষিত সনাতনীদের বিরুদ্ধে প্রকৃত সনাতনীরা? কেন এই বৈষম্য?

এবার শেষ কথা ব'লে আমার বক্তব্য শেষ করছি। এই ঘটনার পিছনে যদি কোনও দুরভিসন্ধি থাকে, যদি গভীর গোপন কোনও চক্রান্ত থাকে, দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে অজ্ঞানতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগাবার চক্রান্ত থাকে সেটা সম্পূর্ণ প্রশাসনিক ব্যাপার, রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও সুরক্ষার ব্যাপার।

কিন্তু যদি তা' না হ'য়ে থাকে তাহ'লে বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের শিশুদের ভবিষ্যৎ পৃথিবীকে বাসযোগ্য ক'রে যাবার জন্য যুগোপযোগী আদর্শের সংস্পর্শে ধর্মীয় আমূল সংস্কারের প্রয়োজন।
( লেখা ১৬ই অক্টোবর'২৪)

No comments:

Post a Comment