মানুষ শব্দের অর্থ আমরা কেউ জানি না। আর জানলেও জানি মান ও হুঁশ সম্বলিত যে উন্নত জীব সেই মানুষ। আরও প্রাঞ্জল ক'রে বললে বলতে হয় যার মান আছে ও মান সম্বন্ধে হুঁশ আছে সেই মানুষ। আর মান বলতে সম্মান বা মান-অপমান বুঝি। মান-অপমান বোধ বুঝি। আর এই বোধ সম্পর্কে আমার হুঁশ আছে কিনা তা বুঝি। কেউ কেউ এরও গভীরে যান। মান মানে ওজন, আমার যোগ্যতা, আমার মাত্রা জ্ঞান বা বিরতি সম্পর্কে জ্ঞান। আর সেই জ্ঞান সম্পর্কে হুঁশ। এর বেশি কিছু না। আর অর্থ জানলেও জানা অর্থ অনুযায়ী আমার জীবন পরিচালিত হয় না। হ'লেও সেই ভারসাম্য নেই।
এছাড়া শ্রীশ্রীআচার্যদেব শ্রীশ্রীঠাকুরের আলোকে আরও বিস্তৃত ব্যাখ্যা দিলেন মানুষ শব্দের। তিনি বললেন, মান মানে অস্তিত্ব, Existence আর সেই অস্তিত্ব সম্পর্কে যার হুঁশ আছে সেই মানুষ। এই অর্থে আমরা যারা নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে বেহুঁশ অর্থাৎ জ্ঞানহীন, অসতর্ক, অচৈতন্য তারা মনুষ্যাকৃতি হ'লেও আমরা মানুষ অর্থে মানুষ ন'ই। আমরা জীব অর্থাৎ জীবন আছে এমন প্রাণী। তাই বোধহয় বলা হ'য়ে থাকে আমরা জীবকোটি। জীবকোটি মানে বৃত্তি-প্রবৃত্তিতে ডুবে থাকা রিপুতাড়িত প্রাণ বা জীবাত্মা। অজ্ঞানতার অন্ধকারে ডুবে থাকা ষড়রিপুর প্রবল টানে বিশৃঙ্খল উচ্ছৃঙ্খল আমার বেসামাল অচৈতন্য প্রাণ। তাই বলা হয় আমি ও আমার মতো যারা জীবকোটি। আমরা মনুষ্যাকৃতি কিন্তু মানুষ ন'ই। তাই শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র বলেছিলেন,
"বৃত্তি-আঠায় লেপটে থাকে
ছোট্ট হৃদয় খান,
জীবকোটি তুই তা'রেই জানিস
অজানাতেই স্থান।"
আর, এইজন্যই শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র পূর্বরূপে শ্রীশ্রীঠাকুর রামকৃষ্ণ রূপে এসে কাশীপুরের উদ্যানবাটিতে চিকিৎসার প্রয়োজনে গাছপালায় ঘেরা ১১ বিঘের বাগানবাড়ির নিরালা পরিবেশে শরীর সারিয়ে নেওয়ার জন্য যখন এসে উঠেছিলেন সেখানে ১৮৮৬ সালের ১লা জানুয়ারি কিছুটা সুস্থ বোধ করায় সেদিন বাগানে হাঁটতে বেরিয়েছিলেন তিনি অর্থাৎ শ্রীশ্রীঠাকুর রামকৃষ্ণদেব। সেদিন তাঁর কয়েকজন ভক্ত ছাড়া বিশেষ কেউ সঙ্গে ছিল না। তাঁর অন্যতম ভক্ত মহান নাট্যকার ও অভিনেতা শ্রীগিরিশ চন্দ্র ঘোষ সেদিন ছিলেন শ্রীশ্রীঠাকুরের সঙ্গে। সেদিন শরীর ভালো বোধ করায় বাগানে বেড়াতে বেড়াতে হঠাৎ শ্রীশ্রীঠাকুর ভক্তপ্রাণ নাট্যকার শ্রী গিরিশ চন্দ্র ঘোষকে বলেছিলেন, ‘‘হ্যাঁ গো, তুমি যে আমার সম্পর্কে এত কিছু বলে বেড়াও, আমাকে তুমি কী বুঝেছো?’ আচম্বিতে শ্রীশ্রীঠাকুরের এমন অপ্রত্যাশিত প্রশ্নে নাট্যকার অভিনেতা প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ভক্তপ্রাণ গিরিশচন্দ্র ঘোষ থতমত খেয়ে অকপট কন্ঠে বললেন, “তুমি আর কেউ নও, নররূপধারী পূর্ণব্রহ্ম ভগবান। আমার মত পাপীতাপীদের মুক্তির জন্য নেমে এসেছ।” এ কথায় পুরুষোত্তম পরমপিতা সদগুরু জীবন্ত ঈশ্বর শ্রীশ্রীঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমভক্ত শ্রদ্ধেয় শ্রী গিরিশচন্দ্র ঘোষের দিকে স্নেহময় ভালোবাসাময় চোখে তাকিয়ে মৃদু হেসে তাঁকে লক্ষ্য ক'রে অচৈতন্য মনুষ্যাকৃতি জীবেদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, "আমি আর তোমাদের কি বলবো। তোমাদের চৈতন্য হ'ক।" এই কথা বলার পরেই শ্রীশ্রীঠাকুর সমাধিস্থ হন।
তাই এবারে শ্রীশ্রীঠাকুর রামকৃষ্ণ শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র রূপে আমাদের চেতনাকে জাগ্রত করবার জন্য এসে নানাভাবে হাজার হাজার বাণীর মধ্যে দিয়ে তিনি তাঁর পূর্বজন্মে ব'লে যাওয়া কথা "পূর্ণজ্ঞান দিলাম না, খুব শিগগিরই আসছি" তাঁর কথা রেখে গেলেন। তাঁর পুনরায় আসার অনেক কারণের মধ্যে একটা কারণ, অনেক অসম্পূর্ণ না ব'লে যাওয়া কথার মধ্যে অন্যতম একটা কথা "তোমাদের চৈতন্য হ'ক" অর্থ তিনি এবার এসে স্পষ্ট ক'রে দিয়ে গেলেন। তাঁর পূর্বরূপের কথা "তোমাদের চৈতন্য হ'ক" কথার অর্থ এবারে এসে প্রাঞ্জল ভাষায় আমাদের জীবকোটি থেকে ঈশ্বরকোটিতে রূপান্তরের কথায় ব'লে গেলেন তাঁর নানা বাণী ও হাজারো কথোপকথনের মাধ্যমে। অর্থাৎ আমরা যখন তাঁর সৃষ্টির সর্ব্বশ্রষ্ঠ সৃষ্টি মানুষ তখন প্রকৃত মানুষ অর্থেই আকৃতি ও প্রকৃতিতে প্রকৃত মানুষ হওয়ার কথা বলে গেলেন এবার শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র।
ঈশ্বরকোটি মানুষ সম্পর্কে তিনি বললেন,
"প্রেষ্ঠনেশার অটুট টানে
বৃত্তি-সমাহার,
ঈশ্বরকোটি তাঁ'কেই জানিস্
শ্রেষ্ঠ জনম তাঁ'র।"
যাই হ'ক, এই ব্যাখ্যার মধ্যে দিয়ে প্রমাণ হ'য়ে যায় আমরা মনুষ্যাকৃতি জীবেরা ঠিক কোথায় অবস্থান করছি। এবার আমরা যারা জীবকোটি তাদের অবশ্যই লজ্জা হওয়া উচিত নিজেদের মানুষ বলা। হয়তো একথায় অনেকে বলতে পারে এতে লজ্জার কি আছে মশায়? ঠিক কথা জীবকোটির মধ্যেও অনেকেই আছে যারা নির্লজ্জ ও লজ্জাশীল-লজ্জাশীলা জীব। লজ্জা তাদের থাকার কথা নয় যাদের দু'কান কাটা ও গ্রামের মাঝখান দিয়ে হাঁটে। লজ্জা তাদের পাওয়া উচিত নয় যারা লেখাপড়া জানাওয়ালা জীব। লজ্জা তাদের লাগে না যাদের বোধের ঘর শূন্য। কোনও কিছুর মূল্য সম্পর্কে এবং মূল্যবোধ সম্পর্কে যাদের কোনও ধারণাই নেই তাদের লজ্জা লাগার কথা নয়। লজ্জা তাদের গায়ে লাগে না যাদের গায়ের চামড়া ও চোখের চামড়া মোটা। লজ্জা তাদের জন্য নয় যারা অহংকারী ও সর্বজ্ঞ মনোভাবের। লজ্জা তাদের লাগে না যারা রিপুজারিত।
যাই হ'ক, মানব সভ্যতার বিকাশ ঘটে এই ঈশ্বরকোটির দ্বারা অর্থাৎ মানুষের দ্বারা। আর বিনাশ হয় জীবকোটির দ্বারা অর্থাৎ মনুষ্যাকৃতি জীবেদের দ্বারা।
সৃষ্টিকর্তা যাকে আমরা ঈশ্বর, আল্লা, গড ইত্যাদি বলি সেই তিনি জীবন্ত ঈশ্বর, জীবন্ত আল্লা, জীবন্ত গড হ'য়ে নেমে আসা স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র মানুষ রূপে নেমে এসেছিলেন আমাদের জীবকোটি থেকে ঈশ্বরকোটিতে রূপান্তর ক'রে তাঁর সৃষ্টিকে রক্ষা করার জন্য। আমরা জীবকোটিরা, স্বঘোষিত সর্ব্বজ্ঞদের দ্বারা নানা মতবাদে বিভক্ত অনুসারী জীবেরা সৃষ্টিকর্তার বারবার আগমনকে অস্বীকার ক'রে, কিংবা তাঁর সাকার রূপের কপট অনুগামীরা, তাঁর নিরাকার রূপের পুজারীরা, কিংবা তাঁর অমূর্ত রূপের পুজারীরা তাঁকে ও তাঁর বলে যাওয়া কথাকে অমান্য ক'রে, তাঁর সঙ্গে বেইমানি ও নেমকহারামী ক'রে তাঁকে বাধা দিয়ে তাঁর সৃষ্টিকে বারবার ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছি এবং নিজেদের সত্ত্বা অস্তিত্বের প্রগতিকে করেছি ক্ষুণ্ণ, করেছি অতি প্রগতির নামে দুর্গতিকে আমন্ত্রণ। ফলে জীবকোটি থেকে ঈশ্বরকোটিতে হয়নি রূপান্তর।
আর এই দশা বর্তমানে সৎসঙ্গীদেরও।
তাই তিনি আমৃত্যু কেঁদে কেঁদে বুক ভাসিয়ে জনে জনে ব'লে গেছিলেন, "আমায় মানুষ ভিক্ষা দাও, আমায় মানুষ ভিক্ষা দাও।" তিনি উদাত্ত কন্ঠে বললেন,
‘‘ওগো ভিক্ষা দাও!--
ঝাঁঝাল ঝঞ্ঝার পিশাচী জৃম্ভন শুরু হয়েছে,
বাতুল ঘুর্ণি বেভুল স্বার্থে
কলঙ্ক কুটিল ব্যবচ্ছেদ
সৃষ্টি করতে আরম্ভ করে দিয়েছে,
প্রেত-কবন্ধ-কলুষ
কৃষ্টিকে বেতাল আক্রমণে বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে,
অবদলিত কৃষ্টি অজচ্ছল অশ্রুপাতে
ভিক্ষুকের মতো তাঁরই সন্তানের দ্বারে
নিরর্থক রোদনে রুদ্যমান,
অলক্ষ্মী-অবশ প্রবৃত্তি-শাসিত বেদস্মৃতি--
ঐ দেখ--মর্মান্তিকভাবে নিষ্পেষিত,
ত্রস্ত দোধুক্ষিত দেবতা আজ নতজানু--তোমাদেরই দ্বারে
তোমাদেরই প্রাণের জন্য তোমাদেরই প্রাণভিক্ষায়
তোমাদেরই সত্তার সম্বর্দ্ধনার জন্য
ব্যাকুল হয়ে ইতস্ততঃ ঘুরে বেড়াচ্ছেন ;
কে আছ এমন দরদী আর্য্য-আত্মজ সন্তান!--
তাঁকে মানুষ ভিক্ষা দেবে, তাঁকে অর্থ ভিক্ষা দেবে—
সব হৃদয়ের সবটুকু উত্সর্গ করে
তোমাদেরই জন্য
সেই দেবোজ্জল প্রচেষ্টাকে সার্থক করে তুলতে ?
যদি থাক কেউ
ওগো ধী-ধুরন্ধর উত্সর্গপ্রাণ
নিরাশী নির্ম্মম!
এস,--উৎসর্গ কর--আত্মাহুতি দাও--
জীবন নিঙড়ানো যা-কিছু সঙ্গতি
তাঁকে দিয়ে সার্থক হয়ে ওঠ,
নিজেকে বাঁচাও, মানুষকে বাঁচাও, কৃষ্টিকে বাঁচাও ;
আর, বাঁচাও দুর্দ্দশাদলিত মহা-ঐশ্বর্য্যশালিনী
আর্য্যস্তন্যদায়িনী, পরম-পবিত্রা
ভিখারিণী মাতা ভারতবর্ষকে,
ধন্য হও, নন্দিত হও,
ঈশ্বরের অজচ্ছল আশীর্ব্বাদকে
মাথা পেতে লও,
শান্ত হও, শান্তি দাও,
অস্তি ও অভ্যুত্থানকে
অনন্তের পথে অবাধ করে রাখ ;
স্বস্তি! স্বস্তি!! স্বস্তি!!"
আজ থেকে ৭৭বছর আগে শ্রীশ্রীঠাকুর ১৯৪৬ খ্রীস্টাব্দের প্রথমদিকে হিমাইতপুরে নিজহস্তে লিপিবদ্ধ করেন এই ‘দেবভিক্ষা’ বাণীটিকে। আজও সেই রাজভিখারি শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের মানুষ ভিক্ষার ট্রাডিশান আচার্য পরম্পরার মাধ্যমে বর্তমান ঈশ্বরকোটি পুরুষ আচার্যদেব শ্রীশ্রীবাবাইদাদার মধ্যে দিয়ে ধ্বনিত হ'য়ে চলেছে সমানে।
আমরা সৎসঙ্গীরা কি শ্রীশ্রীআচার্যদেবের আহবানে তাঁকে নিজেকে 'মানুষ' রূপে ভিক্ষা দিতে পারি?
( লেখা ১৬ই অক্টোবর'২০২৩)
No comments:
Post a Comment