সুগতবাবু আপনার ‘A life immortal’
অধ্যায় থেকে নেওয়া ‘ভাবাদর্শের মৃত্যু হয় না’ প্রবন্ধের প্রথম লাইনেই একটা ষড়যন্ত্রের গন্ধ ভেসে এলো। সমালোচকদের মনোভাবে এটাই প্রমাণ হয় ব্রিটিশ আর তার সহযোগীদের সহায়তায় সুভাষবাবু ফিরে আসার অনেক আগেই তাঁর ভারতে আর ফিরে না আসতে পারার ষড়যন্ত্র রচিত হয়ে গেছিল।
ব্যাপারটা এরকম ভাবা যেতে পারে বা ভাবা উচিৎ যে সুভাষচন্দ্র বসুর সমালোচকরা তাঁর বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তুলেছিলেন তা’ ছিল উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ভালো-মন্দ সবেরই পক্ষ-বিপক্ষ আছে। মন্দের বিরোধিতার থেকেও ভালোর বিরোধিতা প্রবল। মন্দের বিরোধিতা করার সাহস থাকে না বিশেষত তথাকথিত ভদ্র ও ভালো লোকেদের। কিন্তু ভালো লোক বা ভালো কাজের বিরোধিতা মন্দ বা বিরুদ্ধবাদী লোকেরা তো করবেই আর তার দোসর হয়ে ওঠে ঐ তথাকথিত ভদ্র বা ভালো সাহসী লোকেরা; মুখোশধারী ভদ্র বা ভালো লোকেদের কথা নাই বা উল্লেখ করলাম। এইখানে একটা সুবিধা আছে তথাকথিত ভালো বা ভদ্র লোকেদের পক্ষে ভালো লোকেদের বিরোধিতা করার কারণ এককথায় যার বিরোধিতা করছে প্রকৃতই সে ভালো লোক। তাই কোনও ভয় নেই ঐ ভালো লোকের দিক থেকে কোনও বিপদ আসার। কিন্তু মন্দ লোকের বিরোধিতা করার ক্ষেত্রে তথাকথিত ব্যক্তিত্ব ও চরিত্রহীন ভদ্র বা ভালো লোকেদের মনে একটা প্রচন্ড অস্তিত্ব সংকটের ভয় আছে। তাই তাঁরা সবসময় মন্ত্র জপার মত জপতে থাকে, ‘সাধু সাবধান!!!!!!!!!!!!’ এই তথাকথিত ভদ্র বা ভালো লোকেরা মুখোশধারীদের যদিও সমপর্যায়ভুক্ত তথাপি তাঁরা তাঁদের শারীরিক, মানসিক ও চারিত্রিক দুর্বলতা, ভয়, অজ্ঞানতা, অশিক্ষা, লোভ, ইর্ষা ইত্যাদি নানা কারণে অসহায়তাজনিত বলিষ্ঠ সমর্থন জানিয়ে যায় ঐ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ক্ষমতালোভী স্বার্থপর বিরোধীদের প্রতি! আর এইখানেই মিথ্যা সত্য হয়ে ওঠার সুযোগ পায়। যদিও একদিন না একদিন কালের নিয়মেই তা’ প্রকাশ্যে চলে আসে, প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটিত হয়। কিন্তু ততদিনে অনেক অনেক দেরী হয়ে যায়।
সুভাষচন্দ্রের বিরোধিতার পিছনে কোনও মতাদর্শগত বিরোধ ছিল না বিরোধীদের, থাকলেও তা ছিল লোকদেখানো মতাদর্শগত বিরোধ; যা ছিল তা’ ক্ষমতা দখলের রাজনীতি, ব্যক্তিগত ইর্ষা ও আক্রোশ, ব্যক্তিত্বের সংঘাত। ছিল ব্রিটিশদের---- বিতারণের মূল কারণের-------- জ্বালা, ছিল বিশ্বব্যাপী সাম্যবাদ দর্শনের প্রসার ও প্রচারকারীদের দুশ্চিন্তা ও ভয়।
সুভাষচন্দ্রের কংগ্রেসের দু’দুবার প্রেসিডেন্ট হওয়া, কঠোর ব্রিটিশ বিরোধী অবস্থান, দেশের ও দলের ভেতরে সীমাহীন জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা সুভাষচন্দ্রের বিরুদ্ধে দলের ভেতরে ও ব্রিটিশ সরকারের ভেতরে একটা শত্রুতার জন্ম দিয়েছিল। দেশকে গড়ে তোলার জন্য, দেশের সার্ব্বিক মঙ্গলের জন্য, দেশের মানুষকে শৃঙ্খলাবদ্ধ জাতে পরিণত করার জন্য সুভাষচন্দ্রের ‘স্বাধীনতার পর কিছুকাল স্বৈরশাসনের প্রয়োজন’ এই আগাম সরল অথচ বেকুবী ঘোষণা তাঁর সুযোগসন্ধানী ধুরন্দর বিরোধীদের মোক্ষম সুযোগ এনে দিয়েছিল তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্র শানানোর আর তাঁর নিজের ক্ষেত্রে নিজের এই ঘোষণা হয়ে দাঁড়িয়েছিল সাপের ছুঁচো গেলার মত। পরবর্তী সময়ে তিনি ছুঁচোরুপী এই ভুলকে না পারলেন গিলতে, না পারলেন উগলে দিতে। আর সুযোগসন্ধানীরা “তিনি বিজয়ী হয়ে ভারতে প্রবেশ করলে একনায়ক হয় উঠতেন” এই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মিথ্যের ছক্কা হাঁকিয়ে হৈ হৈ করে মিথ্যে জয়ের পতাকা উর্ধ্বে তুলে রাজ্যজয় করে বেরিয়ে গেল। এর জন্য দায়ী ছিলেন সুভাষচন্দ্র নিজে। তাঁর দেশকে স্বাধীনতার পর গড়ে তোলার নানাবিধ গঠনমূলক পরিকল্পনা তাঁকে তাঁর সহযোগীদের থেকে maturity-র প্রশ্নে সহস্র যোজন দূরে এগিয়ে রেখেছিল। এইসব নানা কারণ তাঁকে চিরদিনের মত লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকার ছক কষতে রসদ যুগিয়েছিল তাঁর ঘরে-বাইরের বিরোধীদের। তাঁর লোকচরিত্র সম্পর্কে অজ্ঞানতা, অদূরদর্শিতা এবং বিশ্বাস ও সরলতার নামে বেকুবী তাঁকে তো চিরদিনের জন্য অন্ধকারে নিক্ষেপ করলোই সঙ্গে ভারতবর্ষ ও তামাম ভারতবাসীর জীবনে নেবে এলো ভয়ংকর অন্ধকার।
সুগতবাবু নিজেই দোটানায় ভুগছেন। একবার তিনি নিজেই বলছেন সারাটা জীবন ধরে সুভাষচন্দ্রের পার্থিব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, বৈভব পরিহারের কথা আবার আর একদিকে তিনি প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে জোর দিয়ে বলতে পারলেন না যে সুভাষচন্দ্র রাষ্ট্রক্ষমতার মোহে ব্যক্তিগতভাবে জড়িয়ে একনায়ক হয়ে পড়তেন না। মঙ্গল প্রতিষ্ঠার জন্য ইপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছোতে যেকোন উপায় বা পথ অবলম্বন করা যেতে পারে এই সিদ্ধান্ত ও বিশ্বাস সুভাষচন্দ্রের একেবারে সঠিক ও যথাযথ ছিল। এই মত ও পথের সমর্থনে বলিষ্ঠ উদাহরণ আমরা রামায়ণ ও মহাভারতে ভুরি ভুরি দেখতে পায়। যার জন্য তিনি দেশকে, দেশের জনগণকে পরাধীনতার হাত থেকে মুক্ত করার জন্য সুগত বাবুর কথামত ‘তিনি একটি শক্তিশালী দল এবং রাষ্ট্রকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করার কথা ভেবেছিলেন’। আর বৃহত্তর স্বার্থ সিদ্ধির জন্য, দেশের ও দশের মুক্তির জন্য, মঙ্গলের জন্য এই ভাবনা, এই সিদ্ধান্ত ছিল তাঁর সময়োচিত, যুগোপযোগী, সঠিক ও যথাযথ।
সুগতবাবু কোনদিন না বুঝতে পারার থেকে দেরীতে হলেও বুঝতে পেরেছেন যে জহরলালের আমলে সেভাবে সুভাষবাবু সরকারি স্বীকৃতি পাননি। একথাও তিনি বলেছেন যে ইন্দিরা গান্ধী সুভাচন্দ্রকে তাঁর সাহস ও দূরদৃষ্টির জন্য শ্রদ্ধা করতেন। কিন্তু একথা তিনি স্পষ্ট করে কখোনোই বলছেন না যে সুভাষচন্দ্র আজও এই ২০১৫ সালেও তাঁর হারানো সম্মান, ইজ্জৎ, মর্যাদা ফিরে পাননি। যথাযথ সরকারি স্বীকৃতি পাননি। স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত্য সমস্ত দলের সরকারের কাছে দায়ছাড়া গোছের ও হেলাফেলার সম্মানের পাত্র হয়েছেন মাত্র। সরকারি স্বীকৃতি পেলেন কি না পেলেন তাতে কিছু যায় আসে না সুভাষচন্দ্রের মত মানুষদের। তাঁরা কখনো কোনও স্বীকৃতির লোভে কোনও কাজ করেন না। আর কাউকে শ্রদ্ধা করা আর শ্রদ্ধেয় ব্যক্তির সম্মান, ইজ্জৎ, মর্যাদা রক্ষা ও তা’ ফিরিয়ে আনার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ সম্পর্কে উদাসীন থাকা, গুরুত্ব না দেওয়া এই পরস্পর বিরোধী ভুমিকার অবস্থান একই জীবনে অবস্থান করার ফলে এটা প্রমাণ করে, আজকের ভোগ সর্বস্ব জীবনে এটাই সত্য যে কাউকে শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন শুধুমাত্র লোকদেখানো অনুষ্ঠান ছাড়া আর কিছুই নয়। এখন আর শ্রদ্ধার চাষ হয় না। বিলুপ্ত হয়ে গেছে এই বীজ। আর সুভাষচন্দ্রের জীবিত অবস্থায় স্বাধীনতা সংগ্রামে দেশের ও দেশবাসীর জন্য তাঁর ত্যাগ, তিতিক্ষা, কঠোর সংগ্রাম, তাঁর লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, পরিকল্পনা, ছক ইত্যাদি কোনকিছুর প্রতিই ছিল না সামান্যতম সম্মান, শ্রদ্ধা, বিশ্বাস, নির্ভরতা, ধারণা তৎকালীন স্বাধীনতা সংগ্রামে যুক্ত তাঁর বিরোধী অবস্থানে অবস্থিত স্বাধীনতা সংগ্রামী ও ধার করা পাশ্চাত্য মতবাদীদের। একটা মানুষ, যাকে দখলকারীদের হাত থেকে দেশকে মুক্তির জন্য লড়াই করতে গিয়ে লড়াই করতে হয়েছে দেশের ভিতরে দেশের লোকের সঙ্গেই; এর থেকে দুঃখ, কষ্ট, জ্বালা, যন্ত্রনা, অপমান, লাঞ্ছনা, অবহেলা আর কি হতে পারে মানুষটার জন্য তা আমার জানা নেই। আর আজ যদি তারাই তাঁকে সম্মান প্রদর্শন করেন তাকে কি বলা যেতে পারে? ‘জুতো মেরে গরু দান’ নয়কি? যদি কেউ মনে করে প্রত্যেক ২৩শে জানুয়ারী নেতাজীর মূর্তিতে মালা দিয়ে নেতাজীর প্রতি অন্যায় কৃতকর্মের জন্য প্রায়শ্চিত্ত করেন, অনুতাপ করেন তাহলে সেটা হবে আজকের ঘোর কলিযুগে চরম মুর্খামি, সীমাহীন ভুল। আসলে সবটাই pseudopolitics-এর Give & Take Policy-র যুগে নাটক, ভন্ডামি। আজ ৭০বছর ধরে ভারতের স্বাধীনতার জন্য নিবেদিত প্রাণ সবচেয়ে আকর্ষনীয় মানুষটি রহস্যের বেড়াজালে আটকে রইলো এক লজ্জাজনক যুদ্ধাপরাধী হিসাবে! এ অনেকটা সেই ত্রিশঙ্কুর মত। না পারলেন বেঁচে ফিরে এসে প্রমাণ করতে যে তিনি বেঁচে ছিলেন বা আছেন, না পেরেছেন মরে প্রমাণ করতে যে সত্যি সত্যিই তিনি আর এই পৃথিবীতে নেই। একজন দেশের জন্য, জাতির জন্য সর্বস্ব উজার করা দেশপ্রেমিকের এ এক অদ্বিতীয় যন্ত্রণাদায়ক ও অপমানজনক ত্রিশঙ্কু অবস্থান পৃথিবীর বুকে!
আসলে সুভাষচন্দ্রের দেশপ্রেম, দেশের জন্য লড়াই, আত্মত্যাগ, বীরত্ব, সাহস, বুদ্ধি, মেধা, নেতৃত্ব, বিভিন্ন সম্প্রদায় ও বিভিন্ন জাতির সমস্ত মানুষকে আপন করে নেবার অলৌকিক ক্ষমতা এককথায় সামগ্রিক জীবন এতটাই বর্ণময় ছিল যে তাঁর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের কাছে সেসব চক্ষুশূল হয়ে দাঁড়িয়েছিল এবং স্বাধীনতা পরবর্তী দেশের শাসনভার যে তাঁর ওপরেই স্বাভাবিক ভাবে ন্যস্ত হবে সেই অবধারিত সত্য তাঁকে এক ভয়ানক, নির্ম্মম, নৃশংস, নির্দয়, যন্ত্রনাদায়ক, করুণ ভবিষ্যৎ উপহার দিয়েছিল। কারণ তিনি অনেক আগেই সর্বসম্মতভাবে ভারতের প্রথম আজাদ হিন্দ সরকারের সর্বাধিনায়ক হয়ে গিয়েছিলেন। তাই বোধহয় এমন করুণ পরিণতি।
এই করুণ পরিণতি প্রসঙ্গে সুভাষচন্দ্রের পিতামাতার দীক্ষাগুরু The greatest phenomenon of the world শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের একটা সাবধান বাণী মনে পড়ে গেলঃ “দৌড়ে যাও, কিন্তু হাঁপিয়ে যেও না; আর, হোঁচট খেয়ে যাতে না পড়, দৃষ্টি রেখো।”......সত্যানুসরণ।
এই করুণ পরিণতি প্রসঙ্গে সুভাষচন্দ্রের পিতামাতার দীক্ষাগুরু The greatest phenomenon of the world শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের একটা সাবধান বাণী মনে পড়ে গেলঃ “দৌড়ে যাও, কিন্তু হাঁপিয়ে যেও না; আর, হোঁচট খেয়ে যাতে না পড়, দৃষ্টি রেখো।”......সত্যানুসরণ।
http://eisamay.indiatimes.com/sunday-special-rabibaroari/cover-story/article-on-netaji-and-nehru-sugata-basu/articleshow/47853019.cms
No comments:
Post a Comment