Powered By Blogger

Tuesday, June 24, 2025

আত্মকথন ২২

খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে আছি আমি একা। এখন সময় দুপুর ১টা। আশেপাশে কেউ নেই, ফাঁকা চারপাশটা। অফিস বিল্ডিং-এর সামনে গোল ক'রে তৈরী অপূর্ব ফুলের বাগান! একপাশে গাড়ি পার্কিংয়ের শেড। সেখানে কোম্পানির উচ্চ পর্যায়ের পদস্থ কর্মচারীদের প্রত্যেকের গাড়ি রাখার জায়গা আর সেই নির্দিষ্ট জায়গার ওপরে ঝুলছে প্রত্যেকের নেম প্লেট। সেদিকে তাকিয়ে দেখলাম প্রেসিডেন্টের নাম লেখা একটা নেম প্লেট সেখানে ঝুলছে। আর সেই নেম প্লেটের নীচে কালো রঙের একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।

আকাশটা মেঘে ঢাকা। মেঘলা আকাশ থেকে মনে হচ্ছে যেন অনেক খুশি পুষ্পবৃষ্টির মতো আমার চোখমুখের ওপর ঝ'রে পড়ছে। একটা মিষ্টি হাওয়া বইছে। চোখেমুখে সেই মিষ্টি হাওয়া আলতোভাবে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে! শিশুর নরম তুলতুলে হাতের স্পর্শের মতো সেই হাওয়ার স্পর্শ।
আমি চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম বন্ধুরা কেউ আছে কিনা। হঠাৎ 'বাপী-ই-ই' ডাক শুনে দূরে তাকিয়ে দেখলাম একটা গাছের নীচে বন্ধুরা সবাই দাঁড়িয়ে আছে। আমার আসার অপেক্ষায় তারা বসে আছে। আমি তাদের দিকে তাকিয়ে হাত দেখালাম। তারপর এগিয়ে গেলাম তাদের দিকে। অপেক্ষার অবসান হ'লো।

যেতে যেতে মনে মনে ভাবলাম একটা কপট ব্যর্থতা চোখেমুখে নিয়ে গিয়ে দাঁড়ায় তাদের সামনে। কিন্তু অভূতপূর্ব জয়ের যে উচ্ছ্বাস-আনন্দ আর তার বাঁধ ভাঙা ঢেউ মনের মধ্যে বুকের ভেতরে আছড়ে পড়ছে ক্রমাগত আর তার অনাবিল প্রকাশ ফুটে উঠতে চাইছে চোখেমুখে তা রোধ করা অসম্ভব। চেষ্টা করলাম জয়ের আনন্দ লুকিয়ে তাদের সামনে হাজির হ'তে। আমাকে নিরুৎসাহ দেখে বন্ধুরা হতাশায় ভেঙে পড়লো। নানা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে লাগলো। 'কি হ'লো? কি বললো? রেগে আছেন? আমাদের ব্যাপারটা বলেছিস? চাকরী হবে রে? হবে না? এই আমাদের বিরুদ্ধে কোনও পুলিশি অ্যাকশান হবে না-তো? ঐ রাজনৈতিক দাদা রেগে নেই তো? ইত্যাদি নানা প্রশ্নের চাপে বেশীক্ষণ নিজেকে লুকিয়ে রাখতে ব্যর্থ হলাম। বন্ধুদের অজানা এক ভয় মিশ্রিত কৌতুহলী নানা প্রশ্নের সম্মুখে কয়েকবার কপট হতাশার বাতাবরণ তৈরী ক'রে শেষে ব্যর্থ হ'য়ে নিজেকে খুলে দিলাম। হেসে উঠলাম আমি। সবাইকে হাত দিয়ে থামিয়ে মুখে বিজয়ীর হাসি ফুটিয়ে ব'লে উঠলাম, আরে দাঁড়া, দাঁড়া। এত হড়বড় করার কিছু নেই। সবুরে মেওয়া ফলে। তারপর পুরো ঘটনার বিবরণ সংক্ষেপে তুলে ধ'রে বললাম, চল, এখন বাড়ি যাই। সন্ধ্যেবেলায় দাদার কাছে যাব, সেখানে সব জানিয়ে তারপর লিস্ট তৈরী করবো।

সবাই হৈ হৈ ক'রে আনন্দে সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরে চললাম। একটা অদ্ভুত প্রশান্তি আমাকে বলয় তৈরী ক'রে যেন গার্ড ক'রে নিয়ে যাচ্ছে। কি যে ভালো লাগছে তা ব্যাখ্যা করার ভাষা আমার নেই। আজ এই লেখার মুহূর্তে শুধু আরও একবার জীবনের এই পড়ন্ত বিকেলে সেই ভালো লাগা অনুভব করতে পারছি। একেবারে জীবন্ত চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি ঘটনাটা। যেন মনে হচ্ছে টাইম মেশিনে চড়ে চলে গেছি সেই অতীতের খুশীর দিনটাতে। লিখতে লিখতে চোখ বন্ধ করলেই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি সেই সেদিনের হাওয়ায় ভেসে যাওয়া দৃশ্যটা। যেন মনে হচ্ছে হাওয়ার ভেলায় ভেসে এগিয়ে চলেছি আনন্দে খুশীতে দলবল মিলে।

বাড়িতে এসে দুপুরে স্নান খাওয়া সেরে ঘরে দরজা জানালা বন্ধ ক'রে ফ্যান চালিয়ে শুয়ে পড়লাম। শুয়ে শুয়ে মনে ভাসতে লাগলো অফিস ঘরের ছবিটা। ঘরে আসার পর থেকে আমার চোখেমুখে চলাফেরার মধ্যে একটা খুশীর ভাব লক্ষ্য ক'রে মা খেতে ব'সে জিজ্ঞেস করলো, ঘরে ঢোকার পর থেকে লক্ষ্য করছি তোকে, আজ এত ফুর্তি কিসের? আমি হেসে বললাম, হ্যাঁ, হ্যাঁ। আজ দারুণ আনন্দ। কেন? মা জিজ্ঞেস করলো। তারপরে বললো, কেন লটারি লেগেছে নাকি? আমি খেতে খেতে বললাম, লটারি লাগার চেয়ে হাজার গুণ বেশী কিছু পেয়েছি। তারপরে মাকে বিস্তারিত ঘটনাটা বললাম। আমার চাকরী পাওয়ার কথা শুনে বাড়ির সবাই হৈ হৈ ক'রে উঠলো, খুব আনন্দ পেল।
ভাবতে ভাবতে কখন যে শুয়ে পড়েছিলাম ঠিক নেই। সন্ধ্যে হওয়ার অনেক আগেই ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। উঠে বসলাম বিছানায়। মনে মনে ঠিক করলাম কার কার নাম দেবো লিস্টে। একটা লিস্ট বানিয়ে নিলাম মনে মনে। তারপরে কাগজে নামগুলি লিখে জামার পকেটে রেখে দিলাম। ইতিমধ্যে সন্ধ্যে হ'য়ে গেছে। ঠাকুরঘরের ভিতর থেকে শঙ্খধ্বনির আওয়াজ ভেসে আসছে। তারপরে ভেসে এলো সান্ধ্য প্রার্থনা। মা-বৌদি-দিদির গলা ভেসে আসছে। আমি আমার ঘরে বিছানায় বসেই প্রার্থনা করলাম। তারপরে প্রার্থনা শেষে চোখেমুখে একটু জলের ঝাপটা দিয়ে ড্রেস পড়ে বেরিয়ে পড়লাম আড্ডাস্থলের উদ্দেশ্যে।

তারপরে দল বেঁধে গেলাম দাদার ডেরায় যেখানে ব'সে তিনি তার ব্যবসা পরিচালনা করেন। আমি এগিয়ে গিয়ে সারাদিনের ঘটনা সংক্ষেপে জানালাম। বন্ধুরা সবাই দূরে দাঁড়িয়ে রইলো। তিনি সব শুনে খুশি হ'য়ে বললেন, তাহ'লে লিস্টটা বানিয়ে ফেল। আমি লিস্ট বানাবার কথা তাঁকে জানালাম। তারপরে তিনি অনুরোধের সুরে বললেন, তোর লিস্টে আমার দু'জনের নাম ঢুকিয়ে দিবি। আমি হেসে বললাম, দু'টো কি বলছেন দাদা, আপনি যে কটা বলবেন আমি লিখে দেবো। তিনি বললেন, না, না আমার দু'জনের বেশী কেউ নেই। তাছাড়া এ যা করেছিস তুই-ই করেছিস, একা করেছিস। এখানে আমার কোনও অবদান নেই। তারপরে বললেন, কবে দিবি লিস্ট? আমি বললাম, কালই যাবো, দেরী করবো না। ঠিক আছে, কাল কি হ'লো জানাস ব'লে বললো, শোন, একটা কথা আছে। এই কথা ব'লে তিনি তাঁর অফিস ঘরে নিয়ে গেলেন। সেখানে তিনি বললেন, তুই বোকার মতো এটা কি করলি? আমি অবাক হ'য়ে বললাম, কেন কি করেছি? তিনি একটু চুপ ক'রে থেকে পরে বললেন, তোকে যে কালকে চাকরীতে জয়েন্ট করতে বললো তুই সেটা করলি না কেন? আমি অবাক হ'য়ে বললাম, আমি জয়েন্ট করলে তারপরে আর কি ক'রে বাকীদের কথা বলবো? আরে বোকা, আগে তুই তো ঢোক তারপর না হয় অন্যদের কথা ভাববি। তুই এই যে সুযোগ হারালি এই সুযোগ যদি আর না পাস। কে বলতে পারে এর পরে আদৌ কারও হবে কিনা? আরে শালা, চাচা আপন প্রাণ বাঁচা শুনিসনি প্রবাদটা? তারপরে আর কিছু না ব'লে 'যাক ছাড়, কাল দ্যাখ কি হয়' ব'লে হাঁটতে লাগলো। আমিও পিছন পিছন হেঁটে বাইরে বেরিয়ে এসে 'আসছি' ব'লে বন্ধুদের নিয়ে বিমর্ষ মনে পরের দিনের কথা ভাবতে ভাবতে চুপচাপ ফিরে চললাম নিজের আড্ডার জায়গায়। মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করলাম, আমি কি কিছু ভুল করলাম?

আজ জীবন সায়াহ্নে এসে ভীষণ মনে পড়ে কথাগুলি। ভাবি, হে দয়াল! কি ভুল কি ঠিক করেছি সারাজীবন তুমি জানো।
( লেখা ২৪শে জুন'২০২৩)

No comments:

Post a Comment