আজ সমস্ত সৎসঙ্গীরা আনন্দ করছে। শ্রীশ্রীঠাকুরের লীলাভূমি ও কর্মভূমি ভারতবর্ষ এবং তাঁর জন্মভূমি, লীলাভূমি ও কর্মভূমি বাংলাদেশের প্রতিটি রাজ্যের প্রতিটি জেলার প্রতিটি পৌরসভা ও পঞ্চায়েত এলাকার সৎসঙ্গীদের ঘরে ঘরে এবং তাঁর ভাবাদর্শ ছড়িয়ে পড়া দেশগুলি নেপাল, বার্মা, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আফ্রিকা, আমেরিকা, কানাডা, অষ্টেলিয়ায় সৎসঙ্গীদের ঘরে আজ জন্মদিন পালন হচ্ছে। আজকে আমি পরমদয়াল পরমপিতা পুরুষোত্তম শ্রীশ্রীঠাকুরের রাতুল চরণে সমস্ত হিন্দু, মুসলমান, খ্রীষ্টান, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন ইত্যাদি সমস্ত সম্প্রদায়ের দীক্ষিত সৎসঙ্গীদের জন্য এবং অস্থির বিশ্বের প্রায় ৮০০কোটি প্রতিটি মানুষের জন্য সুখ, শান্তি ও সুস্থ জীবন প্রার্থনা করছি।
আজকের এই আনন্দের দিনে আমি আমার সমস্ত সৎসঙ্গী গুরুভাইবোনেদের সঙ্গে আমার আনন্দ শেয়ার করার জন্য কিছু মনের কথা তুলে ধরছি। তুলে ধরছি আন্তরিক ও অকপটভাবেই শ্রীশ্রীঠাকুরের সোনার সৎসঙ্গী ও আমার প্রিয় সৎসঙ্গী গুরুভাইবোনেদের প্রতি একজন সৎসঙ্গী গুরুভাই হিসেবে ও সেই অধিকারে।
আমি মূলত দু'টি বিষয় সংক্ষেপে শেয়ার করবো আপনাদের সাথে। প্রথমত আসুন, আলোচনার মাধ্যমে জেনে নিই, শ্রীশ্রীঠাকুর কেন জন্মেছিলেন? যে মানুষটার আজ জন্মদিন পালন করছি সেই মানুষটা কেন জন্মেছিলেন সেটা সৎসঙ্গীদের তাঁর জন্মদিন পালনের সঙ্গে সঙ্গে জানা ও উপলব্ধি হওয়া দরকার। আর, তাঁর সঙ্গে সঙ্গে আমরাই বা কেন জন্মেছি? ও কেন তাঁর জন্মদিন পালন করছি? কে তিনি? কেন তিনি এসেছিলেন? এই সমস্ত বিষয় একটু জানা দরকার। নতুবা তাঁর জন্মদিন পালন আর একটা সাধারণ মানুষের জন্মদিন পালনের মত লক্ষ্যহীন উদ্দেশ্যবিহীন নিছক হতাশা, অবসাদ, ক্লান্তি, অস্থিরতায় ভরা জীবনে একটু হৈ হুল্লোড় করে জন্মদিন পালন করার মধ্যে দিয়ে আনন্দ উপভোগ করার চেষ্টা করা ও এই পালনের মধ্যে দিয়ে আর একটা ফ্যাকাশে দিনকে একটু রঙ্গীন ক'রে কটানো ছাড়া আর কিছুই নয়। ঐ দিনগত পাপক্ষয়। তারপর আবার সেই যে কে স্টীল অর্থাৎ পূর্বের অপরিবর্তনীয় ফাকাশে বর্ণহীন জীবন।
তাই আসুন এই সাময়িক আনন্দ উপভোগের সুযোগে আমরা আজ দেওঘরে ঠাকুরবাড়িতে, দেশে, বিদেশের কেন্দ্র, মন্দিরে, ঘরে, বাইরে যে যেখানে আছি আনন্দ করতে করতে, ঘুরতে ঘুরতে, চা খেতে খেতে, টিফিন খেতে খেতে, ঠাকুর নিয়ে গল্প করতে করতে, আড্ডা মারতে মারতে আসুন একটু মোবাইলে চোখ রাখতে রাখতে একবার পড়ে নিই শ্রীশ্রীঠাকুর কেন, কি কারণে জন্মেছিলেন, একটু জেনে নিই আমরাই বা কেন জন্মেছি? ও কেন তাঁর জন্মদিন পালন করছি? কে তিনি? কেন তিনি এসেছিলেন?
এইসমস্ত কিছু জানবো আমরা শ্রীশ্রীঠাকুর নিজে এই বিষয়ে কি বলেছেন
সেটা আলোচনা করার মধ্যে দিয়ে। আমার ব্যক্তিগত কোনও কথা এখানে নেই।
শ্রীশ্রীঠাকুর আমাদের দরদভরা কণ্ঠে বললেন,
" তুমি কেন জন্মেছ মোটাভাবেও কি দেখেছ ? থাকাটাকে কি উপভোগ ক'রতে নয় ---- চাহিদা ও কর্ম্মের ভিতর - দিয়ে পারস্পরিক সহবাসে ----- প্রত্যেকরকমে ? তেমনি বুঝছ না ভগবান কেন সৃষ্টি ক'রেছেন ? উত্তর কি এখন ?----- নিজেকে অনুভব ক'রতে , উপভোগ ক'রতে ---- বিশ্বে ,প্রত্যেক অনুপাতে --- দেওয়ায় , নেওয়ায় -- আলিঙ্গনে , গ্রহণে , কর্ম্মবৈচিত্রে , ----- নয় কি ? "
আসুন এবার কি ভেবে দেখি, তলিয়ে দেখি তিনি কি বলতে চেয়েছিলেন।
শ্রীশ্রীঠাকুরের কথামত আমি প্রকাশ বিশ্বাস কেন জন্মেছি একবারও কি ভেবে দেখেছি? সুক্ষ্মভাবে ভেবে দেখবার দরকার নেই, মোটাভাবেও কি ভেবে দেখেছি? দেখিনি। যদি ভেবে দেখতাম তাহ'লে এত দুঃখ, কষ্ট, এত অভাব অভিযোগ কি থাকতো? থাকতো না। এত রোগ, এত শোক, এত গ্রহদোষে আক্রান্ত হতাম? হতাম না। এত বুদ্ধিবিপর্যয় হ'তো? হ'তো না। এত দরিদ্রতা তা' সে আর্থিক দরিদ্রতা হ'ক, জ্ঞানের দরিদ্রতা হ'ক, প্রেম-ভালোবাসার দরিদ্রতা, চরিত্রের দরিদ্রতা হ'ক যে দরিদ্রতাই হ'ক এই দরিদ্রতার কষাঘাতে কি ক্ষতবিক্ষত হ'তাম? উত্তর কি? হতাম না।
তাহ'লে কি দাঁড়ালো? শ্রীশ্রীঠাকুরের কথামত আমি কি আমার এই যে থাকাটা, মানে আমার এই যে অস্তিত্ব এই থাকাটাকে, এই অস্তিত্বটাকে প্রকৃত উপভোগ করতে পেরেছি? পারছি? যদি প্রকৃত উপভোগ করতে পারতাম তাহ'লে আমি নানারকম রোগে, কতরকম আপনজনের বিয়োগ ব্যাথার শোকে, বিভিন্ন গ্রহদোষ অর্থাৎ গ্রহণদোষে, পদেপদে বুদ্ধিবিপর্যয়ে ও আর্থিক দরিদ্রতা, চরিত্রের দরিদ্রতা অর্থাৎ উচ্ছৃঙ্খল বিশৃঙ্খল রিপুতাড়িত জীবন এবং জ্ঞানের দরিদ্রতা অর্থাৎ অভাব, প্রেম-ভালোবাসার দরিদ্রতা বা অভাব অর্থাৎ আপনজনদের কাউকে প্রেম বা ভালবাসতে না পারা, ঠাকুরের যেমন পর ব'লে কেউ বা কিছু ছিল না, সবাই ছিল আপন, যেমন শ্রীশ্রীআচার্যদেব আমাদের বলেন, শিক্ষা দেন আপনজনকে ৫টাকা দিলে তোমার শত্রুকে ১০টাকা দিও, তার অসময়ে, বিপদে আপদে সবসময় পিছন থেকে খেয়াল রেখো এবং তোমার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিও তোমার যতটুকু ক্ষমতা তাই দিয়ে, এরকম যে জ্ঞানের দরিদ্রতা অর্থাৎ জ্ঞানের অভাব ইত্যাদি নানা দরিদ্রতার কষাঘাতে জর্জরিত হতাম না।
শ্রীশ্রীঠাকুর আমাকে বললেন, তুমি যদি থাকাটাকে উপভোগ করতে চাও তাহ'লে তোমার যেমন চাহিদা থাকবে তেমন কর্মও দরকার। চাহিদা ও কর্মের উভয়ের মিলন দরকার। চাহিদা ও কর্মের ভিতর দিয়ে পারস্পরিক মিলনের মধ্যে দিয়ে সবসরমভাবে থাকাটাকে তুমি উপভোগ করো। ব্যাপারটা কেমন? যেমন আমি একজন পুরুষ, আমার চাহিদা আছে। এই জগত সংসারে বেঁচে থাকার জন্য ও বেড়ে ওঠার জন্য আমার অন্ন, বস্ত্র, টাকাপয়সা, বাড়ি, গাড়ি্, নারী ইত্যাদি ইত্যাদি প্রয়োজনীয় জিনিস প্রয়োজন, ঠিক তেমনি নারীরও অন্ন, বস্ত্র, টাকাপয়সা, পুরুষ, বাড়ি, গাড়ি্ ইত্যাদি ইত্যাদি যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিস প্রয়োজন। তা এগুলি কোথা থেকে আসবে? আকাশ থেকে আসবে? ম্যাজিক ক'রে আসবে? গুপি গাইন বাঘা বাইনের মত হাততালি দিলেই মহাশূন্য থেকে আসবে? না, আসবে না। তা' আসবে তোমার চাহিদা অনুযায়ী তোমার কর্ম করার মধ্যে দিয়ে। চাহিদা ও কর্মের মিলনের মধ্যে দিয়ে। তোমার চাহিদা আর কর্মের মধ্যে পারস্পরিক সহবাস চাই অর্থাৎ একসঙ্গে চাহিদা ও কর্মকে স্বামীস্ত্রীর মত বাস করতে হবে, উপযুক্তভাবে মিলিত হ'তে হবে, তবেই তোমার ঈপ্সিত ফল লাভ হবে। এককথায় কর্ম ছাড়া ধর্ম পালন বা ঈশ্বর আরাধনায় কোনও কিছু পাওয়া যাবে না।
তাই শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন, তুমি কেন জন্মেছো যেমন ভেবে দেখতে বলেছেন ঠিক তেমনি ভেবে দেখতে বলেছেন, ভগবান কেন সৃষ্টি করেছেন? উত্তরে শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন, ভগবান সৃষ্টি করেছেন নিজেকে নিজে অনুভব করার জন্য, উপভোগ করার জন্য। কিভাবে উপভোগ করবেন তিনি? বিশ্বে যা কিছু আছে সব কিছুর মধ্যে ভগবান নিজেকে নানারকম বিচিত্র কাজের মধ্যে দিয়ে, নিজেকে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে, নেওয়ার মধ্যে দিয়ে, আলিঙ্গন করার মধ্যে দিয়ে, গ্রহণ করার মধ্যে দিয়ে তিনি নিজেকে নিজে অনুভব করার জন্য ও উপভোগ করার জন্যই সৃষ্টি করেছেন।
ঠিক একইরকমভাবে আমিও যদি নিজেকে, নিজের অস্তিত্বকে অনুভব করতে চাই, উপভোগ করতে চাই তাহ'লে ঠিক একইভাবে আমার চারপাশে ঘরে বাইরে সকলের সঙ্গে জীবনের সব দিক দিয়ে দয়া, মায়া, প্রেম, ভালোবাসা, সাহায্য, সহানুভূতি সব রকমভাবে দেওয়া-নেওয়া, আলিঙ্গম-গ্রহণের মধ্যে দিয়ে নিজেকে একইসঙ্গে এই দুনিয়াকে প্রকৃত অনুভব ও উপভোগ করতে পারবো। নতুবা এই জন্মদিন পালন মিথ্যা হ'য়ে যাবে, হ'য়ে যাবে বকোয়াস।
তাহ'লে আজ এই পবিত্র শুভ জন্মদিনে আমাদের তাঁর জন্ম পালন করার সময় মনে রাখতে আমরা সৎসঙ্গীরা একটা সর্ব্বশ্রেষ্ঠ আদর্শের পূজারী। আজকের দিনে আমাদের বুঝতে হবে, দেশ বিদেশে চতুর্দিকে নানারকম আন্দোলন হচ্ছে। সত্যি মিথ্যার আন্দোলন। আর, আমাদের সৎসঙ্গীদের সৎসঙ্গও হচ্ছে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র প্রবর্তীত একটা আন্দোলন, ধর্মীয় আন্দোলন। এই ধর্মীয় আন্দোলনের আদর্শ হচ্ছে, ধর্ম কোনও অলৌকিক ব্যাপার নয় বরং বিজ্ঞানসিদ্ধ জীবন সূত্র। ভালোবাসাই মহামূল্য, যা দিয়ে শান্তি কেনা যায়। শ্রীশ্রীঠাকুরের ধর্ম হচ্ছে ফলিত বিজ্ঞান, applied science.
আর সৎসঙ্গের উদ্দেশ্য কি?, "সৎসঙ্গ’-এর উদ্দেশ্য মানুষকে সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। সৎসঙ্গ কখনো সম্প্রদায়ে বিশ্বাস করে না। ধর্ম কখনও বহু হয় না-ধর্ম এক। হিন্দু ধর্ম, মুসলমান ধর্ম, খ্রীষ্টান ধর্ম ইত্যাদি সব মত। সপারিপার্শ্বিক জীবন-বৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলাই ধর্মের প্রধান লক্ষ্য। ধর্ম মূর্ত্ত হয় আদর্শে এবং শ্রীশ্রীঠাকুর হলেন ধর্মের মূর্ত্ত আদর্শ। তিনি কোন সম্প্রদায়-বিশেষের নন, বরং সব সম্প্রদায়ই তাঁর। শ্রীশ্রীঠাকুর বলেছেন-“একজন মানুষের বিনিময়ে আমি একটি সাম্রাজ্য ত্যাগ করতে পারি, কিন্তু একজন মানুষকে ছাড়তে পারি না।”
এবার আসি, আমরা কেন তাঁর জন্মদিন পালন করছি? কে তিনি? কেন তিনি এসেছিলেন?
এককথায় বলতে পারি, আমরা তাঁর জন্মদিন পালন করছি আমরা কেন জন্মেছি এটা জানার জন্য, বোঝার জন্য এবং সেইভাবে নিজেকে তাঁর মনের মত গড়ে তোলার জন্য। আর এই গড়ে তোলার পথ জন্মদিনে শুধু জাঁকজমকভাবে ফুল, আলো, মোমবাতি, ধূপ, ধুনো, কাঁসর, ঘন্টা, শঙ্খধ্বনি, গান, কীর্তন করার মধ্যে দিয়ে তথাকথিত তাঁর চরণপূজা করার জন্য নয়, তাঁর চলনপূজার মধ্যে দিয়ে নিজেকে তাঁর মনের মতো গড়ে তুলে তাঁর চরণতলে নিজেকে, নিজের জীবনকে উপহার দেওয়া।
আজ যার জন্মদিন পালন করছি তিনি হলেন বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের মালিক সৃষ্টিকর্তা, সৃষ্টির পরম উৎস, সৃষ্টির পরম কারণ, পরমপিতা, পরমপুরুষ, পুরুষোত্তম জীবন্ত ঈশ্বর শ্রীশ্রীরামচন্দ্র, শ্রীশ্রীকৃষ্ণ, শ্রীশ্রীবুদ্ধ, শ্রীশ্রীযীশু, শ্রীশ্রীবুদ্ধ, শ্রীশ্রীহজরত মহম্মদ, শ্রীশ্রীমহাপ্রভু, শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ-এর নোতুন রূপ The greatest phenomenon, the greatest wonder of the world শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র। তাঁর রাতুল চরণতলে আমার প্রণাম জানিয়ে সবার মঙ্গল প্রার্থনা ক'রে আমার শেষ আবেদন, আজ যে যেখানে আছে সবাই একসঙ্গে একজায়গায় নিজ নিজ কেন্দ্র মন্দিরে মিলিত হ'য়ে মিলেমিশে ঠাকুরের প্রাণে আনন্দ দিয়ে এই আনন্দ উপভোগ করি। জয়গুরু।
প্রকাশ বিশ্বাস।
ভদ্রকালী, উত্তরপাড়া।
আজকের এই আনন্দের দিনে আমি আমার সমস্ত সৎসঙ্গী গুরুভাইবোনেদের সঙ্গে আমার আনন্দ শেয়ার করার জন্য কিছু মনের কথা তুলে ধরছি। তুলে ধরছি আন্তরিক ও অকপটভাবেই শ্রীশ্রীঠাকুরের সোনার সৎসঙ্গী ও আমার প্রিয় সৎসঙ্গী গুরুভাইবোনেদের প্রতি একজন সৎসঙ্গী গুরুভাই হিসেবে ও সেই অধিকারে।
আমি মূলত দু'টি বিষয় সংক্ষেপে শেয়ার করবো আপনাদের সাথে। প্রথমত আসুন, আলোচনার মাধ্যমে জেনে নিই, শ্রীশ্রীঠাকুর কেন জন্মেছিলেন? যে মানুষটার আজ জন্মদিন পালন করছি সেই মানুষটা কেন জন্মেছিলেন সেটা সৎসঙ্গীদের তাঁর জন্মদিন পালনের সঙ্গে সঙ্গে জানা ও উপলব্ধি হওয়া দরকার। আর, তাঁর সঙ্গে সঙ্গে আমরাই বা কেন জন্মেছি? ও কেন তাঁর জন্মদিন পালন করছি? কে তিনি? কেন তিনি এসেছিলেন? এই সমস্ত বিষয় একটু জানা দরকার। নতুবা তাঁর জন্মদিন পালন আর একটা সাধারণ মানুষের জন্মদিন পালনের মত লক্ষ্যহীন উদ্দেশ্যবিহীন নিছক হতাশা, অবসাদ, ক্লান্তি, অস্থিরতায় ভরা জীবনে একটু হৈ হুল্লোড় করে জন্মদিন পালন করার মধ্যে দিয়ে আনন্দ উপভোগ করার চেষ্টা করা ও এই পালনের মধ্যে দিয়ে আর একটা ফ্যাকাশে দিনকে একটু রঙ্গীন ক'রে কটানো ছাড়া আর কিছুই নয়। ঐ দিনগত পাপক্ষয়। তারপর আবার সেই যে কে স্টীল অর্থাৎ পূর্বের অপরিবর্তনীয় ফাকাশে বর্ণহীন জীবন।
তাই আসুন এই সাময়িক আনন্দ উপভোগের সুযোগে আমরা আজ দেওঘরে ঠাকুরবাড়িতে, দেশে, বিদেশের কেন্দ্র, মন্দিরে, ঘরে, বাইরে যে যেখানে আছি আনন্দ করতে করতে, ঘুরতে ঘুরতে, চা খেতে খেতে, টিফিন খেতে খেতে, ঠাকুর নিয়ে গল্প করতে করতে, আড্ডা মারতে মারতে আসুন একটু মোবাইলে চোখ রাখতে রাখতে একবার পড়ে নিই শ্রীশ্রীঠাকুর কেন, কি কারণে জন্মেছিলেন, একটু জেনে নিই আমরাই বা কেন জন্মেছি? ও কেন তাঁর জন্মদিন পালন করছি? কে তিনি? কেন তিনি এসেছিলেন?
এইসমস্ত কিছু জানবো আমরা শ্রীশ্রীঠাকুর নিজে এই বিষয়ে কি বলেছেন
সেটা আলোচনা করার মধ্যে দিয়ে। আমার ব্যক্তিগত কোনও কথা এখানে নেই।
শ্রীশ্রীঠাকুর আমাদের দরদভরা কণ্ঠে বললেন,
" তুমি কেন জন্মেছ মোটাভাবেও কি দেখেছ ? থাকাটাকে কি উপভোগ ক'রতে নয় ---- চাহিদা ও কর্ম্মের ভিতর - দিয়ে পারস্পরিক সহবাসে ----- প্রত্যেকরকমে ? তেমনি বুঝছ না ভগবান কেন সৃষ্টি ক'রেছেন ? উত্তর কি এখন ?----- নিজেকে অনুভব ক'রতে , উপভোগ ক'রতে ---- বিশ্বে ,প্রত্যেক অনুপাতে --- দেওয়ায় , নেওয়ায় -- আলিঙ্গনে , গ্রহণে , কর্ম্মবৈচিত্রে , ----- নয় কি ? "
আসুন এবার কি ভেবে দেখি, তলিয়ে দেখি তিনি কি বলতে চেয়েছিলেন।
শ্রীশ্রীঠাকুরের কথামত আমি প্রকাশ বিশ্বাস কেন জন্মেছি একবারও কি ভেবে দেখেছি? সুক্ষ্মভাবে ভেবে দেখবার দরকার নেই, মোটাভাবেও কি ভেবে দেখেছি? দেখিনি। যদি ভেবে দেখতাম তাহ'লে এত দুঃখ, কষ্ট, এত অভাব অভিযোগ কি থাকতো? থাকতো না। এত রোগ, এত শোক, এত গ্রহদোষে আক্রান্ত হতাম? হতাম না। এত বুদ্ধিবিপর্যয় হ'তো? হ'তো না। এত দরিদ্রতা তা' সে আর্থিক দরিদ্রতা হ'ক, জ্ঞানের দরিদ্রতা হ'ক, প্রেম-ভালোবাসার দরিদ্রতা, চরিত্রের দরিদ্রতা হ'ক যে দরিদ্রতাই হ'ক এই দরিদ্রতার কষাঘাতে কি ক্ষতবিক্ষত হ'তাম? উত্তর কি? হতাম না।
তাহ'লে কি দাঁড়ালো? শ্রীশ্রীঠাকুরের কথামত আমি কি আমার এই যে থাকাটা, মানে আমার এই যে অস্তিত্ব এই থাকাটাকে, এই অস্তিত্বটাকে প্রকৃত উপভোগ করতে পেরেছি? পারছি? যদি প্রকৃত উপভোগ করতে পারতাম তাহ'লে আমি নানারকম রোগে, কতরকম আপনজনের বিয়োগ ব্যাথার শোকে, বিভিন্ন গ্রহদোষ অর্থাৎ গ্রহণদোষে, পদেপদে বুদ্ধিবিপর্যয়ে ও আর্থিক দরিদ্রতা, চরিত্রের দরিদ্রতা অর্থাৎ উচ্ছৃঙ্খল বিশৃঙ্খল রিপুতাড়িত জীবন এবং জ্ঞানের দরিদ্রতা অর্থাৎ অভাব, প্রেম-ভালোবাসার দরিদ্রতা বা অভাব অর্থাৎ আপনজনদের কাউকে প্রেম বা ভালবাসতে না পারা, ঠাকুরের যেমন পর ব'লে কেউ বা কিছু ছিল না, সবাই ছিল আপন, যেমন শ্রীশ্রীআচার্যদেব আমাদের বলেন, শিক্ষা দেন আপনজনকে ৫টাকা দিলে তোমার শত্রুকে ১০টাকা দিও, তার অসময়ে, বিপদে আপদে সবসময় পিছন থেকে খেয়াল রেখো এবং তোমার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিও তোমার যতটুকু ক্ষমতা তাই দিয়ে, এরকম যে জ্ঞানের দরিদ্রতা অর্থাৎ জ্ঞানের অভাব ইত্যাদি নানা দরিদ্রতার কষাঘাতে জর্জরিত হতাম না।
শ্রীশ্রীঠাকুর আমাকে বললেন, তুমি যদি থাকাটাকে উপভোগ করতে চাও তাহ'লে তোমার যেমন চাহিদা থাকবে তেমন কর্মও দরকার। চাহিদা ও কর্মের উভয়ের মিলন দরকার। চাহিদা ও কর্মের ভিতর দিয়ে পারস্পরিক মিলনের মধ্যে দিয়ে সবসরমভাবে থাকাটাকে তুমি উপভোগ করো। ব্যাপারটা কেমন? যেমন আমি একজন পুরুষ, আমার চাহিদা আছে। এই জগত সংসারে বেঁচে থাকার জন্য ও বেড়ে ওঠার জন্য আমার অন্ন, বস্ত্র, টাকাপয়সা, বাড়ি, গাড়ি্, নারী ইত্যাদি ইত্যাদি প্রয়োজনীয় জিনিস প্রয়োজন, ঠিক তেমনি নারীরও অন্ন, বস্ত্র, টাকাপয়সা, পুরুষ, বাড়ি, গাড়ি্ ইত্যাদি ইত্যাদি যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিস প্রয়োজন। তা এগুলি কোথা থেকে আসবে? আকাশ থেকে আসবে? ম্যাজিক ক'রে আসবে? গুপি গাইন বাঘা বাইনের মত হাততালি দিলেই মহাশূন্য থেকে আসবে? না, আসবে না। তা' আসবে তোমার চাহিদা অনুযায়ী তোমার কর্ম করার মধ্যে দিয়ে। চাহিদা ও কর্মের মিলনের মধ্যে দিয়ে। তোমার চাহিদা আর কর্মের মধ্যে পারস্পরিক সহবাস চাই অর্থাৎ একসঙ্গে চাহিদা ও কর্মকে স্বামীস্ত্রীর মত বাস করতে হবে, উপযুক্তভাবে মিলিত হ'তে হবে, তবেই তোমার ঈপ্সিত ফল লাভ হবে। এককথায় কর্ম ছাড়া ধর্ম পালন বা ঈশ্বর আরাধনায় কোনও কিছু পাওয়া যাবে না।
তাই শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন, তুমি কেন জন্মেছো যেমন ভেবে দেখতে বলেছেন ঠিক তেমনি ভেবে দেখতে বলেছেন, ভগবান কেন সৃষ্টি করেছেন? উত্তরে শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন, ভগবান সৃষ্টি করেছেন নিজেকে নিজে অনুভব করার জন্য, উপভোগ করার জন্য। কিভাবে উপভোগ করবেন তিনি? বিশ্বে যা কিছু আছে সব কিছুর মধ্যে ভগবান নিজেকে নানারকম বিচিত্র কাজের মধ্যে দিয়ে, নিজেকে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে, নেওয়ার মধ্যে দিয়ে, আলিঙ্গন করার মধ্যে দিয়ে, গ্রহণ করার মধ্যে দিয়ে তিনি নিজেকে নিজে অনুভব করার জন্য ও উপভোগ করার জন্যই সৃষ্টি করেছেন।
ঠিক একইরকমভাবে আমিও যদি নিজেকে, নিজের অস্তিত্বকে অনুভব করতে চাই, উপভোগ করতে চাই তাহ'লে ঠিক একইভাবে আমার চারপাশে ঘরে বাইরে সকলের সঙ্গে জীবনের সব দিক দিয়ে দয়া, মায়া, প্রেম, ভালোবাসা, সাহায্য, সহানুভূতি সব রকমভাবে দেওয়া-নেওয়া, আলিঙ্গম-গ্রহণের মধ্যে দিয়ে নিজেকে একইসঙ্গে এই দুনিয়াকে প্রকৃত অনুভব ও উপভোগ করতে পারবো। নতুবা এই জন্মদিন পালন মিথ্যা হ'য়ে যাবে, হ'য়ে যাবে বকোয়াস।
তাহ'লে আজ এই পবিত্র শুভ জন্মদিনে আমাদের তাঁর জন্ম পালন করার সময় মনে রাখতে আমরা সৎসঙ্গীরা একটা সর্ব্বশ্রেষ্ঠ আদর্শের পূজারী। আজকের দিনে আমাদের বুঝতে হবে, দেশ বিদেশে চতুর্দিকে নানারকম আন্দোলন হচ্ছে। সত্যি মিথ্যার আন্দোলন। আর, আমাদের সৎসঙ্গীদের সৎসঙ্গও হচ্ছে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র প্রবর্তীত একটা আন্দোলন, ধর্মীয় আন্দোলন। এই ধর্মীয় আন্দোলনের আদর্শ হচ্ছে, ধর্ম কোনও অলৌকিক ব্যাপার নয় বরং বিজ্ঞানসিদ্ধ জীবন সূত্র। ভালোবাসাই মহামূল্য, যা দিয়ে শান্তি কেনা যায়। শ্রীশ্রীঠাকুরের ধর্ম হচ্ছে ফলিত বিজ্ঞান, applied science.
আর সৎসঙ্গের উদ্দেশ্য কি?, "সৎসঙ্গ’-এর উদ্দেশ্য মানুষকে সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। সৎসঙ্গ কখনো সম্প্রদায়ে বিশ্বাস করে না। ধর্ম কখনও বহু হয় না-ধর্ম এক। হিন্দু ধর্ম, মুসলমান ধর্ম, খ্রীষ্টান ধর্ম ইত্যাদি সব মত। সপারিপার্শ্বিক জীবন-বৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলাই ধর্মের প্রধান লক্ষ্য। ধর্ম মূর্ত্ত হয় আদর্শে এবং শ্রীশ্রীঠাকুর হলেন ধর্মের মূর্ত্ত আদর্শ। তিনি কোন সম্প্রদায়-বিশেষের নন, বরং সব সম্প্রদায়ই তাঁর। শ্রীশ্রীঠাকুর বলেছেন-“একজন মানুষের বিনিময়ে আমি একটি সাম্রাজ্য ত্যাগ করতে পারি, কিন্তু একজন মানুষকে ছাড়তে পারি না।”
এবার আসি, আমরা কেন তাঁর জন্মদিন পালন করছি? কে তিনি? কেন তিনি এসেছিলেন?
এককথায় বলতে পারি, আমরা তাঁর জন্মদিন পালন করছি আমরা কেন জন্মেছি এটা জানার জন্য, বোঝার জন্য এবং সেইভাবে নিজেকে তাঁর মনের মত গড়ে তোলার জন্য। আর এই গড়ে তোলার পথ জন্মদিনে শুধু জাঁকজমকভাবে ফুল, আলো, মোমবাতি, ধূপ, ধুনো, কাঁসর, ঘন্টা, শঙ্খধ্বনি, গান, কীর্তন করার মধ্যে দিয়ে তথাকথিত তাঁর চরণপূজা করার জন্য নয়, তাঁর চলনপূজার মধ্যে দিয়ে নিজেকে তাঁর মনের মতো গড়ে তুলে তাঁর চরণতলে নিজেকে, নিজের জীবনকে উপহার দেওয়া।
আজ যার জন্মদিন পালন করছি তিনি হলেন বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের মালিক সৃষ্টিকর্তা, সৃষ্টির পরম উৎস, সৃষ্টির পরম কারণ, পরমপিতা, পরমপুরুষ, পুরুষোত্তম জীবন্ত ঈশ্বর শ্রীশ্রীরামচন্দ্র, শ্রীশ্রীকৃষ্ণ, শ্রীশ্রীবুদ্ধ, শ্রীশ্রীযীশু, শ্রীশ্রীবুদ্ধ, শ্রীশ্রীহজরত মহম্মদ, শ্রীশ্রীমহাপ্রভু, শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ-এর নোতুন রূপ The greatest phenomenon, the greatest wonder of the world শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র। তাঁর রাতুল চরণতলে আমার প্রণাম জানিয়ে সবার মঙ্গল প্রার্থনা ক'রে আমার শেষ আবেদন, আজ যে যেখানে আছে সবাই একসঙ্গে একজায়গায় নিজ নিজ কেন্দ্র মন্দিরে মিলিত হ'য়ে মিলেমিশে ঠাকুরের প্রাণে আনন্দ দিয়ে এই আনন্দ উপভোগ করি। জয়গুরু।
প্রকাশ বিশ্বাস।
ভদ্রকালী, উত্তরপাড়া।
No comments:
Post a Comment