বাস ছুটে চলেছে হাওড়ার দিকে। ভিড় বাড়তে লাগলো ক্রমশ। কন্ডাক্টর আমাকে আর আমার স্ত্রীকে ভিতরের দিকে এগিয়ে যেতে অনুরোধ করল। বাসের সব সীটেই নারী পুরুষে ভর্তি। একটা সিটও খালি নেই। আমরা পিছনের দিকে একটু এগিয়ে গেলাম। স্ত্রী লেডিস সিটের সামনে রড ধরে দাঁড়ালো। আমি তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছি। বাস যত এগিয়ে চলেছে তত ভিড় বাড়ছে। আমার স্ত্রীর সামনে লেডিস সীটে দুজন মহিলা বসে আছে। স্ত্রীর সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটি অল্প বয়সী ছেলে আর সীটের সামনে বসে আছে ঐ ছেলেটির বয়সী একটি মেয়ে। দুজনেই আমার ছেলের বয়সী। বড়জোর ২০/২২ বছর বয়স হবে। বোঝা গেল দুজনে দুজনের পরিচিত। ওরা দুজনে গল্প করছিল। নিজেদের মধ্যে অনবরত কথা বলে যাচ্ছিল দুজনে। কথা বলছিল হিন্দিতে। একদিকে ভিড় তায় আবার গরম। ভিড়ে ঠাসা গরমে হাঁসফাঁস করছিল প্রাণটা। এরই মাঝে একটানা দুজন অল্পবয়সী ছেলেমেয়ের ক্লান্তিহীন যৌবনের উচ্ছ্বাস!!! দুজনের কথা, হাসি কানের মধ্যে আছড়ে পড়ছিল। মনে বিরক্ত বোধ হলেও বিবেকের ডাকে সাড়া দিয়ে এই ভিড়ে ঠাসা গরমের মাঝেও তাদের অমলিন আনন্দের অকৃত্রিম উচ্ছ্বাসকে সাদরে স্বীকৃতি দিলাম। স্ত্রীর দিকে চেয়ে দেখলাম ঘামে নেয়ে উঠেছে যেন। মাঝে মাঝে ঝাঁকানিতে টলে উঠছিল শরীরটা। মনে মনে ভাবলাম কেন যে উঠলাম বাসে। আর একটু চেষ্টা করলে হয়তো একটা ট্যাক্সি পেতাম। যাই হোক মনকে তৈরি করে রেখেছিলাম ঠাকুরের বলে যাওয়া 'সব অবস্থার জন্য রাজী থাকো, দুঃখ তোমার কি করবে?' কথাকে স্মরণ করে। স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলাম দাঁড়াতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা। উত্তরে স্ত্রী খুব স্বাভাবিকভাবেই বলল, কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। আমিও মনে মনে অন্য বিষয়ে মনোনিবেশ করলাম। এইভাবে কিছুক্ষণ চলার পর দেখলাম স্ত্রীর সামনে বসা মেয়েটি স্ত্রীকে উদ্দেশ্য ক'রে কি যেন বলছে। ভাবলাম কি জানি স্ত্রীর সঙ্গে দাঁড়ানো নিয়ে কোনো ঝামেলা হ'ল কিনা। অন্যমনস্ক থাকায় খেয়াল করিনি ব্যাপারটা। সামনে দঁড়ানো দুজনের মাঝখান দিয়ে মাথাটা গলিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম ব্যাপারটা। শুনলাম মেয়েটি বলছে, আন্টি আপ বৈঁঠিয়ে। কথাটা বলেই মেয়েটি সিট থেকে উঠে পড়লো আর আবার বলল, আপ বৈঁঠিয়ে। স্ত্রী অনিচ্ছাসত্ত্বেও মেয়েটির আন্তরিক আহ্বানে সেই ফাঁকা সীটে বসে পড়লো। আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। যাক অবশেষে সীট পাওয়া গেল। এখনও হাওড়া অনেকদূর। মনে মনে ঠাকুরকে ধন্যবাদ জানালাম। ভাবলাম যাক মেয়েটি সামনে নেবে যাবে। ভাগ্যিস মেয়েটি হাওড়ার যাত্রী নয়। এবার আমি একটু নিশ্চিন্ত হ'লাম। বাস এগিয়ে চলেছে। আমিও আবার নিজের মনের গভীরে ডুব দিলাম। এইভাবে কতক্ষণ কেটে গেল খেয়াল করিনি। হঠাৎ সামনে দাঁড়ানো ছেলেমেয়ে দুটির হাসির ঝলকানিতে সম্বিত ফিরে পেলাম। মনে মনে ভাবলাম আরে মেয়েটা তো এখনো নাবেনি! অবাক হয়ে গেলাম! ভাবলাম তাহ'লে হয়তো সামনেই নাববে। একটু আগেই দাঁড়িয়ে পড়েছে বাস থেকে নাবতে সুবিধা হবে বলে কিম্বা দু'জনের কথা বলার সুবিধা হবে। কিন্তু দেখলাম বাস ক্রমশ ছুটে চলেছে আর এদেরও সামনে নাবার কোনো সম্ভাবনাই নেই। একই জায়গায় দাঁড়িয়ে কথা বলে চলেছে দুজনে। ভাবলাম সামনে যদি কোথাও নাবে তাহ'লে তো দরজার সামনে এগিয়ে যাবে। কিন্তু তাও দেখলাম না। এইভাবে মনে মনে ভাবতে লাগলাম সামনে নাববে, সামনে নাববে আর ভাবতে ভাবতেই দেখলাম বাস ব্রিজের ওপরে উঠে পড়েছে। বুঝতে আর কিছুই বাকী রইলো না। আর তারপর একসময় বাস এসে থামলো ব্রিজ পার হ'য়ে তার নির্দিষ্ট জায়গায়। সবাই নাবতে লাগলো। আমিও এগিয়ে গেলাম ধীরে ধীরে দরজার দিকে তারপর নেবে পড়লাম বাস থেকে। দেখলাম বাস থেকে নেবে আসছে ছেলেমেয়ে দুজন হাসতে হাসতে আর পিছন পিছন আমার স্ত্রীও নেবে এলো। আমার পাশ দিয়ে দুজন চলে যাবার সময় মনে হ'ল মেয়েটি কি নির্বিকার! নিজে এতটা রাস্তা কষ্ট ক'রে হাসিঠাট্টার মধ্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এলো আর চোখেমুখে তার কোনও ছাপ নেই। মেয়েটি হনহন ক'রে এগিয়ে গেল সামনের দিকে। পিছন পিছন ছেলেটি আস্তে আস্তে ভিড় ঠেলে এগিয়ে চলেছে। আমি পাশ দিয়ে যাবার সময় ছেলেটিকে পিঠে হাত দিয়ে ডাকলাম। ছেলেটি ঘুরে দাঁড়ালো। আমি তাকে মেয়েটিকে ডেকে দিতে বললাম। ছেলেটি অবাক হ'য়ে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে তারপরে মেয়েটিকে ডাকলো। মেয়েটি কাছে এলে আমি স্ত্রীকে বললাম এই সেই মেয়েটি যে তোমাকে ভিড় বাসে ভ্যাপসা গরমে জায়গা ছেড়ে দিয়ে দীর্ঘ রাস্তা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসেছে! কথাটা বলেই মেয়েটির মাথায় হাত দিয়ে আমি প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করলাম। মেয়েটি আমার কথা শুনে হাসতে হাসতে ব্যাপারটাকে উড়িয়ে দিয়ে বলল, নেহি, নেহি উহ ঠিক হ্যায়, উহ কুছ নেহি। আমি আশীর্বাদ ক'রে হাসি মুখে বললাম, থ্যাংকস! ছেলে আর মেয়েটা দুজনে হনহন ক'রে চলে গেল ট্রেন ধরবে বলে। ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেল দুজনে। আমরা দু'জনে হাঁটতে হাঁটতে সাব ওয়ের দিকে এগিয়ে গেলাম। তারপরে প্ল্যাটফর্মে এসে ট্রেনে উঠে বসলাম। এক সময় ট্রেন ছেড়ে দিল। ট্রেন ছুটে চলেছে আর মাথার মধ্যে মেয়েটির মানবিক আচরণ আমাকে মনে পড়িয়ে দিল ঠাকুরের বাণীঃ
"মেয়ে আমার, তোমার সেবা, তোমার চলা, তোমার চিন্তা, তোমার বলা পুরুষ জনসাধারণের ভিতর যেন এমন একটা ভাবের সৃষ্টি করে---- যা'তে তারা অবনত মস্তকে, নতজানু হ'য়ে সসম্ভ্রমে, ভক্তিগদ্গদ কন্ঠে-----'মা আমার,----জননী আমার'! ব'লে মুগ্ধ হয়, বুদ্ধ হয়, তৃপ্ত হয়, কৃতার্থ হয়,----তবেই তুমি মেয়ে, তবেই তুমি সতী।"
ট্রেন এসে থামলো উত্তরপাড়া স্টেশনে। আমি নেবে পড়লাম। স্ত্রী উঠেছিল লেডিস কম্পার্ট্মেন্টে। আমি তার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। ট্রেন থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে লোক নেবে এল প্ল্যাটফর্মে। ভিড়ের মাঝে ট্রেনের পিছন দিকে প্ল্যাটফর্মের ভিড়ের মাঝে চেয়ে রইলাম স্ত্রীর অপেক্ষায়। ট্রেন ছেড়ে দিল। হঠাৎ পাশ দিয়ে একজন ভিড়ের মাঝখান দিয়ে চলে গেল ফোনে কথা বলতে বলতে, মিশে গেল দূরে আরও ভিড়ের মাঝে। দেখলাম সেই মেয়েটিকে। মেয়েটির সঙ্গে আবার দেখা হ'ল। শুনলাম মেয়েটি ফোনে মাকে জানান দিচ্ছে সে এসে গেছে, এখন সে আছে উত্তরপাড়া স্টেশনে। ভিড়ের মাঝে হারিয়ে গেল মেয়েটি। জানি না আর কোনোদিন দেখা হবে কিনা। ( লেখা ৭ই সেপ্টয়েম্বর' ২০১৬)
No comments:
Post a Comment