একাত্তর ও চব্বিশ যে সমান নয় এটা বাংলাদেশের প্রতিটি দলই জানে, তা' তারা স্বীকার করুক আর না করুক। সত্যকে যারা অস্বীকার করে, অসম্মান, অশ্রদ্ধা, অমর্যাদা করে তারা ঈশ্বর, আল্লা বা গডের অস্তিত্বকে অস্বীকার, অসম্মান, অশ্রদ্ধা ও অমর্যাদা করে। আর তাদের পরিণতি হয় ভয়ংকর, ভয়াবহ। কারণ ঈশ্বর, আল্লা বা গড অকৃতজ্ঞ, বেইমান আর নেমকহারামকে কখনই কোনোদিনই ক্ষমা করেনি ও করেনা। সত্যকে অস্বীকার করা মানে স্বয়ং ঈশ্বর, আল্লা বা গডকে অস্বীকার করা।
আর, মিথ্যাকে মান্যতা দেওয়া মানে শয়তানের পৃষ্টপোষকতা করা।
মহম্মদ ইউনুস একাত্তরের সত্যকে রি-সেট বাটন টিপে মুছে দিতে চেয়েছিলেন। আর, চব্বিশের মিথ্যাকে করতে চেয়েছেন জোর ক'রে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। তিনি জানতেন বাঙালী জাতির বুক থেকে উদ্ভুত, আত্মা থেকে জাগ্রত একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রাম, অবাঙ্গালীদের বাংলা ও বাঙ্গালীর ওপর অত্যাচার, লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, বলাৎকার থেকে মুক্তি, শিরায় শিরায়, কোষে কোষে, রক্ত কণিকার অভ্যন্তরে স্বাধীনতার যে বিস্ফোরণ সেই সংগ্রাম, সেই মুক্তি, সেই বিস্ফোরণ ছিল বাঙ্গালীর স্বতস্ফুর্ত সংগ্রাম, মুক্তি ও বিস্ফোরণ। তা' ছিল স্বতঃ উৎসারিত। সেই স্বতঃ উৎসারিত সংগ্রাম, মুক্তি ও বিস্ফোরণের ভাগীদার ছিল না মহম্মদ ইউনুস। তিনি সেই ৭১এর স্বাধীনতা, মুক্তি ও বিস্ফোরণের লড়াইয়ে দেশের অভ্যন্তরে পাক সৈন্যদের দ্বারা সৃষ্ট শ্বশানভূমির ওপর ছিলেন না। তিনি সেই সময় ছিলেন আমেরিকার স্বর্গদ্যানে। তার শরীরে সেই ৭১-এর অগ্নিদগ্ধ বাংলার তাপ লাগেনি, ফোস্কার চিহ্ন নেই। তিনি সেই সময় ছিলেন ভরা যৌবনের অধিকারী তিরিশের টগবগে যুবক। তাঁর একবারও মনে হয়নি তাঁর মাতৃভূমির ওপর পাক সেনাদের দ্বারা বলাৎকারের সময় তাঁর মাতৃভূমি তাঁকে পাশে পেতে চেয়েছিল। তখন তিনি অগ্নিদগ্ধ রোমের নিরোর বেহালা বাজানোর মত নিজের ক্যারিয়ার গড়া নিয়ে ছিলেন মগ্ন। তাঁর মাতৃভূমি বাংলার ক্যারিয়ার যে ধর্ষিত হচ্ছে পাক সেনাবাহিনীর দ্বারা সে সম্পর্কে তাঁর ছিল না বিন্দুমাত্র অনুভূতি। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পেতে চেয়েছিলেন পূর্ণ মর্যাদা। কিন্তু সেই পূর্ণ মর্যাদা না পাওয়ার কারণে তাঁর মনে জন্মেছিল অতৃপ্তি, ক্ষোভ। স্বাধীনতা পরবর্তী আওয়ামী লীগ তাঁকে দেয়নি তাঁর পান্ডিত্যের যোগ্য সম্মান। ফলে মহম্মদ ইউনুসের মনে জন্মেছিল ক্ষোভ। আওয়ামী লীগ প্রধান যদি তাঁকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করতেন, তাঁর জ্ঞান, তাঁর পান্ডিত্যকে দেশের উন্নয়নে কাজে লাগাতে পারতেন কৌশলী দক্ষতায়, আর মহম্মদ ইউনুস, তিনি নিজে যদি তাঁর পান্ডিত্য, তাঁর জ্ঞানকে সঠিক সময়ে সঠিক ভাবে যোগ্যতা ও দক্ষতার সঙ্গে কাজে লাগাতে পারতেন দেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাহ'লে কতটা উপকৃত হ'তো বাংলাদেশ তা' জানিনা, কিন্তু নিঃসন্দেহে আজকের পরিস্থিতির সৃষ্টি হ'তো না। বাংলাদেশের আজকের অস্থির পরিস্থিতি আওয়ামী লীগ প্রধান, বর্তমান প্রধান উপদেষ্টা মহম্মদ ইউনুস ও দেশের জনগণ সবার জন্যই ক্ষতিকর ও বিষাক্ত মারণ বিষ বহনকারী।
আর, চব্বিশের যে জুলাই অভ্যুত্থানকে যে জনগণের অভ্যুত্থান, জনগণের বিপ্লব ব'লে স্বীকৃতি দেওয়ার চেষ্টা করছেন মহম্মদ ইউনুস ও কোটা আন্দোলন ও বৈষম্য বিরৈধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা তা' সর্বৈব মিথ্যা, একথা জনগণ জানে কিন্তু পরিস্থিতি ও পারিপার্শ্বিকের চাপে তা গুলিয়ে যায়। এই আন্দোলন যে মিথ্যা ছিল তার কারণ,
১) এই আন্দোলন প্রথমে ছিল শুধু ছাত্রদের আন্দোলন।
২) এই আন্দোলন প্রথমে ছিল কোটা বিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
৩) এই আন্দোলন প্রথমে ছিল ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলন।
৪) এই আন্দোলন প্রথমে ছিল বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন।
ছাত্রদের এই আন্দোলনের দাবী মেনে নিয়েছিলেন হাসিনা সরকার। কোটা সংস্কার নয় কোটা সিস্টেমটাকেই উঠিয়ে দিয়েছিলেন, তুলে নিয়েছিলেন, বিলুপ্ত করে দিয়েছিলেন। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের একটা অংশ হাসিনা সরকারের কোটা সিস্টেম তুলে দেওয়ার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিষয়টিকে দেশের সর্ব্বোচ্চ আদালতের ওপরে ন্যস্ত করেন।
ঠিক এই সময়, এই মাহেন্দ্রক্ষণে ঘুরতে থাকে চাকা। পরিস্থিতির বদল হ'তে থাকে। এই যে মুক্তি যোদ্ধারা বা তাঁদের উত্তরসূরীরা হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে কোর্টে গেল এইটাই ছিল টার্নিং পয়েন্ট। এর মধ্যেই চক্রান্তের বীজ হয়তো নিহিত ছিল নতুবা নোতুন ক'রে এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে চক্রান্তের বীজ জন্ম নিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী হাসিনা সরকারের যথাসময়ে এ ব্যাপারে সচেতন ও সতর্ক হওয়া ও উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিৎ ছিল। উচিৎ ছিল হাইকোর্টের কোটা পুনর্বহাল করার রায়কে সুপ্রীম কোর্টে পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গে ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ ও সমন্বয় রক্ষা করা এবং আলোচনা চালানো। এছাড়া হাসিনা সরকারের উচিৎ ছিল ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধি ও হাইকোর্টে যাওয়া কোটা সমর্থিত মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া এবং দ্রুত ভারসাম্যরক্ষাকারী একটা সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছনো। উচিৎ ছিল দেশের প্রচার মাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে দ্রুততার সঙ্গে বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের কাছে সরকারের সদিচ্ছাকে তুলে ধরা, পৌঁছে দেওয়া।
কিন্তু এইগুলির কোনওটাই হয়নি। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বাজিমাৎ ক'রে বেড়িয়ে যায় ছাত্র আন্দোলনকারী নেতারা। হয় তাদের আন্দোলনের পট পরিবর্তন। এই পট পরিবর্তন হয়তো বা পূর্বপরিকল্পিত ছিল নতুবা উদ্ভূত সুযোগ বা অবস্থাকে দ্রুত কাজে লাগিয়েছিল হাসিনা বিরোধীরা ছাত্রদের আন্দোলনকে মূল্ধন ক'রে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুপ্রীম কোর্টের রায়ের ওপর নির্ভর ক'রে অপেক্ষা করা, কালক্ষেপ করা ছিল তাঁর মারাত্মক রকমের ভুল ও আত্মহত্যার সামিল। দেশের আইন ব্যবস্থা ও গোয়েন্দা ব্যবস্থা প্রধানমন্ত্রী হাসিনাকে সঠিক সময়ে সঠিক ও উপযুক্ত রূপে সাহায্য করতে ব্যর্থ হয়েছিল। আর, তা' হয়েছিল হয় সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃতভাবেই নতুবা অনিচ্ছাকৃতভাবে পরিস্থিতি আগাম বুঝতে না পেরে।
দেশের আগুন পরিস্থিতিতে সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে এই বিলম্বিত সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ছাত্র আন্দোলন দ্রুত তার আসল রূপে বা ভূমিকায় ফিরে আসে। ,
প্রথমে,
১) এই আন্দোলন জনগণের আন্দোলন ছিল না, ছিল ছাত্র আন্দোলন।
২) এই আন্দোলন সরকার বিরোধী আন্দোল্ন ছিল না, ছিল ছাত্রদের দাবী দাওয়ার আন্দোলন।
৩) এই আন্দোলন ছাত্রদের সরকার উৎখাতের আন্দোলন ছিল না, কোটা সংস্কার আন্দোলন।
পরিস্থিতির সুযোগকে কাজে লাগিয়ে,
১) এই আন্দোলন ঘুরে গেল ছাত্র-নাগরিক যৌথ আন্দোলনে।
২) এই আন্দোলন ঘুরে গেল সরকার বিরোধী আন্দোলনে।
৩) এই আন্দোলন ১৮০ ডিগ্রী ঘুরে গেল সরকার উৎখাতের আন্দোলনে।
ছাত্র রাজনীতি ও ছাত্র আন্দোলন পরিণত হ'লো ছদ্ম রাজনীতি ও ছদ্ম ছাত্র আন্দোলনে। Pseudo politics, Pseudo student movement কি জিনিস দেখতে পেল গোটা দূনিয়া ও দুনিয়ার ছাত্র সমাজ। সমগ্র বিশ্বের সাধারণ ছাত্র সমাজ কিছু বুঝতে বা শিখতে পারলো কি বাংলাদেশের এই ছাত্র আন্দোলন থেকে? যদিও সাধারণ ছাত্রছাত্রী এত খবর পায় না, রাখেও না। রাখার প্রয়োজন মনে করে না। আর, সেই সুযোগকে কাজে লাগায় ভবিষ্যতের ছদ্ম ছাত্র রাজনীতি ও ছদ্ম ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছাত্র সমাজ।
ঠিক এইরকম ছদ্ম ছাত্র রাজনীতির জুতোয় পা গলিয়ে রাতারাতি কোটা আন্দোলন, বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের পাট চুকিয়ে 'হাসিনা হঠাও, দেশ বাঁচাও' আন্দোলনে মেতে উঠলো ছাত্র আন্দোলনকারীরা। দ্রুত সেই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লো কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়িয়ে স্কুল চত্বরে সমস্ত স্তরের ছাত্রছাত্রীদের মাঝে। ছড়িয়ে পড়লো ছাত্র আন্দোলন ছাত্র ক্যাম্পাস ছাড়িয়ে মাঠে ময়দানে, গ্রামে গঞ্জে, শহরে নগরে আম জনতা মাঝে। হাসিনা ও তাঁর সরকার বুঝতেও পারেনি দেশের ছাত্র, যুব, শ্রমিক, আম জনতার দ্রুত মানসিক পরিবর্তন। এই প্রথম দেশের প্রাইমারী থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সমস্ত স্তরের ছাত্রদের মধ্যে সফলভাবে ছড়িয়ে পড়লো ছাত্র আন্দোলন অদৃশ্য হাতের রিমোট কন্ট্রোলে।
ক্রমশ
( ২৮শে মার্চ'২০১৫)
No comments:
Post a Comment