(প্রকাশ, ২০শে ফেব্রুয়ারী '২০)
যত হাসি তত কান্না!?
ঘড়িতে তখন দুপুর ৩টে। আমি তখন ঘরে নিজের ব্যক্তিগত কাজে মগ্ন। শরীরটা বেয়াড়াপনা করছে দু'দিন ধ'রে। সিজন চেঞ্জের ধাক্কা ছাড়া আর কিছুই নয়। এ সময়টা সাবধানে থাকতে হয়; থাকি, তবুও হ'য়ে যায় এদিক ওদিক। আসলে বিশৃঙ্খলাই হ'য়ে গেছে আমার জীবনের শৃঙ্খলা আর তার ফল তো পেতে হবে। যাই হ'ক, আসল কথায় আসা যাক। ঘরে ব'সে যখন নিজের কাজ করছি তখন হঠাৎ একটা চীৎকার ভেসে এলো। একটা তীক্ষ্ণ চীৎকার। সেই চীৎকারে জড়িয়ে রয়েছে তীব্র যন্ত্রণা। বুঝলাম চীৎকারটা ভেসে আসছে বাড়ীর দোতলা থেকে। আমি উৎকণ্ঠায় নিজের মনেই ব'লে উঠলাম, কি হয়েছে রে!? পাশের ঘর থেকে মেয়ে ব'লে উঠলো, ছোটমা কাঁদছে। কথাটা বলেই মেয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে, চলে গেল সিঁড়ি দিয়ে দোতলায়। মনঃসংযোগে চিড় ধরলো। ছেলে তার বড় জেঠুর ঘরে ব'সে খেতে খেতে টিভি দেখছিল। খাওয়া ছেড়ে উঠে এসে বললো, বাবা, ছোটমা ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে। আমি বললাম, কেন কাঁদছেরে? ছেলে বললো, মা ওয়াশ করছে তো তাই জ্বালা আর যন্ত্রণায় কাঁদছে। ওয়াশের সময় আর ওষুধ লাগাবার সময় তীব্র জ্বালাযন্ত্রণা করে। তারপরে ধীরে ধীরে কমে যায়। খুব কষ্ট পাচ্ছে ছোটমা। আমি চুপ ক'রে শুনছিলাম। কিছুক্ষণ চুপ ক'রে থেকে বললাম, ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা কর ছোটমার জন্য। কথাটা ব'লে চুপ ক'রে গেলাম। উপর থেকে ভেসে আসতে লাগলো যন্ত্রণাময় কান্নার সুতীক্ষ্ণ স্বর ক্রমাগত। ছেলেমেয়ে আজ দু'জনেই ছুটিতে, তাই অফিস যায়নি। ঘরটা বেশ ভর্তি ভর্তি লাগছে। এতে মনে বেশ জোর অনুভব হয়, নিজেকে অসহায় লাগে না। এমনিতে শরীরটা খারাপ আর মনটাও ভালো নেই তার উপরে আজ বালটিকুড়িতে ঠাকুরের উৎসব, সেখানে বিশেষ অতিথি হিসেবে যাওয়ার নিমন্ত্রণ আছে। কি করবো বুঝতে পারছি না। ঐ তীক্ষ্ণ চীৎকারটা সব ওলটপালট ক'রে দিচ্ছে।
মনে পড়ে যাচ্ছে এক বছর আগের সন্ধ্যাবেলার কথা। দুপুরের অনুষ্ঠান বাড়ি থেকে সন্ধ্যেবেলায় ফিরেই ঘটনাটা ঘটেছিল। হঠাৎ বৌদির হাত থেকে পড়ে যাছিল বারবার হাতের গ্লাসটা। যতবারই তুলতে যাচ্ছে ততবারই হাত থেকে ফসকে যাচ্ছে গ্লাস। তারপর কোনরকমে বারান্দা থেকে ঘরে ঢুকেই বিছানায় এলিয়ে পড়া, বমি, মুখ বেঁকে যাওয়া ইত্যাদি। তারপর দৌড়ে ডাক্তার ডাকতে যাওয়া এবং যথারিতি ডাক্তারের না আসা রবিবার ব'লে এবং অ্যাম্বুলেন্স ডেকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া এবং যথারী্তি পরবর্তী সময়ে পিয়ারলেস হসপিটালে ভর্তি করা ইত্যাদি করা হ'ল। তারপর পিয়ারলেসে সেরিব্রাল অপারেশনের পর ও দীর্ঘদিন হাসপাতালে থাকার পর বাড়ি ফিরে এলো এবং যথারীতি বাড়ির লোক ভিখিরিতে পরিণত হ'ল।
দীর্ঘ একবছর বিছানায় শুয়ে থাকার পর হঠাৎ কয়েকদিন আগে পুনরায় শরীর খারাপ হয় এবং পুনরায় আর,জি,করে ভর্তি করা হয় এবং দু'দিন পর বাড়ি ফিরে আসে। এই দুদিনেই যেটা ঘটার ঘটে গেল, পিঠে ঘা হ'য়ে গেল। ঘরে একবছর শুয়ে থেকে যা হয়নি তাই হ'য়ে গেল দু'দিনেই। কারণ সেখানে টানা দু'দিন বিছানায় শুয়ে ছিল একইরকম ভাবে। ডানদিক পুরোপুরি অকেজো হ'য়ে যাওয়াই কেউ ছিল না হাসপাতালে উঠিয়ে বসাবে, পাশ ফিরিয়ে শোয়াবে। ঐ সব সরকারী হাসপাতালে নার্সিং ফার্সিং এর আশা করতে নেই; কারণ শিব ঠাকুরের আপন দেশে আইন কানুন সর্বনেশে। আর তাই যা হবার হয়ে গেল, হ'য়ে গেল বেডসোর। তাই সেই বেডসোরের জায়গাটা আমার সহধর্মিণী প্রতিদিন ওয়াশ ক'রে দেয়। আর এই ওয়াশের ফলে হয় অসহ্য জ্বালা যন্ত্রণাস্বরূপ ঐ কান্না। হাসপাতালে এই দুদিন সময়ের ব্যবধানেই হ'য়ে গেছিল ঐ ঘা। কি অদভুত আমার দেশ!!!!!!
কয়েকদিন ধ'রেই শুনে আসছিলাম কান্নাটা কিন্তু আজ যেন কান্নাটা শুনে মনে হ'ল চিন্তা জগতে হঠাৎ ক'রে একটা নতুন উপলব্ধির মাত্রা যোগ হ'ল। অনেক কিছু ভেসে এলো মনের মধ্যে, চোখের সামনে দিয়ে যেন একে একে ভেসে যাচ্ছে ছবিগুলি। মন্ত্রমুগ্ধের মত মৌন হ'য়ে বসে রইলাম ঘরের মধ্যে ঠাকুরের ফটোর দিকে চেয়ে আর দেখলাম ছবিগুলি আমায় হাত নাড়তে নাড়তে বিষন্ন মনে বিদায় নিচ্ছে।
ছবি এক, ছবি দুই, ছবি তিন, চার, পাঁচ ক'রে এগিয়ে চলেছে। হঠাৎ একটা ছবি থেকে কানে ভেসে এলো উচ্চস্বরে তীক্ষ্ণ হাসি। দেখলাম, ঘরের সামনে যে লম্বা বারান্দা সেখানে বসে আছে সবাই চেয়ারে যত্রতত্র। কেউ দাঁড়িয়ে আছে সামনে, পিছনে। চলছে নানা গল্প, নানা জল্পনা। এই আড্ডার কুশীলবরা সব বাড়ীর বৌয়েরা আর তাদের দাদামণি অর্থাৎ আমার বড়দা। সঙ্গে থাকে বাড়ীর ছেলেমেয়েরা। সবাই হৈ হৈ ক'রে ছোটায় জমাটি আড্ডার রেলগাড়ি। কেউ কারও চেয়ে কম নয়। এর মধ্যে একজনের উপস্থিতি বিশেষ হ'য়ে ওঠে। তিনি হ'লেন আমার ছোড়দার বৌ। গল্পের গরু যখন গাছে ওঠে, আড্ডা যখন জমাট বেঁধে ওঠে, তখন ঐ হাসি, ঠাট্টা, হট্টোগোলের মাঝে বৌদির হাসি এক লহমায় ভাসিয়ে নিয়ে যেত সবাইকে দিগন্তপারে। কথাটা বললাম এই জন্যে যে, বৌদির হাসির তীব্রতা এত বেশী আর এত তীক্ষ্ণ যে অনেকদূর থেকে তা শোনা যেত; এতটাই ছিল প্রাণবন্ত ও উদ্দাম হাসির গতি ও তীব্রতা। তেমনি এরকমই একদিনের ছবি মনের কোটায় ভেসে উঠলো। আর ভেসে ওঠা মাত্রই ঐ ঘটনার সঙ্গে আজকের ঘটনার অন্তর্নিহিত গভীর অর্থের সম্পর্কজনিত ইঙ্গিতে গভীর বিষন্নতায় ভ'রে গেল মন প্রাণ। একটা অবসাদ যেন সাপের মত পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে উঠে আসতে লাগলো পা বেয়ে উপর দিকে। একটা অব্যক্ত বোবা যন্ত্রণায় নীল হ'য়ে যেতে লাগলো মন, হৃদয়। আজ নিজেকে বড় অসহায় মনে হ'তে লাগলো। মনে হ'তে লাগলো যে বিরাট এক শূন্যতার মধ্যে ডুবে যাচ্ছি ক্রমশঃ; চারিদিকে শুধু গভীর নিস্তব্ধতা আর জমাট অন্ধকার!
সেই তীক্ষ্ণ হাসি আর তার তীব্রতা আমাকে সহসা যেন ঝড়ের বেগে আছড়ে এনে ফেললো আজকের একটু আগের তীক্ষ্ণ যন্ত্রনার তীব্র চীৎকারের পরিবেশে। মুহূর্তে পালটে গেল পটভূমি! সেদিনের তীক্ষ্ণ হাসির তীব্রতা আর আজকের তীক্ষণ যন্ত্রণার তীব্রতা মুহূর্তে আমাকে এক উপলব্ধিতে নিয়ে গেল। এমনও হয়!? হে ঈশ্বর! কে জানতো সেদিনের সেই আনন্দঘন ছবিটা এমনভাবে পালটে যাবে সেই প্রবাদটার মত। কে যেন কানে কানে চুপিচুপি ব'লে গেল প্রবাদটাঃ
"যত হাসি তত কান্না
ব’লে গেছে রামশর্মা।"
প্রবাদটা মনের তটে ঘুরে ফিরে বারবার আছড়ে পড়তে লাগলো তীব্রভাবে। সঙ্গে মনপাখি কেঁদে উঠলো গুনগুনিয়ে,
যত হাসি তত কান্না
ব'লে গেছে রামশর্মা।
প্রবাদ ডানা মেলে
উড়ে এসে বলে
আমি হ’লেম বাস্তব
দ্যাখ আমি আর শুধু প্রবাদ না।
এইভাবেও প্রবাদ প্রমাণ করে প্রবাদ মানেই বাস্তব আর যে প্রবাদ তখনই প্রবাদ হ'য়ে ওঠে যার মধ্যে থাকে নিশ্চিত বাস্তবতা!!!!!!!
আমি অপলক চেয়ে রইলাম ঠাকুরের চোখের দিকে ঝাপসা চোখে।
No comments:
Post a Comment