Powered By Blogger

Thursday, July 16, 2020

প্রবন্ধঃ কে দায়ী? ( স্কুল/কোতরং ভূপেন্দ্র স্মৃতি বিদ্যালয়, হিন্দমোটর)

আজ রেজাল্ট বের হ'লো মাধ্যমিকের। কাল বাদে পরশু বের হবে উচ্চমাধ্যমিকের। তার আগে বেরিয়েছে দিল্লি ও সেন্ট্রাল বোর্ডের। আমার পরিচিত জনেদের আনন্দের খবর শুনতে শুনতে মনে পড়ে গেল অনেক কথা। সঙ্গে আমার সময়ের কথাও মনে পড়ে গেল।

সালটা ১৯৭০। অস্থিরতার চরম কাল! রাজ্য তথা দেশ জুড়ে নকশাল আন্দোলনের দুঃখজনক ভয়াবহতার কাল! শিক্ষাক্ষেত্রে চরম অরাজকতা! পরীক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে চুরচুর!তার মধ্যে সে বছর আমি যে স্কুলে পড়তাম (কোতরং ভূপেন্দ্র স্মৃতি বিদ্যালয়, হিন্দমোটর) সেই স্কুলের আমি স্কুল ফাইনাল ব্যাচের ছাত্র ছিলাম। সেই বছর আমার ব্যাচের তিনজন কি সম্ভবত চারজন বোর্ডের পরীক্ষায় ১০ জনের মধ্যে ছিল। অসাধারণ ব্যাচ ছিল আমাদের! নিজের গর্ববোধও হয় সেই ব্যাচের ছাত্র হিসেবে! সে বছর সহপাঠীরা কে কি স্থান অধিকার করেছিল তা এখন আর মনে নেই। এর আগের বছরও আমাদের স্কুলের একজন ছাত্র বোর্ডের পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিল! সে ছিল স্কুলের স্বর্ণযুগ! শুধু মনে আছে যে আগের বছর দ্বিতীয় হয়েছিল সে পরবর্তীতে ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে ছিল অপারগ। কিন্তু তারপরে আর কোনও খবর জানি না তার। পরের বছর আমাদের সময়ে যে তৃতীয় না চতুর্থ হয়েছিল সে পরবর্তী জীবনে কোন সরকারী বড় পদে ছিল আর একজন যে সম্ভবত সপ্তম স্থান অধিকার করেছিল সে পরবর্তীতে হয়েছিল শিশুদের ডাক্তার আর দুজনের কথা ঠিকঠাক মনে পড়ে না! স্কুল জীবন শেষে সকলের সঙ্গে সকলের সম্পর্কের দূরত্ব হ'য়ে গিয়েছিল। এখন কে কোথায় তাও জানি না। শুধু এটুকু জানি আমরা কেউ ভালো নেই! স্কুলের সেই ঝলমলে ফলাফল পরবর্তী জীবনে আর আলো ফেলেনি! ফেলেও না! কেন ভালো নেই সেটা কি ক'রে জানলাম সেটা আর না হয় নাই বা কেউ জানতে চাইলেন, নিজের দিকে ও চারপাশের দিকে তাকালে সে সম্পর্কে একটা ধারণা করা যায় শুধু এটুকু বলতে পারি। আর কেন ভালো নেই তার উত্তর অন্যদের থেকে কিংবা সমাজ ব্যবস্থা ইত্যাদির মত ভেক পরনির্ভরতা থেকে বরং নিজেরাই নিজের সম্পর্কে ভালো দিতে পারি।

যাই হ'ক, আর সেই বছরই আমাদের ক্লাসের যে সবচেয়ে ভালো ছাত্র ছিল, যাকে আমরা বলতাম আমাদের ব্যাচের শুধু নয় আমাদের স্কুলে যত ভালো জুয়েল ছাত্র ছিল, ক্রিম ছিল সে ছিল ক্রিম অফ ক্রীমস!!!!!!! সেই ক্লাস তথা স্কুলের সবচেয়ে পড়াশুনায় ভালো ছাত্র সেই বছরের পরীক্ষায় যার স্ট্যান্ড করার কথা, ১০ জনের মধ্যে একজন হওয়ার কথা, গোটা স্কুল যার দিকে তাকিয়েছিল সে কিন্তু কিছুই হ'তে পারেনি! শুধু সাধারণভাবে ফাস্ট ডিভিশনে পাশ করেছিল! যদিও না হ'তে পারার নমুনা অর্থাৎ ডিরেইল্ড হওয়ার ইঙ্গিত সে অনেক আগেই দিতে শুরু করেছিল সেই ক্লাস এইট/নাইনে পড়ার সময় থেকে! তখন সাম্যবাদের ভুত তার মাথায় চেপে বসেছিল! চেপে বসেছিল শোষিত নিপীড়িত মানুষের মুক্তির কথা! চেপে বসেছিল রাষ্ট্র ব্যবস্থার শৃঙ্খল থেকে অত্যাচারিত মানুষের বন্ধন মুক্তির স্বপ্ন! মনে পড়ে একবার তখন বোধহয় এইটে কিংবা নাইনে পড়ি স্কুলের টিফিন পিরিয়ডের সময় আমাদের কয়েকজন ছাত্র বন্ধুকে সে নিয়ে গিয়েছিল স্কুলের পাশেই একটা বাড়িতে! রাস্তার ধারে বাড়িটার নীচে চায়ের দোকান আর উপরে দোতলায় একটাই মাত্র ঘর! সেই ঘরে বসেছিলাম। মনে পড়ে সেদিন সে আমাদের সাম্যবাদের পাঠ পড়িয়েছিল! চেয়েছিল স্কুলের ছাত্রদের নিয়ে একটা সাম্যবাদী সংগঠন তৈরির স্বপ্ন দেখতে! কিন্তু সেদিন আমি তার পথের বাধা হ'য়ে দাঁড়িয়েছিলাম! আমার উপর ছিল তার দারুণ নির্ভরতা ও বিশ্বাস! সে ছিল ক্লাসের শান্তশিষ্ট চুপচাপ থাকা আমাদের সবার প্রিয় মেধাবী ছেলে! চেহারায় ছিল রোগাপ্যাটকা কালো বেশ কালো ছেলে! কিন্তু চোখেমুখে ছিল অসম্ভব এক উজ্জ্বল ঝলমলে আলো! বাড়িতে কে কে ছিল তা ঠিক জানা ছিল না। তবে যতদূর মনে পড়ে সম্ভবত স্কুলের সামনেই কোন এক বাড়িতে থাকতো! একবার কি দুবার গিয়েছিলাম ওর বাড়িতে। রাস্তার ধারেই ছিল বাড়ি। ভাড়া বাড়ি কিংবা নিজের বাড়ি! তাও এখন আর মনে পড়ে না। শুধু আবছা মনে পড়ে বোধহয় বাড়ির লোকজন ওপারে ছিল আর অবস্থাও খুব একটা ভালো ছিল না। তার বাড়িতে যাওয়ার কারণও ছিল অদ্ভুত! তাও বাড়ির ভিতরে কোনোদিন যাইনি! বাড়ির বাইরে রাস্তার ধারে বাড়ির জানালা পর্যন্তই ছিল আমাদের যাওয়ার দৌড়। অদ্ভুত কারণটা ছিল, স্কুলে যদি কোনোদিন পড়া না পারতো-----এই না পারাটা শুরু হয়েছিল সেই সময় থেকে যে সময় তার ভালোলাগার বিষয় হ'য়েছিল সাম্যবাদ!------সেইদিন সে স্কুল থেকে টিফিনে শরীর খারাপের অজুহাতে ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে যেত, আর বাড়িতে গিয়ে সে দুপুরে সেই না পারা পড়া, পিছিয়ে থাকা বিষয় নিয়ে পড়াশুনায় ডুবে যেতো! এটা শুনেছিলাম! কিন্তু কার মুখে শুনেছিলাম তা মনে পড়ে না। তবে ব্যাপারটা দেখবার জন্য আমরা কয়েকজন ছাত্র একদিন এরকম দিনে টিফিনে তার ছুটি নিয়ে চলে যাবার পর তার বাড়ি গিয়েছিলাম। রাস্তার ধারে চুপি চুপি সেই জানালায় উঠে দেখেছিলাম সে কি করছে! দেখেছিলাম সত্যি সত্যিই সে ঘরে নিরালায় একাকী বই পড়ছে! তবে কি বই পড়ছে তা বুঝতে পারতাম না। এখন মনে হয়, হয়তো সেই না পারা পড়া পড়ার সাথে সাথে নতুন দুনিয়ার স্বপ্নে মশগুল স্বপ্নের জগতের পড়া পড়তো!
সেই যে আমার প্রতি স্কুলে তার নতুন দুনিয়ার স্বপ্ন ও ইচ্ছা পূরণ না হওয়ার জন্য তার অভিমান, রাগ হয়েছিল তা ছিল জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত! হয়তো বা সেই অভিমান বা রাগ পরবর্তীতে টার্ন নিয়েছিল ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে! দ্যাখ কার ক্ষমতা বেশী! এটাই ছিল অবচেতন মনে চাপা পড়া গুপ্ত মানসিকতা! ব্যাপারটা ছিল, সে ছিল মার্কসের সাম্যবাদ-এ বিশ্বাসী আর আমি ছিলাম The greatest phenomenon of the world SriSriThakur Anukul Chandra-এর সামঞ্জস্যবাদে বিশ্বাসী! সে ছিল শান্তশিষ্ট পাতলাপুতলা মুখচোরা আর আমি ছিলাম শরীর স্বাস্থ্যে শক্তপোক্ত ব্যায়াম করা ডাকাবুকো ছেলে! তাই সে স্বভাবগত ও স্বাভাবিকভাবেই আমাকে কাছে পেতে চেয়েছিল। কিন্তু সে ভাবেনি কোথাও একটা সূক্ষ্ম তফাৎ রয়ে গ্যাছে দুজনার চরিত্রে, ব্যক্তিত্বে! আমার মূলত যেটা ছিল ভাবনার মধ্যে তা হ'ল পড়াশুনায় ভালো দারুণ মেধাবী একটা সহপাঠী, স্কুলের মুখ উজ্জ্বল করার সম্ভাবনাময় একজন ছাত্র ক্রমশঃ ক্লাসের পরীক্ষায় পিছিয়ে পড়ছে তা হ'তে পারে না! তাকে মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনতেই হবে! সামনে স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা! স্কুলের সেই সময়ের প্রতিষ্ঠাতা যিনি স্কুলের টিচারও ছিলেন আমার উপরে কেন জানি তাঁর ভরসা ও নির্ভরতা দুটোই ছিল! সেইসময় সাম্যবাদ আর সামঞ্জস্যবাদ নিয়ে আদর্শের লড়াই যতটা না ছিল তার থেকে বেশি ছিল, সহপাঠীর ভবিষ্যৎ ঝকঝকে রেজাল্ট, স্কুলের সুনাম সর্বোপরি স্কুলে রাজনীতি প্রবেশ করতে না দেওয়ার তীব্র প্রচেষ্টা ও মনে মনে চুপিচুপি চ্যালেঞ্জ! সেইসময় স্কুলে রাজনীতি ঢুকতে না দেওয়া, অন্য ছাত্রদের মধ্যে তার প্রভাব আটকানো গেলেও (যার ফলস্বরুপ স্কুল ফাইনালে দুর্দান্ত রেজাল্ট!) সেই সহপাঠী ছাত্রবন্ধুকে সাম্যবাদের ভুতের হাত থেকে বাঁচাতে পারিনি। ফলস্বরূপ স্কুলফাইনালে তার রেজাল্ট ছিল অতি সাধারণ! ফাস্ট ডিভিশন!!

তার পরবর্তী সময়ে সে হয়েছিল শ্রমিক নেতা! স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার পরই তার সঙ্গে আর কোনও যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু সে রাজনীতি করার সুবাদে ঢুকে গিয়েছিল কারখানায় আর তার সাম্যবাদের স্বপ্ন ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হয়েছিল ট্রেড ইউনিয়নের জটিল রাজনীতিতে! সেইখানেই তার সঙ্গে পরবর্তী সময়ে দেখা হয় কর্মসূত্রে! তখন সে ট্রেড ইউনিয়ন রাজনীতিতে রীতিমত পরিচিত মুখ। সেইসময় একটা দূরত্ব মেইন্টেন হ'তো দুজনার মধ্যে! কর্মস্থলে অনেক সীমাহীন সমস্যার মধ্যে দিয়ে আমি যাওয়া সত্ত্বেও কোনোদিনও সে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলেনি, আয়! কি হয়েছে বল! আমি দেখছি! যখন ক্ষমতার শীর্ষে সে সেসময় কয়েকবার মুখোমুখি অফিসে কথা হয়েছে কিন্তু তা কখনোই আমার সমস্যা নিয়ে নয়। আমিও তাকে কোনোদিন মুখ ফুটে বলিনি আমার কষ্টের কথা। সে জানতো, সব জানতো! কে বা কারা কারা আমাকে কর্মক্ষেত্রে চূড়ান্ত সীমাহীন লেগপুল ক'রে চলেছে, ম্যানেজমেন্টের সহায়তায় কোন কোন নেতা আমায় আমার চাকরি জীবনের ক্যারিয়ার কবরে পাঠিয়ে দিয়েছে সব জানতো, ইচ্ছে করলেই আমাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারতো কিন্তু দেয়নি তা কোনোদিনই! আমি যে তার শুধু ক্লাস মেট তাই নয়, আমি ছিলাম একেবারে প্রাইমারি স্কুলে সেই ক্লাস ওয়ান থেকে একেবারে দশ ক্লাস পর্যন্ত পড়া এক ও একমাত্র ক্লাস মেট ও একই কর্মক্ষেত্রের একমাত্র শৈশব থেকে যৌবনের সাথী! যাই হ'ক দু'জনে নিজের নিজের ক্ষেত্রে সম্মানজনক দূরত্ব নিয়ে তার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কাটিয়েছিলাম!

সেই স্কুলের সবচেয়ে মেধাবী, ক্রিম অফ ক্রীমস স্টুডেন্ট, শান্তশিষ্ট, চুপচাপ কালো পাতলাপুতলা দুর্দান্ত সম্ভাবনাময় সাম্যবাদের স্বপ্ন দেখা সমাজ কো বদল ডালোর সৈনিকের জীবন থেমে গেছিল ৯০দশকের শেষদিকে এক সন্ধ্যায় ক্লাব থেকে আড্ডা মেরে বাড়ি ফেরার পথে রেলওয়ে প্ল্যাটফর্মের উপরে আততায়ীর গুলি ও ছুরির আঘাতে! থেমে গেছিল জীবনের প্রথমদিকে দীর্ঘদিনের কষ্টের উপর দিয়ে ছুটে চলা সুপারফাস্ট জীবনগাড়ি!
প্রশ্ন জাগে আজ মনে, কে দায়ী!? কেন এমনভাবে থেমে গেল জীবনগাড়ি!? কেন দুর্দান্ত ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাময় ক্রিম অফ ক্রীমসের জীবন ক্রিমহীন শুকনো খটখটে হ'য়ে অসময়েই শেষ হ'লো!? কেন একদিন স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষায় ১০ জনের মধ্যে স্ট্যান্ড করা আমার সাথীরা কেউ ভালো নেই, সুখে নেই!?

এই সুপারফাস্ট জীবনগাড়ি মাঝপথে অসফল অবস্থায় থেমে যাওয়া কিংবা সুখী না হওয়া, ভালো না থাকার জন্য কে দায়ী? বাড়ি? স্কুল? বন্ধুবান্ধব! পরিবেশ? সমাজ? সভ্যতা? দেশ? নাকি নিজে!?

জানি না! জানার আর এই বয়সে ইচ্ছেও নেই। শুধু আজকের এই পরীক্ষার ফলাফল বেরোবার আনন্দের দিনে সবাই আনন্দ করুক এই কামনা করি। আর শুধু স্মরণ করি The greatest phenomenon of the world SriSriThskur Anukul chandra-এর কথা:

"তুমি ঠিক-ঠিক জেনো যে, তুমি তোমার, তোমার নিজ পরিবারের, দশের এবং দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য দায়ী।"

No comments:

Post a Comment