বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত 'আমার সোনার বাংলা তোমায় ভালোবাসি' নিয়ে এবং গানের রচয়িতাকে নিয়ে এতটা নীচে নামতে পারে বাংলাদেশের সম্প্রতি অবৈধ উপায়ে পট পরিবর্তনের পর বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের সমর্থনকারী ছাত্র, নাগরিক সমাজ তা ভাবলে অবাক হ'য়ে যাই, মনে প্রশ্ন জাগে, এ আমরা কোন পৃথিবীতে আছি?
রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল দুজনেই ভারতীয়। ১৯৭১ সালে কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের সম্পত্তি হ'য়ে যায়। যা আজও আছে। আর, কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হ'য়ে যান তাদের কাছে সমালোচনা, নিন্দা, কুৎসার বস্তু। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে এত কুৎসা, এত গালাগালি, এত নিন্দা, এত অপমান, এত অপবাদ, এত লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, এত ঘৃণা, এত চরিত্র হনন সোশ্যাল মিডিয়ায়, ফেসবুকে যে মাটির নীচে ঘুমিয়ে থাকা দুই কবিরই আত্মা কেঁপে কেঁপে উঠছে। আজ দিনের পর দিন স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হ'য়ে উঠছে বাংলাদেশের বাঙালিদের একজন বাঙালির প্রতি ঘৃণা ও আরেকজন বাঙালির প্রতি ভালোবাসার কারণ। গোটা দুনিয়াকে দেখিয়ে দিল বাংলাদেশের সাম্প্রতিক আন্দোলনে জড়িত বাঙ্গালীরা বাঙ্গালীর মুখের ভাষা, আচার, আচরণ, সভ্যতা, ভদ্রতা কোন স্তরের। এর সঙ্গে প্রশ্ন তুলে দিল, তারা অর্থাৎ বাংলাদেশের পট পরিবর্তনের পক্ষ অবলম্বনকারীরা বাঙালী না, তারা মুসলমান।
"বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশে আনা হয় ও বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেয়া হয়।"----- কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর বাংলাদেশের বর্তমান অবৈধ শাসক ও আপামর বাংলাদেশীদের কাছে পেলে ভালো লাগবে।
১) কাজী নজরুল ইসলামকে ভারত থেকে কেন নিয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ?
২) ভারতের প্রতি এত ঘৃণা অথচ ভারতের মাটিতে জন্ম নেওয়া, ভারতের মাটি যার কর্মভূমি, ভারতীয় কৃষ্টি-সংস্কৃতি যার চেতনায়, যিনি ভারতের স্বাধীনতার জন্য তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, যিনি ভারতীয় হিন্দু নারীকে বিবাহ করেছিলেন, যিনি তাঁর চার সন্তানের নাম রেখেছিলেন যথা: কৃষ্ণ মুহাম্মদ, অরিন্দম খালেদ (বুলবুল), কাজী সব্যসাচী এবং কাজী অনিরুদ্ধ। সেই আপাদমস্তক ভারতীয় ঘরানার নাগরিককে কেন তাঁর শেষ বয়সে বাংলাদেশে নিয়ে গিয়েছিল তদানীন্তন সরকার?
৩) প্রমিলা দেবীর শেষ ইচ্ছা ছিল তার স্বামীকে যেন তার কবরের পাশে (চুরুলিয়ায় নজরুলের পৈতৃক বাড়িতে) সমাধিস্থ করা হয়। কিন্তু প্রমিলার শেষ ইচ্ছাটি আর পূরণ হয়ে উঠে নি। কেন কবিকে কবি পত্নী প্রমিলা দেবীর শেষ ইচ্ছামত তাঁর স্বামী নজরুল ইসলামকে তাঁর কবরের পাশে (চুরুলিয়ায় নজরুলের পৈতৃক বাড়িতে) সমাধিস্থ করা হয়নি?
৪) যখন তাঁকে বাংলাদেশে নিয়ে যাওয়া হয় তখন তিনি সুস্থ ও চেতনায় ছিলেন? ১৯৭২ সালে বাকশক্তিহীন ও মানসিক ভারসাম্যহীন পিক্স ডিজিজ নামক একটি নিউরনঘটিত ভয়ংকর সমস্যায় ভুগতে থাকা কবিকে কেন নিয়ে যাওয়া হয়েছিল শেষ জীবনে তাঁর দেশ থেকে অন্য দেশে? কি ছিল সেই ঘৃণ্য রাজনীতি? তিনি যদি সুস্থ থাকতেন তাহ'লে কি তিনি নিজের জন্মভুমি, নিজের মাতৃভূমি, নিজের কর্মভূমি ত্যাগ ক'রে জাতীয় কবি হওয়ার লোভে অন্য দেশে যেতেন?
৫) তখন মনে হয়নি ভারতের কাছে হাত পেতে ধার করতে হচ্ছে একজন বিদেশীকে, তাও তাঁর অজান্তে মারাত্মক অসুস্থ অবস্থায়, নিজের দেশের জাতীয় কবি ঘোষণা ক'রে বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের মাথা উঁচু করবেন?
৬) যে মানুষটি মুসলিম হয়েও কালী ও কৃষ্ণ প্রেমে মেতেছিলেন, প্রচুর শ্যামা ও কৃষ্ণ সঙ্গীত লিখেছিলেন তখন তাঁকে নিয়ে যাওয়ার সময় মনে হয়নি এই মানুষটি বিধর্মী ও কাফের?
৭) ১৯৭১ সালের রাষ্ট্রনায়ক, দেশ স্বাধীন করার রূপকার মুজিবর রহমান আজ যে বর্তমান ছাত্র আন্দোলনকারী, সাম্প্রতিক পটপরিবর্তনকারী জনগণ ও উপদেষ্টামন্ডলীদের কাছে চরম অপমানিত, অবহেলিত, লাঞ্ছিত, কলঙ্কিত এবং সম্পূর্ণ্রূপে ব্রাত্য সেই মানুষটির আনা কাজী নজরুল ইসলাম এখন রবীন্দ্র বিরোধীদের কাছে 'বাংলাদেশের কবি' ও তাঁর অর্জনগুলি এখন বাংলাদেশের অর্জন!? কি অদ্ভ্যুত নীচ, ঘৃণ্য, নোংরা মানসিকতা। এ তো নেপোয় মারে দই-এর মানসিকতা! আর, যে আনলো কবিকে দেশে দেশের অলংকার করবে ব'লে তাঁকেই পিছনে লাথি মেরে কবিকে এখন মাথায় নিয়ে নাচানাচি? এতটা ধূর্ততা!?
৮) বর্তমান আন্দোলনকারীদের কাছে ভারতের কাছে ধার করা জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের গানগুলি কি হারাম? কারণ তাঁর গানগুলি তো বাদ্যযন্ত্র সহযোগে তাহ'লে তাঁর গানগুলি কি ক'রে জায়েজ হবে?
৯) বর্তমান ভারত বিরোধী বাংলাদেশের শাসক ও জনগণের কথামত "আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের জাতীয় সঙ্গীত একজন "ভারতীয় কবি"র লেখা" যদি হয় তাহ'লে আপনাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম তো আপাদমস্তক শরীরে, মনে, আত্মায় ভারতীয় নাগরিক, এই কথায় আপনাদের ঈমানে ঝাঁকি লাগবে না? আপনাদের ক্ষেত্রে এটা সত্য ও বাস্তব নয়?
১০) বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত ভারত থেকে ধার করা জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের যদি লেখা হ'তো তখন কি বলতেন, অকপটভাবে স্বীকার করতেন, মেনে নিতেন এই সত্য ও বাস্তব যে কবি নজরুল ইসলাম আদপেই ভারতীয়? তখন তাঁর গান পরিবর্তন করতেন?
১১) বাংলাদেশে বলা হচ্ছে, "বাংলাদেশ একটা আধুনিক জাতিরাষ্ট্র"। তা এই জাতিরাষ্ট্রটা কি? জাতিরাষ্ট বলতে কি বোঝাচ্ছে? রবীন্দ্রনাথ যেহেতু হিন্দু সেইহেতু তাঁকে সমূলে উৎখাত করতে হবে কারণ তিনি বিধর্মী। আর নজরুল ইসলাম যতই অন্য দেশে জন্মাক ও ভারতীয় হ'ক, যতই সে আপাদমস্তক খাঁটি বাঙালী ও যতই সে পশ্চিবংগের বাঙালি হ'ক, যতই সে হিন্দু ভারতীয় নারীকে বিবাহ করুক, যতই সে মা কালী ও কৃষ্ণপ্রেমী হ'ক আর মা কালী ও কৃষ্ণের গান রচনা করুক, যতই ছেলেদের নাম বাংলা তথা হিন্দু নামের সঙ্গে মিলিয়ে আরবি/ফার্সিতে রাখুক কাজি নজরুল ইসলাম বিধর্মী নন তিনি খাঁটি মুসলিম ও ইসলামপন্থী। আর, রবীন্রনাথের বেলায় দুনিয়ার গাত্রদাহ, দুনিয়ার তকমা?
১২) যে দেশের নাগরিক কোনো দেশে বিদেশে যখন কোনও সম্মানে পুরস্কৃত হন তা সে হিন্দু হ'ক, মুসলমান হ'ক, খ্রীষ্টান বা বৌদ্ধ হ'ক আর যে ধর্ম সম্প্রদায়ের হ'ক তা'কে সেই দেশের নাগরিক হিসেবেই উল্লেখ করা হয়। এটা তো আন্ডারস্টুড! এই নিয়ে আবার কমেন্ট হয় নাকি? এটাই তো বাস্তব। আর, বাংলাদেশের বর্তমান শাসকদের এর উল্টো কথা বা যুক্তিটা তো ১০০ ভাগ অবাস্তব, যাকে জোর ক'রে বাস্তব করতে চাইছেন কথার জাগলারিতে। তাই নয় কি?
১৩) ২০০৬ সালে ডাঃ মহম্মদ ইউনুস শান্তিতে নোবেল পুরস্কারে পুরস্কৃত হন তা'তে তিনি বাংলাদেশী নাগরিক হ'লেও ১৯৪০-১৯৪৭ ব্রিটিশ ভারতের নাগরিক ছিলেন তাই ভারতীয়রা ও বিশেষ ক'রে পশ্চিমবাংলার বাঙ্গালীরা ডাঃ ইউনুসকে নিজেদের লোক বলেই মনে ক'রে নোবেল প্রাপ্তির আনন্দ উপভোগ করেছিল। এবং ভারত বিভিন্ন বিষয়ে মহম্মদ ইউনুসকে ১০ বার পুরস্কৃত করেছিল। একথা ইউনুস সাহেব ভুলে গেছেন। তাই তিনি সেই ভারতের এখন সবচেয়ে বড় শত্রু, ভারত ভাঙ্গার কারিগর। আপনাদের মত নিম্ন রুচির পরিচয় দিয়ে ইউনুসের গায়ে বাংলাদেশী স্ট্যাম্প ফেলে দিয়ে ও নোবেল পুরস্কারকে ও মহম্মদ ইউনুসকে বাংলাদেশের নোবেল ও বাংলাদেশের নাগরিক ব'লে দূরে ঠেলে দেয়নি সেদিন ভারত। আপনারা সেই নিকৃষ্ট পথ দেখালেন, নিম্ন রুচির কৃষ্টি-সংস্কৃতি, শিক্ষার পরিচয় দিলেন।
আর, ভারত চিরকাল জগত সভায় শ্রেষ্ঠ ছিল, আছে ও থাকবে। আপনারা ও পাকিস্তানও ছিল সেই গৌরবের অংশীদার একদিন ভারতের অংশ হ'য়ে কিন্তু নোংরা রাজনীতির নোংরা খেলা, ক্ষমতা দখলের ও নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণের জন্য নিজেদের মধ্যে ভাঙ্গার খেলা, বিদেশী শক্তির ডিভাইড এন্ড রুল প্রয়োগ করার ঘৃণ্য মানসিকতার খেলা আজ ভারতকে তিন টুকরো করেছে আরো আগামীতে ভারতকে হয়তো বা আরও টুকরো করার চেষ্টা করবে।
যাই হ'ক, যদিও জানি সেই চেষ্টা হ'লে আগামী ভয়ংকর পৃথিবীতে কেউ ভালো থাকবো না, শুধু ভারত সেদিন একা শ্ত্রুদের দ্বারা টুকরো বা ধ্বংস হবে না সেইসংগে যারা যারা এই টুকরো করার বা ধ্বংস করার কাজে লিপ্ত থাকবে তারাও টুকরো টুকরো হয়ে ধ্বংস হ'য়ে যাবে।
তবুও প্রার্থনা করি হে ঈশ্বর সবাইকে সুমতি দাও, সবাই তোমার আশীর্বাদে মিলেমিশে ভালো থাকুক। আর যদি তা' না হয় তোমার অঙ্গুলিহেলনে আবার মহাভারত নয়, এবার হ'ক মহাবিশ্ব। শেষ হ'য়ে যাক, লুপ্ত হ'য়ে যাক মানবজাতি, মানব সভ্যতা। কারণ মানুষের মনুষ্যত্ব আজ তলানিতে।
( লেখা ১০ই সেপ্টেম্বর' ২০২৪ )