দুর্দান্ত খেতে এই পেপের লুচি। এই পেপের লুচি তৈরির পিছনে একটা কাহানী আছে। আর কাহানীর সঙ্গে জড়িয়ে আছে দয়াল ঠাকুরের অপরিসীম দয়ার কথা। যা বিশ্বাসযোগ্য নয়। এইখানে একমাত্র প্রযোজ্য শেক্সপিয়রের হ্যামলেট নাটকের একটা ডায়লগ যা ঠাকুর প্রায় সময়ই উচ্চারণ করতেন। ঠাকুরের প্রিয় কিছু কোটেশানের অন্যতম প্রিয় কোটেশন এটা। "There are more things in heaven and earth, Horatio, than are dreamt of in your philosophy." এর ভাবার্থ হ'লো, "স্বর্গ ও পৃথিবীর মাঝখানে আরও বহু জিনিস আছে, হোরেশিও, যা তোমার দর্শনের পাল্লার বাইরে ও অতীত।"
আজ থেকে বহু বছর আগের কথা। তখন আমার বয়স ২৪-২৫ বছর হবে। আজ থেকে ৪৫ বছর আগের (১৯৭৭-৭৮) কথা। পেটের ডানদিকে একটা ব্যাথা হ'তো। ডানদিকের লিভারের ওপরের দিকে একটা সূচের মতো ব্যাথা খোঁচা মারতো লাংসের উপরের দিকে। হোমিওপ্যাথি ডাক্তারকে যখন দেখালাম তখন তিনি বলেছিলেন, এটা গল ব্লাডারের ব্যাথা। তারপর তিনি ওষুধ দিয়েছিলেন। পরে অ্যালোপ্যাথিক ডাক্তার দেখিয়েছিলাম। তিনিও একই কথা বলেছিলেন। সঙ্গে ব্যাথার ওষুধ দিয়েছিলেন ব্যারালগন। এইভাবে চলছিল। খাওয়াদাওয়ার উল্টোপালা হ'লেই ব্যাথা চরমে পৌঁছত। হাতের সামনে থাকতো ব্যারালগন। তাৎক্ষনিক উপশমের জন্য ব্যারালগন চালান ক'রে দিতাম পেটে। এইভাবে বছরের পর বছর কেটে চললো। ধীরে ধীরে পেটের হজম শক্তি একেবারে নষ্ট হ'য়ে গেল। হাতের সামনে মেট্রোজিল ৪০০, র্যানটেক বা জিনটেক ৩০০, ইউনিয়ামজাইম বা ভিটাজাইম ইত্যাদি পেটের আমাশা, অম্বল দূর করার জন্য এবং খাবার হজম হওয়ার জন্য যা পেতাম তাই পেটে চালান ক'রে দিতাম।
এমনিভাবেই কেটে গেল বহু বছর। দীর্ঘ বহু বছর প্রায় ২৫-২৬ বছর পর সালটা (২০০৩ সাল হবে) একদিন সকালে একেবারে সর্ষের তেলের মতো বমি করলাম। এই দীর্ঘ সময়ে শেষের দিকে অনেক বছর বাইরের কিছু তো খেতে পারতাম না এমনকি ঘরের রান্নাও হজম হ'তো না। চপ, সিঙারা, কচুরি, লুচি, পরোটা ইত্যাদি খাবার ছিল আমার ফেবারিট।দুপুরে রাত্রে বেশিরভাগ সময়ে ঘি ডালডা দিয়ে ভাজা লুচি, পরোটা সঙ্গে আলুরদম বা অন্যকিছু মুখোরোচক রান্না দিয়ে হ'লেই আমার হ'য়ে যেত। ভাত, মাছ, মাংস না হ'লেও চলতো। কিন্তু পেটের বদহজম আর ব্যাথার কারণে সব বন্ধ হ'য়ে গেছিল। তারপর ঐ সর্ষের তেলের মতো বমি করাতে ডাক্তারের কাছে গেলাম,-সালটা ছিল ২০০৩ সাল, ডাক্তার আল্টাসোনোগ্রাফি করতে লিখে দিল। আলট্রাসোনোগ্রাফি রিপোর্টে ধরা পড়লো গল ব্লাডারের ভয়ংকর অবস্থা। গল ব্লাডার বাস্ট করার আগেই ইমিডিয়েট অপারেশন প্রয়োজন। আমার ভাইরা ভাই সবসময় আমাকে অপারেশন করিয়ে নেওয়ার কথা বলতো। নইলে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভবনা আছে সেই কথা ব'লে আমাকে অনেকবার সাবধান করেছিল।
যাই হ'ক, আল্টাসোনোগ্রাফি রিপোর্টে অ্যাকিউট গল ব্লাডার ধরা পড়ায় আমাকে সার্জেন ডঃ ------ কাছে রেফার করলেন। ডঃ------- পরীক্ষা ক'রে আমাকে ইমিডিয়েট হস্পিটালে ভর্তি হ'য়ে যাওয়ার কথা বললেন এবং কিছ পরীক্ষা নিরীক্ষার কথা লিখে দিলেন। তখন আর একমাস পর ছিল দূর্গাপুজা। মনে মনে ভাবলাম এখন যদি অপারেশন করি তাহ'লে পুজোর সময় বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে। এ কথা ভেবে ডাক্তারকে পুজোর পর অপারেশন করার কথা বলায় তিনি প্রচন্ড বিরক্ত হ'লেন। রেগে গিয়ে আমায় আমার যা ইচ্ছা তাই করতে বললেন। ডাক্তারবাবু ছিলেন প্রচন্ড বেরসিক। মুখে তার কখনোই কেউ হাসি দেখেনি। কথাবার্তা একেবারে চাঁচাছোলা। নকশাল মাইন্ডের। কিন্তু অপারেশনের হাত যেন ভগবানের হাত। কিন্তু তাঁর সেই কথায় আমি চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ডাক্তারবাবুকে ঠিক আছে ব'লে বেরিয়ে এলাম। তারপর কোনও পরীক্ষা না করিয়ে সোজা বাড়ি চলে এলাম। বাড়িতে কিছু বললাম না। রাতে ঠাকুরের সামনে বসে ঠাকুরকে সব বললাম। অনেক কথা বললাম। মনের সব কথা ব'লে ঠাকুরকে প্রণাম ক'রে নাম করতে করতে শুয়ে পড়লাম। শুরু হ'লো আমার নোতুন যাত্রা। তখন রামদেবজীর যোগ ব্যায়াম-এর ঘোড়া জোর কদমে ছুটে চলেছে দেশ তথা বিদেশ জুড়ে টেলিভিশনের মাধ্যমে। শুরু হ'লো ভোর পাঁচটা থেকে সকাল সাতটা আর সন্ধ্যে ৬টা থেকে আটটা পর্যন্ত মরণপণ কপাল্ভাতি আর অনুলোম বিলোম প্রাণায়াম। আর সঙ্গে চব্বিশঘন্টা শয়নে স্বপনে জাগরণে নাম জপ। রামদেবজীর প্রাণায়াম আর দয়াল প্রভুর নাম প্রাণায়াম চলতে লাগলো অপ্রতিরোধ্যগতিতে।
এমনিভাবে কেটে গেল টানা একমাস। এসে গেল দুর্গাপুজা। এই একমাসের টানা প্রাণায়ামে নিজেকে অনেক সুস্থ অনুভব হচ্ছিলো। খাওয়া দাওয়া একেবারে পেট পচা রোগীর পথ্য যেমন হয় তেমন। আমাদের বাড়িতে তখন পুজোর সময় জয়েন্টলি খাওয়া হ'তো পুজোর একেবারে ষষ্টি থেকে শুরু ক'রে একাদসী পর্যন্ত। রান্নার লোক থাকতো। সকাল থেকে একেবারে সারাদিনের রান্না করার দায়িত্ব থাকতো তার উপর। এই ছয় দিনই সকালে গরম গরম লুচি কখনো বা কচুরি আর আলুরদম, আলু কুমরোর তরকারি, কিম্বা ছোলার ডাল পরিবেশন হ'তো। এই প্রথম আমি এগুলি থেকে বঞ্চিত হবো। এইভেবে মনটা খুব খারাপ হ'য়ে থাকতো। যত পুজোর দিন এগিয়ে আসতে লাগলো তত মনটা বিষন্ন হ'তে লাগলো। পুজোর মজা আর আমার নেই। কিন্তু শরীরটা বেশ চাঙা হ'য়ে উঠেছে দিনের পর দিন। এই একমাস ধ'রে পেটের কোনও গোলমাল নেই, নেই বিন্দুমাত্র বদহজম, অম্বল, কোনও পেট ব্যাথা। পায়খানা পরিস্কার। মনটা চনমনে হ'য়ে উঠতে লাগলো ক্রমশঃ। পুজো যত এগিয়ে আসছে তত জোর কদমে চলতে লাগলো প্রাণায়াম। তার থেকেও তীব্রগতিতে ২৪ঘন্টা চলতে লাগলো নাম প্রাণায়াম আর ধ্যান। যেন একটা ঘোরের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। মরণপণ সংগ্রাম চলছে নিজের সঙ্গে নিজের। আজ্ঞাচক্রে ঠাকুরকে স্মরণ ক'রে একটা চ্যালেঞ্জ নিয়ে চলছি সকাল থেকে রাত। ঠাকুরের কাছে বসে কাঁদতাম আর বলতাম ঠাকুর আমায় সুস্থ ক'রে দাও। এইভাবে দেখতে দেখতে পুজো এসে গেল। পঞ্চমীর ষষ্টি থেকে একাদশী পর্যন্ত ছয়দিনের জিনিসপত্র এসে গেল। পরেরদিন ষষ্টি। ষষ্টির সকাল থেকে তোড়জোড় শুরু হ'য়ে গেল রান্নাবান্নার। একটা ছুটির আমেজ অনুভব করতে লাগলাম সকাল থেকে। জয়েন্ট ফ্যামিলি। বাড়িতে একটা কোলাহল চলছে। ভালোই লাগছে। ফুরফুরে সকাল। সকালের ইষ্টভৃতি, প্রার্থনা, প্রাণায়াম সেরে স্নান ক'রে টিভি চালিয়ে বিছানায় বসে খবরে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তের পুজো আয়োজনের খবর শুনছি। নাকে ভেসে আসছে ডালডা দিয়ে ভাজা লুচির গন্ধ। বুঝলাম সকালের নাস্তা তৈরী শুরু গেছে। এইসময় বৌ এসে জিজ্ঞেস করলো আমি কি খাবো। আমি ভাবলাম কি আর খাবো। লুচি তো আমার পেটে সহ্য হবে না। তাই বললাম, প্রতিদিন যা আমার জন্য বরাদ্দ তাই দাও। মুড়ি আর চা দাও। এইকথা বলে আমি ঘরের বাইরে বাগানে এসে দাঁড়ালাম। সকালের আবহাওয়া বেশ মনোরম। বাগানে চারপাশে প্রচুর গাছপালা। পেপে, কলা, কাঁঠাল, বাতাবি লেবু, গন্ধরাজ লেবু, পেয়ারা, বেল, নারকেল, আম ইত্যাদি গাছ এবং জবা, গন্ধরাজ, শিউলি, নীলকণ্ঠ, কাঠমালতী, টগর ইত্যাদি নানা ফুলের গাছগাছালিতে ভরা বাগান। খুব বিরাট যে বাগান তা নয়। কিন্তু বাড়ির সামনের ফাঁকা জায়গা জুড়ে নানা ফুলফলের গাছ যেন একটা স্বগীয় পরিবেশ রচনা ক'রে রেখেছে। একটা চেয়ার নিয়ে বসে একাকী চুপচাপ চারপাশে তাকিয়ে দেখছিলাম আর ভাবছিলাম ঠাকুরের কথা। চোখ ঘুরতে ঘুরতে গিয়ে পড়লো পেপে গাছের দিকে। দেখলাম গোল গোল পেপেতে ভরে আছে গাছ। চেয়ে রইলাম গাছের দিকে। কি অপূর্ব নিখুঁত গোল ফুটবলের মতো এক একটা পেপে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে থাকতে হঠাৎ মনের মধ্যে কে যেন বলে উঠলো পেপের তরকারির মতো পেপে দিয়ে লুচি তৈরি ক'রে খেলে কেমন হয়? জানি না এটাকে সাড়া পাওয়া বলে কিনা। মনের মধ্যে কথাটা জেগে উঠতেই মনে হ'লো স্বস্ত্যয়নীর তৃতীয় নীতির কথা। আমি তন্ময় হ'য়ে ছড়াটা ভাবছিলাম। শ্রীশ্রীঠাকুর স্বস্ত্যয়নীর তৃতীয় নীতি সম্পর্কে ছড়া আকারে বললেন,
"যে-কাজে যা' ভাল ব'লে
আসবে মনে তৎক্ষণাৎ
হাতে-কলমে করবি রে তা'
রোধ ক'রে তা'র সব ব্যাঘাত।"
ইতিমধ্যে বৌ মুড়ি আর চা নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে সামনে। 'এই নাও চা' কথাটায় সম্বিৎ ফিরে এলো, মুখ ঘুরিয়ে আমি চায়ের কাপ্ হাতে নিয়ে বললাম, লুচি ভাজা হ'য়ে গেছে? বউ বললো, না, এখনো ভাজা হচ্ছে। বাচ্চাদের আগে দেওয়া হচ্ছে তারপরে বড়দের দেওয়া হবে। তারপরে বউ উৎসুক হ'য়ে জিজ্ঞেস করলো তুমি লুচি খাবে? আমি বললাম, আমার পেটে সহ্য হবে? বউ বললো, তোমার তো এখন পেটের কন্ডিশান আগের থেকে অনেক ভালো, পেটে কোনও ব্যাথা নেই, নেই কোনও অম্বল, গ্যাস, বদহজম। পায়খানাও ভালো হচ্ছে, তা বেশী না। একটা লুচি খেয়ে দেখবে নাকি? আমি বুঝতে পারলাম আমার মানসিক অবস্থা বুঝতে পেরেই আমাকে এই কথা বলছে। আমি তখন পেপের বিষয়ে সাড়া পাওয়ার কথা বৌকে বললাম।বললাম, পেপে দিয়ে লুচি ক'রে দেবে? বউ কথাটা শুনে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। আমি গাছের দিকে দেখিয়ে বললাম, দেখো কি সুন্দর গোল গোল পেপে হয়েছে গাছে। তা পেপের তরকারীর মতো পেপে দিয়ে লুচি করা যায় না? বউ বললো, তোমাকে এই পেপে দিয়ে লুচির কথা কে বললো? আমি বললাম, কেউ না। আমি বসে বসে মনে মনে ভাবছিলাম নানা কথা। বাইরে সুন্দর বাতাস। ঘরের ভিতর থেকে ভেসে আসছে ডালডা দিয়ে ভাজা লুচির প্রাণমাতানো গন্ধ। মনে মনে ঠাকুরকে বলছিলাম পেট ভালো ক'রে দেওয়ার কথা। গাছের দিকে তাকাতে তাকাতে পেপে গাছের দিকে গিয়ে নজর আটকে গেল, গোল গোল পেপের দিকে তাকিয়েছিলাম অনেকক্ষণ আর তখনি কে যেন ব'লে উঠলো, পেপের লুচি খা। আমি স্পষ্ট যেন শুনতে পেলাম কথাটা। আর তখনি তুমি এসে বললে চায়ের কথা। তাই তোমাকে বললাম। বউ আর কিছু বললো না। কিছুক্ষণ ভাবলো তারপরে দেওয়ালের কোনায় রাখা বাঁশের লগাটা হাতে পেঁপে গাছের নীচে গিয়ে দাঁড়ালো। তারপর লগার খোঁচা দিয়ে একটা বড় দেখে পেঁপে পেড়ে সেটা হাতে নিয়ে চুপচাপ চলে গেল। আমি বললাম, কি গো পেঁপে পাড়লে? বউ বললো, দেখি কি করা যায়। আর দুপুরে তোমার খাবার জন্য পেঁপের তরকারী করবো। এইকথা ব'লে বউ চলে গেল। আমি চুপচাপ বসে প্রকৃতির শোভা দেখছি।
অনেকক্ষণ কেটে গেছে। বাড়ির ভেতরে বেশ জমে উঠেছে পুজোর ছুটির পরিবেশ। ডালডা ভাজা গরম গরম লুচির মজা নিচ্ছে সবাই। মনে হচ্ছে, চারপাশে আকাশে বাতাসে সত্যিই যেন আনন্দধারা বইছে। বাড়ির সামনে রাস্তা দিয়ে যারাই যাচ্ছে তাদেরই চোখেমুখে যেন একটা অনাবিল আনন্দের রেশ ফুটে উঠছে। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তা। ইতিমধ্যে স্থানীয় ক্লাবের কয়েকজন সদস্য ক্লাবের দুর্গা পুজো সংক্রান্ত কিছু কাজের জন্য দেখা ক'রে গেল বড়দার সঙ্গে। আমার বড়দা ক্লাবের ও পুজোরও ক্যাসিয়ার। পাড়ায় বিভিন্ন সংগঠন যেমন নাগরিক সমিতি, বাড়ির সামনে মহাপ্রভুর মন্দির, নাম সংকীর্তন সমিতি ইত্যাদির প্রতিটি সংগঠনের অনুষ্ঠানের অবিসংবাদিত ক্যাসিয়ার। হিসাব পেশের সময় দেখতাম এক বান্ডিল বিড়ির ও একটা দেশলাই বাক্সের হিসাব দিতে দেখে সবাই হো হো ক'রে হেসে উঠেছিল। আজ লিখতে বসে মনে পড়ে যাচ্ছে কত কথা। চোখ ঝাপসা হ'য়ে আসছে। এই লেখা যখন লিখছি তখন ঘরে কেউ নেই। স্মৃতি বেদনায় বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠছে। তাই তাড়াতাড়ি ফিরে গেলাম মূল ঘটনায়।
এইভাবে কেটে গেল অনেক্ষণ। হঠাৎ বউ-এর গলা শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতেই চোখ ছানাবড়া হ'য়ে গেল! হাঁ ক'রে তাকিয়ে আছি বঊ-এর হাতের দিকে। দেখলাম প্লেট হাতে দাঁড়িয়ে আছে বউ। প্লেটের উপর বড় বড় দু'টো গরম গরম ফুলকো লুচি আর পাশে মাখা তরকারি। আমি অবাক হ'য়ে তাকিয়ে আছি বউ-এর দিকে। একবার তার মুখের দিকে তাকাচ্ছি পর মুহূর্তে হাতের দিকে। আমার বিশ্বাস হচ্ছিলো না নিজের চোখে যা দেখছি তা। আমি কি যা দেখছি তা সত্যি সত্যিই দেখছি!? বিস্ময়ে মনে মনে নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করলাম। বউ বললো, এই নাও দু'টো লুচি খেয়ে নাও। আমি অবাক হ'য়ে বললাম, আমি লুচি খাবো? বউ দৃঢ় স্বরে বললো, খেয়ে নাও। কিছু হবে না। ঠাকুর আছে। আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, যদি খাওয়ার পর কষ্ট হয়? ডালডা দিয়ে ভাজা লুচি আমার সহ্য হবে? আবার যদি পেট ব্যাথা শুরু হয়? বহু বছর খাইনি লুচি, কচুরি, চপ, সিঙ্গারা, ঘুগনি, ভাজাভুজি ইত্যাদি। এখন যদি আবার পেটের গন্ডগোল শুরু হয়? বউ বললো, দু'টোর বেশী খেও না। সেরকম যদি মনে হয় দুপুরে কিছু খেও না।
যাই হ'ক, আমি তখনো জানি না এ কিসের লুচি। তরকারির দিকে তাকিয়ে দেখলাম সেটা স্বাভাবিক সবার জন্য যে তরকারি হয়েছে সেই তরকারি। পেঁপের চিহ্নমাত্র নেই। ভাবলাম এক তো আটা বা ময়দার লুচি, সঙ্গে ডালডা দিয়ে ভাজা তার উপর আলু দিয়ে তৈরি মাখা তরকারি। কি জানি কি হবে। একদিকে ভয় অন্যদিকে প্রচন্ড লোভ হচ্ছে। বহুদিন পর লুচি সামনে দেখে জিভে জল এসে গেল। বহু চেষ্টা ক'রেও আটকাতে পারলাম না জিভের জল। মুখটা ভরে উঠেছে সেই জলে। প্লেটটা হাতে নিয়ে মনে মনে ঠাকুরকে বললাম, হে দয়াল! খাবো লুচি? যদি আবার পেট ব্যাথা হয়? বউ-এর দিকে তাকাতে বউ আবার বললো, খেয়ে নাও। কিচ্ছু হবে না। ঠাকুর আছে। কথাটা বলেই চলে গেল। আর আমিও কালবিলম্ব না ক'রে একটা লুচি হাতে নিয়ে ছিঁড়ে একটু তরকারি দিয়ে মুখে দিলাম। আঃ! কি অপূর্ব টেস্ট! তাড়িয়ে তাড়িয়ে লুচি দু'টো তরকারি দিয়ে চেটেপুটে একটু একটু ক'রে পুরোটা খেয়ে নিলাম। তারপর হাত ধুয়ে ঘরে এসে বসলাম। ঘড়িতে সময় এগিয়ে চলেছে আর ভাবছি এইবুঝি পেটে ব্যাথা শুরু হ'লো, এইবুঝি বদহজম, অম্বল, গ্যাস শুরু হ'য়ে গেল। কিন্তু কিছুই হ'লো না। সময় এগিয়ে চললো। মাঝে কয়েকবার বউ এসে দেখে গেল লুচি খাওয়ার পর আমার প্রতিক্রিয়া কি। জিজ্ঞেস করলো, আমার কোনও কষ্ট হচ্ছে কিনা। আমি আমার ভালো থাকার কথা জানালাম। এমনিভাবে সকাল কেটে গেল। দুপুরের খাবার সময় এসে গেল। আমাকে জিজ্ঞেস করলো আমি কিছু খাবোও কিনা। আমি বললাম, আমার পেট একদম ঠিক আছে। কোনও রকম অসুবিধা হচ্ছে না। পেট একদম হালকা। খিদেও আছে পেটে। এইকথা শুনে বউ দুপুরের খাবার নিয়ে এলো অল্প ক'রে ডাল ভাত আর আলুসেদ্ধ। আমি তাই খেয়ে কিছুক্ষণ এদিক ওদিক করার পর শুয়ে পড়লাম।
এমনি ক'রে সময় এগিয়ে গেল। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হ'লো। সন্ধ্যাবেলায় দেখলাম পেট একদম স্বাভাবিক। সামান্য চা বিস্কুট খেয়ে বসে গেলাম প্রাণায়ামে। সন্ধ্যে ৬টা থেকে ৮টা দুঘন্টা টানা প্রাণায়াম করলাম। শরীর একেবারে ঝরঝরে ফুলের মতো হালকা বোধ হ'লো।
এমনিভাবে সময় গড়িয়ে চললো আর নিশ্চিন্তে রাত কেটে এলো পরের দিন। পরের দিন সকালে ভয়ে ভয়ে পায়খানায় গেলাম। পরিস্কার স্বাস্থ্যকর পায়খানা হওয়ায় শরীরটা একেবারে তরতাজা সুস্থ মনে হ'লো। লুচি খাওয়ার কোনও রকম উল্টো প্রতিক্রিয়া হ'লো না। স্নান ক'রে পুজো পাঠ সেরে এসে বসলাম কিছু লেখালেখির কাজ করতে। যথারীতি টিফিন এলো। দেখলাম প্লেটে দু'টো লুচি আর তরকারি আর গরম চা। আজ আর মুড়ি এলো না। গরম গরম লুচি তরকারি দিয়ে খেয়ে ফেললাম ফটাফট। দু'টো লুচি খেয়ে মনটা ভরলো না। সামনে দাঁড়িয়ে দেখলো বউ আমার লুচি খাওয়া। তারপর প্লেটটা নেওয়ার সময় বললাম, আর একটা হবে না?
ক্রমশঃ
( লেখা ৯ই এপ্রিল ২০২৩)