সকালবেলায় বেরিয়েছিলাম সাংসারিক কয়েকটি কাজে। গত কয়েকদিন রামনবমী উপলক্ষ্যে আয়োজিত 'বিশেষ সৎসঙ্গ' এর জন্য মানসিক ও শারীরিক ব্যস্ততার চাপ জীবনকে অন্তর্মুখী ক'রে রেখেছিল। প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট নানারকম অবাঞ্ছিত বাধাবিঘ্ন কাটিয়ে যখন অনুষ্ঠান সুন্দরভাবে শেষ হ'ল ও অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য সফল হ'ল তখন অনাবিল এক আনন্দে ভেসে যেতে চাইলো মন। ভাবলাম, যাক সারা রাজ্য তথা দেশ জুড়ে পরমপ্রেমময় পুরুষোত্তম শ্রীশ্রীরামচন্দ্রের জন্মদিন নিয়ে শুভ রামনবমীতে অবাঞ্ছিত উন্মাদনার মাঝে প্রকৃতির রোষ নিয়ে যে পবিত্র দিনটা শেষ হ'লো সেই দিনটার সাক্ষী হ'য়ে রইলাম আমি ও আমার গুরুভাইবোনেরা মর্যাদা পুরুষ পরমপ্রেমময় পুরুষোত্তম শ্রীশ্রীরামচন্দ্রের নতুন রূপ পরমপ্রেমময় শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের 'মাতৃসম্মেলনসহ বিশেষ সৎসঙ্গ' আয়োজনের মধ্যে দিয়ে। হঠাৎ ওঠা কালবৈশাখীর দমকা হাওয়ার সাথে প্রবল ঝড়বৃষ্টিকে মোকাবিলা ক'রে তুমুল "রঘুপতি রাঘব রাজা রাম আর অনুকূল নামের জোয়ার এলো ভাসিয়ে দে না তরী" গানে ভেসে গেল চারপাশ। ভরপুর হ'য়ে গেল শরীর-মন-আত্মা!!!!!
কিন্তু এত আনন্দ ফেরির মাঝেও যেন মনে হচ্ছে একটা ছন্দপতনের সুক্ষ্ম আওয়াজ ভেসে আসছে কানে! মনে হচ্ছে কোথায় যেন কেটে গেছে সুর, তাল, লয়!! কোথায় যেন একটা বড় ফাঁক সৃষ্টি হ'য়ে গেছে!!! কারা যেন বিষাদের কালো ছায়ায় ঢেকে দিতে চাইছে আনন্দের আকাশ!!!! কেন এমন হ'লো!? এ কিসের লক্ষণ!! কিসের ইঙ্গিত!!!
যাই হ'ক, তবুও মনটাকে চাপমুক্ত রাখতে একটু রিল্যাক্স মুডে বেরিয়েছিলাম বাইরে, সংগে অনেকগুলি সাংসারিক কাজ নিয়ে। কয়েকটা কাজ শেষ ক'রে যখন অন্য একটা কাজে অগ্রসর হয়েছি সেইসময় একজন পাড়ার পরিচিত ডেকে দাঁড় করালো আমায়। কুশল বিনিময়ের পর সে রামনবমীতে অনুষ্ঠিত সৎসঙ্গ সম্পর্কে কথা তুললো। কথাপ্রসঙ্গে সে জানালো তার দুঃখের কথা। কয়েক বছর হয়েছে অবসর নিয়েছে। অবসরের কয়েক বছর পর কিছুদিন আগেও হেঁটেচলে বেড়ানো মানুষটা হঠাৎ শয়তানের ছোবলে এখন স্বাভাবিক হাঁটাচলা হারিয়েছে। আগের মত আর দৌড়ঝাঁপ করতে পারে না, হাতে লাঠি নিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটাচলা করতে হয়। আমার সাথে দেখা হ'লে একটু দাঁড়িয়ে কথা বলে। বুকের মধ্যে জমে থাকা কথা বেরিয়ে আসে অনর্গল। বুঝতে পারি চারপাশে প্রত্যেকেই বুকের মধ্যে একা একা বাস করে অনেক দুঃখ যন্ত্রণা নিয়ে; উপরে প্রকাশ পায় না, একান্তে বেরিয়ে আসে সেসব।
যাক সেসব কথা, আমাকে সে যা জানালো তা'তে বুঝতে পারলাম আমাদের কোন সৎসঙ্গী গুরুভাই তার সংগে কোনও অন্যায্য আচরণ করেছে যার জন্য তার মনে হয়েছে আমাকে তা জানানো দরকার আর তাই সে জানিয়েছে। নানাকথায় বুঝতে পারলাম তার নিকট জনদের মধ্যে কেউ ঠাকুরের দীক্ষিত; সে এ কাজ করেছে অর্থাৎ তাকে খোঁড়া, ল্যাংড়া ইত্যাদি ব'লে খোঁটা দেয়, ব্যঙ্গ করে। ঈশ্বরের অভিশাপ ব'লে গায়ের ঝাল মেটায়। বলতে বলতে তার চোখে জল এলো। আমি চুপ ক'রে শুনছিলাম আর ভাবছিলাম এই মানুষটার আমার গুরুভাইয়ের ব্যবহারে ঠাকুরের কাছে আসার রাস্তা বোধহয় বন্ধ হ'য়ে গেল। এটাই স্বাভাবিক ও বাস্তব যে আমার মন্দ কাজের দায় আমার পিতার না হ'লেও আমার পিতাকে আমার জন্য অপমানিত হ'তে হয়, লাঞ্ছিত হ'তে হয়। শুনতে হয় অমুক বাবুর ছেলে বলে। আমি তাকে বললাম, একজন তোমাকে খারাপ কথা বললো, খারাপ ব্যবহার করলো সেটা তোমার মনে দাগ কেটে যায় আর আমি যে তোমায় ভালোবাসি সেটা তোমার মনে দাগ কাটে না কেন? দশজনের মধ্যে নয়জন তোমায় আঘাত দেবে একজন তোমায় এত ভালোবাসা দেবে যে ঘটি উপচে জল পড়ার মত ভালোবাসা উপচে পড়বে সেটা তোমার ক্লান্ত শরীর মনকে একেবারে ভিজিয়ে দেবে। সেটা ভেবে দ্যাখো না কেন? আর তোমায় কেউ আঘাত করুক সেই সুযোগও তুমি কাউকে দাও কেন? তোমার কোন ত্রুটির জন্য এমনটা হয় সেটা কখনো ভেবে দেখেছো কি? এছাড়া সৎসঙ্গী, গুরুভাই, ঠাকুরের দীক্ষিত বলেই কি সে মহান মানব হ'য়ে গেছে? দেবতা হ'য়ে গেছে? ঠাকুর বলেছেন, "স্কুলে গেলেই তা'কে ছাত্র বলে না আর, মন্ত্র নিলেই তা'কে শিষ্য বলে না, হৃদয়টি শিক্ষক বা গুরুর আদেশ পালনের জন্য সর্ব্বদা উন্মুক্ত রাখতে হয়। অন্তরে স্থির বিশ্বাস চাই। তিনি যা'ই ব'লে দেবেন তা'ই ক'রতে হবে, বিনা আপত্তিতে, বিনা ওজরে বরং পরম আনন্দে।" আমরা কি ঠাকুরের কথা কেউ মেনে চলি না চলার চেষ্টা করি? তাই, এদের কথা ভেবে সময় নষ্ট ক'রে, শরীর মনকে কষ্ট দিয়ে লাভ নেই। Be practical. Be calm & quite. যে আমাকে ভাবে না তাকে নিয়ে দিনরাত ভেবে ভেবে কষ্ট পাওয়ার কোনও লাভ নাই। যে আমাকে নিয়ে ভাবে, আমার নিয়ে চিন্তা করে তাকে নিয়ে ভাবো, তার জন্য করো। এমন কেউ বান্ধব তোমার আছে কি, এমন কোনও বান্ধব সমাজে তুমি তৈরী করে রেখেছো কি যে তোমাকে নিয়ে ভাবার মত তার অমূল্য সময় নষ্ট করবে? যদি না থেকে তাহ'লে এসো ঈশ্বর আছেন একমাত্র যিনি আমি তাঁকে নিয়ে না ভাবলেও তিনি আমাকে নিয়ে প্রতিনিয়ত ভাবেন, এসো তাঁর স্মরণাপন্ন হ'ই, তাঁকে ভাবি, তাঁকে ভালোবাসি; তাহ'লে তুমি ভালো থাকবে বাকি জীবন।
এতসব কথা বলার পর তার মনটা একটু যেন শান্ত হ'ল। আমার দিকে তাকিয়ে হেসে দিল। একগাল হাসি দেখে আমারও মনটা আনন্দে ভরে গেল। গায়ে হাত রেখে বললো, দ্যাখো, তোমার কাছে কথা ব'লে মনটা হালকা হলাম। এখন আর মনের মধ্যে কোনও দ্বন্দ্ব নেই, নেই কোনও কষ্ট। এখন আমার আনন্দ হচ্ছে। কত কিছু জানা গেল তোমার সংগে কথা বলে।
এরকম যখন কথা বলছি তখন দেখলাম আমার থেকে কিছু দূরে দাঁড়িয়ে একজন আমাকে ডাকছে আর বলছে, দাদা, একটু ধরুন, একটু ধরুন। তাকিয়ে দেখলাম, দুজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। তার মধ্যে একজন অন্যজনকে দু'হাতে জড়িয়ে ধ'রে আছে আর লোকটা সমস্ত শরীর ছেড়ে দিয়েছে তার উপর। আশেপাশের সকলকে ডাকাডাকিতে অনেকে জড়ো হ'য়ে গেল। একজন মা জল নিয়ে এলেন; লোকটার চোখেমুখে ছিটিয়ে দেওয়া হ'লো। পাশের বাড়ি থেকে এক মা একটা পাখা নিয়ে এলেন, আমার হাতে দিয়ে বললেন একটু হাওয়া করতে। আমি হাওয়া করতে লাগলাম আর যে জল ছিটিয়ে দিচ্ছিল তাঁকে বললাম চোখমুখের সংগে ঘাড়ে ও কানে জল দিতে। ইতিমধ্যে যেখানে ঘটনাটা ঘটেছে সেখানে পাশেই একজন ডাক্তারের বাড়ি সেইসময় তিনি বাইরে এসেছিলেন তিনি এগিয়ে এসে বললেন অসুস্থ মানুষটার জামাটা খুলে দিয়ে শুইয়ে দেবার জন্য। একজন অ্যাম্বুলেন্স আনার জন্য বললেন। এর মধ্যে লোকটা চোখ খুলে তাকালো, আমি হাওয়া করতে করতে বললাম কেমন লাগছে এখন? লোকটা ধীরে ধীরে বলল, এখন ভালো লাগছে। আমি ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে? লোকটা চোখ খুলে তাকাতেই ডাক্তারবাবু ফিরে গেলেন। ফিরে যেতে যেতে বললেন, কি ক'রে বলবো কি হয়েছে? কি অসুখ আছে ভিতরে তাতো জানি না। এই কথা ব'লে ডাক্তারবাবু ঘরে ঢুকে গেলেন। আমি তার ঘরে ঢুকে যাওয়ার পথের দিকে চেয়ে রইলাম ভাবলাম...............!!!
দূরে একটা রিক্সা দাঁড়িয়েছিল। বউয়ার রিক্সা। অদভুত নাম! অদভুত চেহারা! যেমন রোগা তেমন লম্বা। আর সবসময় খেয়ে থাকে। তবে, রিক্সা ঠিকঠাক চালায়। একটায় অসুবিধা শুধু, তা হ'লো ৫মিনিটের রাস্তা ২০মিনিট লাগিয়ে দেয়। এই অসুস্থ লোককে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এই লোকই শ্রেয়। রিক্সা আসার পর অসুস্থ মানুষটিকে রিক্সায় তুলে দিয়ে হাসতে হাসতে বললাম, কি হ'লো হঠাৎ? কিচ্ছু চিন্তা করবেন না, এরকম হ'তেই পারে। খালি পেট কিম্বা গ্যাসের জন্য হ'তে পারে। এ এমন কিছু না। আপনি ভালো হ'য়ে গ্যাছেন। হয়তো রোদে মাথা ঘুরে গ্যাছে। বাড়ি গিয়ে একটু খেয়ে শুয়ে থাকবেন। সঙ্গের লোকটিকে বললাম, ডাক্তার দেখিয়ে একটু প্রেসারটা চেক করিয়ে নেবেন। অসুস্থ লোকটি হেসে মাথা নাড়ালো। রিক্সা ধীরে ধীরে এগিয়ে চললো। লোকটির দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলাম। যাক বিপদ মোটামুটি কেটে গেছে। মনে আনন্দ হ'লো যাক হাসি মুখে ফিরে যাচ্ছে লোকটি বাড়ি। পরে জানা গেল লোকটি বাড়ি থেকে সকালবেলা খালি পেটে বাইরে এই রোদের মধ্যে বেরিয়ে পড়েছিল আর তাইতে মাথা ঘুরে যায়। ফলে বিপদজনক ঘটনা ঘটে যায়। কিন্তু বেশী কিছু বাড়াবাড়ি হয়নি।
যাই হ'ক বড় কিছু হওয়ার আগেই ঈশ্বরের কৃপায় লোকটি স্বাভাবিক চেতনায় ফিরে আসে ও বাড়ি ফিরে যায়। যাওয়ার আগে আমার দিকে চেয়ে একটা হালকা মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে দিয়ে গেল। মনে বেশ আনন্দ হ'লো। নিজেকে হালকা বোধ হ'লো আমার। লোকটি চলে যাবার পর সবাই যে যার মত চলে গেলে আমিও আমার গন্তব্যের দিকে রওয়ানা দিলাম। মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগলো, কখন যে কার কি হয় কেউ জানে না!!!!!!!!
(৩১শে (মার্চ ২০১৮ লেখা)
No comments:
Post a Comment