যে কাজ আপাত ভালো হ'লেও, যুক্তিপূর্ণ মনে হ'লেও সুদূর প্রসারী কি ফল প্রসব করবে তার চিন্তা করার শক্তি, দৃষ্টি যদি মোড়লদের না থাকে তাহ'লে যা হবার তাই হয় আর দেশ জুড়ে হয়েছেও তাই, হচ্ছেও তাই আর অনন্তকাল যতদিন সৃষ্টি থাকবে, হবেও তাই। আপাত ভালো কাজের নামে বা আদর্শের নামে যে বিকৃতি আমি চাষ করেছি ও করছি বা করে যাবো তার ফসলও ফলবে তাই। নষ্ট বীজে যদি জন্মায়ও নষ্ট চারাগাছই জন্মাবে আর ফলও দেবে তাই-ই। ভালো কাজ, আদর্শ কখনও বিকৃতির জন্ম দেয় না। প্রেম কখনও হিংসার জন্ম দেয় না। প্রেমের বুক থেকে হিংসার কখনও প্রতিফলন হয় না। ঠিক তেমনি যা ভালো বা আদর্শ তার প্রতিফলন কখনও কোনও অবস্থাতেই, কোনও সময়েই কালো হয় না, খারাপের বিন্দুমাত্র সম্ভাবনাকে ডেকে আনে না। তাই সমাজ ও দেশ গঠনের নামে, স্বাধীনতার নামে রাজনীতিতে, ধর্মে, শিক্ষায় এবং শিক্ষা ও চেতনা বিস্তারের নামে কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে, প্রবন্ধে যে মহান আত্মা যে আন্দোলনের জন্মই দিক না কেন ঠাকুরের বলা “উত্তেজিত মস্তিষ্ক ও বৃথা আড়ম্বরযুক্ত চিন্তা”-র উপর ভর ক'রে সেই আন্দোলনের ভ্রূণেই অর্থাৎ জৈবি সংস্থিতি যাকে বায়োলজিক্যাল মেক আপ বলে তার মধ্যেই সুদূর প্রসারী ভুল ও তার মারাত্মক পরিণতির সম্ভাবনা নিহিত থাকেই থাকে। কারণ তাঁরা কত দূর দেখবার ক্ষমতা রাখেন? তাঁরা যারা সমাজ, দেশ, সংস্কৃতি, শিক্ষা ইত্যাদির রূপকার এক কথায় মহান আত্মা তাঁদের প্রত্যেকের জীবনেই, জীবনের শুরু থেকে হাজার ভুল। ভুলের উপর দাঁড়িয়েই সেই ভুলকে চিনতে পেরেছেন অনেক ক্ষয় ক্ষতি স্বীকার করার পর তারপর তাঁরা সেই পথ সম্পর্কে সাবধান করেছেন কিন্তু যে আরো সাঙ্ঘাতিক ভুল আগামীতে অপেক্ষা করছে সেই ভুল সম্পর্কে সেই মহান আত্মা ছিলেন বা আছেন অজ্ঞ, অন্ধ; সে সম্পর্কে সাবধান করার ক্ষমতা তাঁর বা তাঁদের ছিল না বা নেই। অতএব সেই ভুলের খেসারত তাঁরা তো দেবেনই যদি তাঁরা ততদিন বেঁচে থাকেন তাছাড়া তাঁদের ভুলের জন্য, কৃত অপরাধের জন্য গোটা সমাজ, দেশ, মানবজাতিকে দিতে হবে ভয়ঙ্কর খেসারত কারণ তাঁদের উপর নির্ভর করেছিল বা করছে গোটা জাতি, গোটা সমাজ। আর যে ভুলের বিষবৃক্ষ তাঁরা স্থাপন ক'রে গেলেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সেই বিষবৃক্ষের ফল তো পরবর্তী প্রজন্ম খাবেই আর ছড়িয়ে যাবে তার বীজ বংশপরম্পরায় রেতঃ ধারার মধ্যে দিয়ে গ্রামে, গঞ্জে, শহরে, বন্দরে, পাহাড়ে-পর্বতে, বনে-বনান্তরে আসমুদ্রহিমাচলব্যাপী আর তার পরিণাম হবে ভয়ংকর যা এড়িয়ে যাবার বা এর থেকে নিস্তার বা মুক্তি পাবার কোনও উপায় থাকবে না। কর্মফল ভোগ করতে হবেই এতে কোনও সংশয় নেই, দ্বিধাদ্বন্দ্ব নেই, নেই কোনও দ্বিমত।
কথাগুলি মনে এলো কয়েকটা ঘটনা থেকে। আজ সকালে পরিচিত বন্ধু বান্ধব, শুভানুধ্যায়ী কয়েকজনের সংগে সাক্ষাৎ হ'য়েছিল। তাদের মধ্যে যেমন ছিল গুরুভাই, তেমন ছিল ছোট ও বড়বেলার কয়েকজন রাজনৈতিক দলের সংগে যুক্ত বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ী। কথা হচ্ছিল নানা বিষয় নিয়ে। কথা বলতে বলতে আলোচনায় উঠে এলো সাম্প্রতিক রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিয়ে। উঠে এলো লেনিনের মূর্তি ভাঙ্গা প্রসঙ্গ, উঠে এলো সংবাদে উঠে আসা শ্যামাপ্রসাদের মূর্তি ভাঙ্গা ও তার প্রতিক্রিয়াস্বরুপ প্রধানমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া এবং কথা প্রসঙ্গে অতীত ও বর্তমানে সংঘটিত আরও অনেক কর্মকান্ড। আলোচনা খুব জমে উঠেছিল। প্রত্যেকেই নিজের নিজের দৃষ্টিকোণ থেকে বক্তব্য রাখছিল। পরস্পরবিরোধী বক্তব্যে, আলোচনায় চনা পড়ার অবকাশ থাকলেও পারস্পরিক সম্মানজনক দূরত্ব বজায় রাখার মানসিকতা সেই সম্ভাবনাকে বাস্তবায়িত হ'তে বাধা দিয়েছিল। সবার কথাগুলি শুনছিলাম মন দিয়ে আর তারা অপেক্ষা করছিল আমার প্রতিক্রিয়া জানতে। কথাগুলি শুনতে শুনতে আমার মনে আমার গুরুদেব অনুকূল ঠাকুরের অপূর্ব সুন্দর হাসিমাখা মুখটা ভেসে উঠছিল আর মনে পড়ছিল তাঁর ব'লে যাওয়া লক্ষ লক্ষ কথা ও হাজার হাজার বাণীর কয়েকটা কথা ও বাণী। উপলব্ধি হ'লো তাঁর কথা ও বাণীগুলির। তখন উপরে উল্লিখিত কথাগুলি আলোচনায় আমি তুলে ধরেছিলাম আর বলেছিলাম নিম্নে উল্লেখিত ঠাকুরের বাণীগুলি সংগে আরও সামান্য কিছু উপলব্ধি। সেগুলিও পাঠকদের জন্য তুলে ধরলাম।
“যা’ ইচ্ছা তাই করবে তুমিতা’ কিন্তু রে চলবে না,
ভাল ছাড়া মন্দ করলে
পরিস্থিতি ছাড়বে না।“
“উচিত-বাদের দম্ভ কর
হিতের ধারটি ধারছ না,
এমন চলায় চললে জেনো
পাবেই পাপের লাঞ্ছনা।“
“দেশের সেবার ধুয়ো ধ’রে
জানিস কী যে করলি তা’,
কি পেতে কী করতে হয়
আছে কি তার দর্শিতা?”
শ্রীশ্রীঠাকুরের বাণীগুলি তুলে ধ’রে স্বাভাবিকভাবেই বললাম, এই যে মূর্তি ভাঙার বা যে কোনও কিছু ভাঙ্গাভাঙ্গির খেলা তো আজকে নতুন নয়। এর সূত্রপাত তো বহু আগে থেকেই। স্বাধীনতার কথা যদি ধরা যায় তখনও দেশনেতাদের প্রত্যক্ষ মদতে ভাঙ্গা, অগ্নিসংযোগ, অসহযোগ ইত্যাদি পথ স্বাধীনতা আন্দোলনের হাতিয়ার ছিল। আর তার পরোক্ষ প্রভাব পড়েছে পরবর্তী জনজীবনে। আর দেশ ভাঙার থেকে বড় ভাঙ্গা আর কি হ’তে পারে!? দেশ ভাঙার খেলার থেকে তো কারও মূর্তি ভাঙার খেলা বা নাটক বড় বা বেশী গুরুত্বপূর্ণ নয়। দেশ ভাঙার ভয়ঙ্কর খেলা দিয়ে যে ভারত নেতৃত্বের হাতে খড়ি পরবর্তী সময়ের বা প্রজন্মের নেতৃত্বের বা ভারতীয় জনগণের সেই হাতে মূর্তি ভাঙা কি এমন অবাকের বা অপরাধের!? এটাই তো হওয়ার কথা। নষ্ট বীজে নষ্ট চারাগাছ তো জন্মাবেই আর তার ফলও হবে পোকায় খাওয়া বিষাক্ত নষ্ট ফল। সেদিন ঠাকুর দেশ নেতাদের উদ্দেশ্যে সাবধান ক’রে দিয়ে বার্তা পাঠিয়ে বলেছিলেন, “Dividing compromise is the hatch of animosity.” ভাগ ক’রে সমাধান করার অর্থ তা দিয়ে শত্রুতার ডিম ফোটানো। আজ তা দিয়ে শত্রুতার ডিম ফোটানো কাকে বলে তা সেই স্বাধীনতার পর থেকেই দেশের ভিতরে ও পার্শ্ববর্তী পাকিস্থান ও বাংলাদেশের প্রতিদিনের ঘটনাবলীতে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে ভারতবাসী ও সমগ্র বিশ্ব!
আবার এই যে গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলন সেই অসহযোগ আন্দোলনও সত্যদ্রষ্টা পুরুষোত্তম শ্রীশ্রীঠাকুর সমর্থন করেননি। সেদিনের ঠাকুরের অসহযোগ আন্দোলন সম্পর্কিত বক্তব্য স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ কেউ মেনে নিতে পারেননি। সেদিনের দেশ সেবার নামে অসহযোগিতার মানসিকতা অদূর ভবিষ্যতে কি বিষময় পরিণতি পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ব’য়ে আনতে পারে তার কল্পনাও সেদিনের নেতৃবৃন্দ করতে পারেননি। উচিত-অনুচিতের ফারাক ছিল না বোধের ঘরে। যা সেদিন তাৎক্ষণিক উচিত মনে হয়েছে তাই করেছে হিতাহিতের ধার না ধেরে। ভালো ছাড়া মন্দ করলে পরিস্থিতি যে ছেড়ে কথা বলবে না তা স্বাধীনতা পরবর্তী এবং বর্তমান সময়ের আগেপিছে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি তার জ্বলন্ত প্রমাণ। যেমন আজ প্রতি পদক্ষেপে দেখতে পায় কোনও কিছু গঠনমূলক কাজের জন্য কেউ কাউকে সহযোগীতার হাত বাড়ায় না তা রাজনৈতিক, সামাজিক বা ধর্মীয় যে ক্ষেত্রই হ’ক না কেন কিম্বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা কর্ম প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি যে প্রতিষ্ঠানই হ’ক না কেন। মানুষের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে ঘরে বাইরে প্রতিটি মানুষের মধ্যে অসহযোগিতার বিষ! যা আজ বিশাল বিষবৃক্ষ হ'য়ে ডালপালা ছড়িয়ে পড়েছে আসমুদ্রহিমাচল ব্যাপী।
ঠিক তেমনি আজ যারা যে দলেরই হ'ক না কেন মূর্তি ভাঙার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, আন্দোলন সংগঠিত করছে তারাও একবার অতীতের দিকে মুখ ফিরিয়ে দেখলে দেখতে পাবে দেশ জুড়ে এই ভয়ঙ্কর ভাঙার নাটকের বা খেলার একদিন তারাও কুশীলব বা খেলোয়াড় ছিল; আর তাদের পূর্ব পুরুষরা ছিল দেশ ভাঙার ভয়ঙ্কর কারিগর; যে ভাঙার ভয়ঙ্কর বিষে নীল হ'য়ে গেছে স্বাধীনতা পরবর্তী প্রজন্মের হাত। এস ওয়াজেদ আলির সেই বিখ্যাত কথা “সেই ট্রাডিশান সমানে ব’য়ে চলেছে” সুরে বলা যেতে পারে সেই অসহযোগিতা বা সেই ভাঙার ভয়ঙ্কর খেলা বা নাটকের ট্রাডিশান সমানে ব’য়ে চলেছে মাত্র; যার পরিণতি ধ্বংস। সেই অপেক্ষায় টিকটিক ক’রে এগিয়ে চলেছে সময় নীরবে, নিঃশব্দে!!!
No comments:
Post a Comment