Powered By Blogger

Wednesday, October 8, 2025

প্রবন্ধঃ নাস্তিক ও আস্তিক আর স্বীকার ও অস্বীকার এবং গ্রহণ ও বর্জন ।

নাস্তিক আর আস্তিক শব্দ নিয়ে ঈশ্বর বিশ্বাসী আর ঈশ্বর অবিশ্বাসীদের মধ্যে লড়াই আজও বিদ্যমান। নাস্তিক কেউ না, সবাই আস্তিক। কারণ প্রত্যেকের অস্তিত্ব আছে, আর সবাই অস্তিত্বে বিশ্বাসী, বিশ্বাসী পারিপার্শ্বিক সহ নিজের অস্তিত্ব রক্ষা ও তার শ্রীবৃদ্ধিতে। তাই কেউ নাস্তিক নয়, সবাই আস্তিক।

মানুষের ধারণা ঈশ্বরকে যে বিশ্বাস করে সে আস্তিক আর ঈশ্বরকে যে বিশ্বাস করে না সে নাস্তিক। ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে কি নেই তা' নিয়ে তর্কবিতর্ক বা বিশ্বাস অবিশ্বাস করার দরকার নেই, নিজের অস্তিত্বকে বিশ্বাস করে কিনা সেটাই মুখ্য। যে নিজের অস্তিত্বকে বিশ্বাস করে, অনুভব করে, উপলব্ধি করে সে অস্তিত্বের অস্তিত্ব পরম অস্তিত্বকে, উৎসের উৎস পরম উৎসকে, কারণের কারণ পরম কারণকে বিশ্বাস করে, অন্বেষণ করে। ভেবে দেখে আমি কেন জন্মেছি সেই কারণ জানার।
পরমপ্রেময় শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র বললেন,
" তুমি কেন জন্মেছ মোটাভাবেও কি দেখেছ ? থাকাটাকে কি উপভোগ ক'রতে নয় ---- চাহিদা ও কর্ম্মের ভিতর - দিয়ে পারস্পরিক সহবাসে ----- প্রত্যেক রকমে ?
তেমনি বুঝছ না ভগবান কেন সৃষ্টি ক'রেছেন ? উত্তর কি এখন ?----- নিজেকে অনুভব ক'রতে , উপভোগ ক'রতে ---- বিশ্বে , প্রত্যেক অনুপাতে --- দেওয়ায় , নেওয়ায় -- আলিঙ্গনে , গ্রহণে , কর্ম্মবৈচিত্রে , ----- নয় কি ? "

তাই ঈশ্বরে বিশ্বাস বা অবিশ্বাস করা আমার নিজের ব্যাপার। আমি স্বাধীন। আমার স্বাধীনতায় স্রষ্টা কোনও হস্তক্ষেপ করেন না। স্রষ্টা একমাত্র গণতান্ত্রিক পুরুষ অর্থাৎ তিনিই এক ও একমাত্র নিরপেক্ষ, ন্যায়পরায়ণ এবং সকলের প্রতি তাঁর সমান অধিকার। স্রষ্টা নিজেই এমন একটি আদর্শের প্রতীক যা সকলের জন্য প্রযোজ্য।
তাই আমি স্রষ্টার অস্তিত্বকে, স্রষ্টার মানুষী রূপকে মানতে পারি আবার অগ্রাহ্য করতেও পারি। তাঁর দেখানো পথে চলা শুরু করতেও পারি আবার উল্টো পথেও চলতে পারি। এটা আমার অধিকার। তাঁর দেখানো পথ গ্রহণ ও বর্জন করার অধিকার আমার আছে। জাগতিক ভাবে আমার সংসারে যে নিয়ম, স্রষ্টার দরবারেও তাই নিয়ম। আমাকে আমার পিতা মাতা পৃথিবীর আলো দেখিয়েছেন, তাই তাদের একটা দায়িত্বও আছে আমাকে রক্ষা করার, বাঁচার ও বেড়ে ওঠার পথে চালিত করার জন্য আমাকে গাইড করার। এবার আমি বড় হয়েছি, আমি স্বাধীন, আমি সেই গাইডেন্স অনুযায়ী জীবনে চলতেও পারি, আবার নিজের ইচ্ছেমত নিজের জীবনকে চালাতে পারি। তাদের কথা শুনতেও পারি, আবার নাও শুনতে পারি। বড় জোর আমার জাগতিক পিতামাতা চেঁচামেচি করতে পারেন, মারধর করতে পারেন আমাকে তা' আমি যতদিন ছোটো ততদিন কিন্তু আমি যখন বড় হ'য়ে গেছি, বৃত্তি-প্রবৃত্তির বৃত্তে ঘোরা শুরু করেছি, রিপুর গরম উপস্থিতি অনুভব করতে শিখেছি শরীরে-মনে তখন তাঁদের কথা অনুযায়ী আমি চলবো কি চলবো না সেটা আমার একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার ও সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ ব্যক্তিগত।

আমার ইচ্ছা তখন একান্তই আমার, আমি আমার নিজের ইচ্ছেমত চলতে পারি, নিজের ইচ্ছের ডানা মেলে উড়তে পারি। সেখানে পিতামাতা কিছু করতে পারেন না, তাঁরা আমার এই পৃথিবীতে আসার কারণ হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা আমার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে পারেন না, করলেও আল্টিমেট কোনও লাভ হয় না, সফল হ'ন না, কারণ আমি তাঁদের কথা শুনি না, তাঁদের পরামর্শ নিই না, নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করি না। আমি স্বাধীনচেতা, পরাধীনতা আমার চেতনায় নেই। গলায় বকলেস বাঁধা পোষা কুকুর হ'তে আমি রাজী ন'ই, আমার আত্মমর্যাদায় বাধে, অহংবোধের প্রাবল্যে আমি মুক্তমনা। আমার পিতামাতা আমায় জন্ম দিতে পারে কিন্তু আমার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে পারেন না। তাই এমতাবস্থায় আমার পিতামাতা পরাধীন। আমার পিতামাতা বোঝে না যে আমি চড়ুই পাখি হ'তে চাই না, আমি বাবুই পাখি, বা বাবুই পাখি হ'তে চাই। কবি রজনীকান্ত সেন আমার আদর্শ। কবি রজনীকান্ত সেনের বিখ্যাত কবিতা "স্বাধীনতার সুখ" আমার পথ চলার দর্শন, আদর্শ। 'স্বাধীনতার সুখ' কবিতায় কবি বলছেন,
"বাবুই পাখিরে ডাকি, বলিছে চড়াই,
কুঁড়ে ঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই,
আমি থাকি মহা সুখে অট্টালিকা পরে,
তুমি কত কষ্ট পাও রোদ-বৃষ্টি-ঝড়ে।"

উত্তরে বাবুই পাখি বলছে,
বাবুই হাসিয়া কহে, “সন্দেহ কি তায়?
কষ্ট পাই, তবু থাকি নিজের বাসায়।
পাকা হোক, তবু ভাই, পরের ও বাসা,
নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর, খাসা।”

এই কবিতার বাবুই পাখির মত স্বাধীনতা, আত্মমর্যাদা সবাই চায়, আত্মসম্মানবোধ সবার আছে। সবাই চায় নিজের পায়ে দাঁড়াতে, সবাই চায় নিজের সৃষ্টির স্বীকৃতি পেতে, স্বীকৃতি পাক, না-পাক নিজের সৃষ্টির প্রতি স্রষ্টার ভালোবাসা ও গর্ব থাকেই। তাই নিয়ে সে বড়াই করতেই পারে। কিন্তু সেই বড়াই, সেই গর্ব, সেই অহংকার যেন তার স্বাধীনতাকে, স্বাধীনতার অর্থকে কলুষিত না করে, ভারসাম্য নষ্ট না করে।
আবার কারও নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে থেকে, সুখে থেকে সেই আশ্রয়কে নিয়ে অহংকারে অন্যকে ছোটো করা, অন্যের ছোট্ট আশ্রয়কে অপমান করা যেমন অন্যায়; ঠিক তেমনি অপরের আশ্রয়ে থেকে সেই নিশ্চিন্ত আশ্রয়কে অস্বীকার করা, আশ্রয়কে taken for granted ক'রে নেওয়া অর্থাৎ কারও আশ্রয়ে থেকে তার দয়া, করুণাকে প্রকৃত মূল্য না দিয়ে বা আশ্রয়দাতার গুরুত্বকে অবমূল্যায়ন ক'রে ধরে নেওয়া যে এই আশ্রয় আমার অধিকারের মধ্যে পড়ে এবং এই অধিকার আমার সবসময় থাকবে বা পাওয়া যাবে; এটা ভাবাও তেমনি অন্যায় ও মূর্খামি।
তাই, স্বাধীনতার অর্থ বেঈমানি, অকৃতজ্ঞতা ও নেমকহারামী নয়। স্বাধীনতার অর্থ অহংকার বা অহংকারী হওয়া নয়। স্বাধীনতার অর্থ উচ্ছৃঙ্খলতা নয়, স্বাধীনতার অর্থ উৎসকে অস্বীকার করা নয়। স্বাধীনতার অর্থ কু-এর অধীন হওয়া নয়।

স্বাধীনতার অর্থ সু-এর অধীন হওয়া। স্বাধীনতার ইংরেজী Independence কিন্তু এর প্রকৃত অর্থ Interdependence অর্থাৎ পরস্পর নির্ভরতা, পরস্পর পরস্পরের প্রতি নির্ভশীল হওয়া। সেই নির্ভরশীলতা, সেই কৃতজ্ঞতা, সেই বিশ্বস্ততা বাপের প্রতি বা স্রষ্টার প্রতি যার থাকে না সে কি জানি না, তবে মনুষ্য পদবাচ্য নয় এবং সে মহামূর্খ ও পাগল।

আর, যে বাপকে বাপ ব'লে স্বীকৃতি দেয় না, উৎসকে স্বীকৃতি দেয় না, তা'তে বাপের বা উৎসের কিচ্ছু যায় আসে না, বাপ যদি পুত্রকে পুত্র ব'লে পরিচয় না দেয়, উৎস যদি তাকে স্বীকৃতি না দেয় তাহ'লে সে জারজ ব'লে বিবেচিত হয়।

যাই হ'ক শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের দৃষ্টিতে বিষয়টি দেখবার ও বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করলাম। এই বিশ্লেষণ গ্রহণ ও বর্জনের অধিকারও পাঠকের নিজস্ব। গ্রহণও করতে পারে, বর্জনও করতে পারে।

No comments:

Post a Comment