পূর্ব প্রকাশের
পর।
প্রণাম জানাই তোমার
শ্রীচরণে।
অবিনদাদার প্রশ্নের
উত্তরে আমি মেয়েকে দেখিয়ে বললাম, 'ও বাবাইদাদাকে ওর চাকরীর সমস্যার কথা বিস্তারিতভাবে
জানিয়েছিল। ও যেখানে কাজ ক'রে সেখানে যেতে আসতে ছ’ঘন্টা সময় লাগে। ক্লান্ত হ'য়ে পরে।
বাবাইদাদা সব শুনে মেয়েকে আশীর্বাদ ক'রেছিলেন। বলেছিলেন, সব ঠিক হ'য়ে যাবে। ঠাকুরের
প্রতি বিশ্বাস রাখতে, নির্ভর করতে। বাবাইদাদার আশীর্বাদের পরেই 'ইউনাইটেড ওয়ার্ল্ড'
থেকে সেখানে জয়েন করার জন্য অফার এসেছে। পরের মাসের পয়লা আগস্ট থেকে জয়েন করতে বলেছে।
তাই এসেছিল বাবাইদাদাকে জানাতে সেখানে জয়েন করবে কিনা। কিন্তু এসে জানতে পারলো বাবাইদাদা
দর্শন দেবেন না। তাই আপনি যদি............... বলেই চুপ করে গেলাম। শুধু মেয়েকে বললাম,
'তুই বল।‘ মেয়ে চোখের জল মুছে বললো, 'আমি এখন যেখানে কাজ করি সেখানে যেতে আসতে ছ’ঘন্টা
লাগে। খুব কষ্ট হয়। বাবাইদাদাকে কষ্টের কথা সব জানিয়েছিলাম। আমি আর পারছি না। যেতে
আসতে ৩ঘন্টা +৩ঘন্টা= ৬ঘন্টা লেগে যায়। বাবাইদাদা সব শুনে বলেছিলেন, ‘এইভাবে কন্টিনিউ
করলে জীবনীশক্তি ক’মে যাবে।‘ তখন আমি বলেছিলাম, আপনি আশীর্বাদ করুন যেন আমি কাছাকাছি
পেয়ে যায়।‘ বাবাইদাদা বলেছিলেন, ‘ঠিক আছে, পেয়ে যাবি।‘ বাবাইদাদা আশীর্বাদ করেছিলেন
আর তারপরেই আমি কোনও যোগাযোগা না করা সত্ত্বেও ‘ইউনাইটেড ওয়ার্ল্ড’ থেকে অফার এসেছে
সেখানে জয়েন করবার জন্য। তাই আমি জয়েন করবো কিনা বাবাইদাদাকে জানাতে এসেছিলাম; কিন্তু
বাবাইদাদার.........‘ এই পর্যন্ত ব’লে মেয়ে আমার চুপ ক’রে গেল। তারপর বললো, ‘আমি জয়েন
করবো?’ তখন অবিনদাদা মেয়ের কাছে জানতে চাইলেন চাকরী সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়। মেয়ে ‘ইউনাইটেড
ওয়ার্ল্ড’ সম্পর্কিত বিষয় ও কাজের বিবরণ, ডিপার্টমেন্ট, পজিশান, মাহিনা, বাড়ি থেকে
দূরত্ব, যেতে আসতে সময় ইত্যাদি সব একে একে যেমন যেমন অবিনদাদা জানতে চাইলেন ঠিক তেমনি
তেমনি মেয়ে তাঁর কাছে তুলে ধরলো। আমি আর আমার ছেলে ওদের কথার মাঝে পাশে দাঁড়িয়ে সব
শুনলাম। আমি অবাক হ’য়ে মনে মনে ভাবছিলাম এই অল্প বয়সে একজন কত পরিণত হ’লে, কত মেধার
অধিকারী হ’লে চাকুরী সংক্রান্ত এত নিখুঁত আলোচনা করতে পারে! কত আত্মমগ্ন ধীরস্থির হ’লে,
কত শারীরমানস ও আত্মিকতায় মিশে জমাট ক্ষীর হ’লে তাঁর চেয়ে বয়সে বড় সিদ্ধান্তহীনতায়
ভুগতে থাকা দিশেহারা একজন চাকুরিরতা মেয়েকে সহজ নিখুঁত সমাধান দিতে পারে তা’ নিজের
চোখে, নিজের কানে না দেখলে, না শুনলে বিশ্বাস হ’ত না! মেয়ের মুখে পরপর সব শুনে অবিনদাদা
মেয়েকে হেসে বললেন, ‘আপনি ইউনাইটেড ওয়ার্ল্ডে জয়েন করুন। পরে সময়মত একবার এসে বাবাকে
জানিয়ে আশির্বাদ নিয়ে যাবেন।‘ মেয়ের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। অনেকদিন পর মেয়েকে এমন নির্মল
হাসি হাসতে দেখে আমার মন আনন্দে ভরে উঠলো। তারপর হাসতে হাসতে ছেলের দিকে তাকিয়ে অবিনদা
বললেন, ‘তোর কি হয়েছে?’ ছেলে একবার আমার দিকে আর একবার অবিনদার দিকে তাকালো, কি করবে
বুঝে উঠতে সময় নিচ্ছিলো। আমি ছেলেকে হাত ধ’রে কাছে টেনে নিলাম। বললাম, অবিনদাদাকে বল
তোর কথা। ছেলে সাহস ক’রে তার বর্তমানে যেখানে চাকরী করে সেই ফ্রেঞ্চ মাল্টিন্যাশানাল
সারভিসেস অ্যান্ড বিজনেস কন্সাল্টিং করপোরেশানের কথা জানিয়ে অন্য আর এক আমেরিকান মাল্টিন্যাশানাল
করপোরেশান আই টি সেক্টরে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করায় অবিনদা বললেন, ‘কেন এখন যেখানে আছিস
সেখানে কি খারাপ আছিস? কোনও অসুবিধা হচ্ছে? উত্তরে ছেলে যা বললো তা হ’লো,
এখন যেখানে চাকরী
করছে সেই চাকরিটা বাবাইদাদার আশীর্বাদে পেয়েছিল। চাকরিটা পাবার পর কিছুদিন খুব অসুবিধা
হয়েছিল, চাকরিতে টিকে থাকাটাই প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। কেউ কো-অপারেট করতো না।
একা একা বসে থাকতো। কাজ না বুঝতে পারলে কেউ এগিয়ে এসে কাজ বুঝতে সাহায্য করতো না। ভুল
না হ’লেও বলতো ভুল হয়েছে আর সামান্য ভুল হ’লে বড় ক’রে দেখাতো। কাজ যাতে না বুঝতে পারে,
না করতে পারে তার জন্য পুরোনো কর্মীরা সবসময় সচেষ্ট থাকতো। সারাদিন কাজ ক’রেও নিজের
যোগ্যতা প্রমাণিত হ’তো না, আর যারা কিছু করতো না, শুধু ম্যানেজারের ঘরে বসে থাকতো,
ফাইফরমাশ খাটতো তারা হাইলাইট হ’তো। এমন অবস্থায় মানসিক বিপর্যস্ত হ’য়ে ঠাকুরবাড়ি ছুটে
এসেছিল বাবাইদাদার কাছে। বাবাইদাদার কাছে নিবেদন করেছিল সমস্যার কথা। বাবাইদাদা তখন
ছেলেকে বলেছিলেন, ‘যারা কাজ করে, যারা কাজে যোগ্য তাদের ম্যানেজারের দয়ার দরকার হয়
না; ফেবার তাদের দরকার হয় যারা অযোগ্য ও অদক্ষ, যারা কাজে ফাঁকি দেয়। তোমাকে যে কাজ
দেওয়া হয়েছে সেই কাজ তুমি মন দিয়ে ক’রে যাও। অন্য কোনও দিকে মন দিতে যেও না। তোমার
কাজ শুধু তোমার কাজ মন দিয়ে করা আর সকলের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়ে তোলা।‘ তারপর থেকে
বাবাইদাদার নির্দেশ মতো শুধু কাজের দিকেই মন দিয়েছে ছেলে; আর, তার পুরস্কার স্বরূপ
বাবাইদাদার আশীর্বাদে পরবর্তী ছ’মাসের মধ্যে ‘Employee of the year’ নির্বাচিত হয় এবং
পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কৃত হয়। পরে কাজের ফলস্বরুপ উন্নতিও হয়। পরবর্তী সময়ে সেই কথা
বাবাইদাদাকে নিবেদন করে এবং পুরস্কৃত অর্থ ঠাকুর প্রণামী হিসাবে ফিলান্থ্রপি অফিসে
জমা দেয়। বাবাইদাদা খুব খুশী হন।
ছেলের সমস্ত কথা মন
দিয়ে শোনার পর অবিনদা ছেলেকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তাহ’লে কর্মস্থল পরিবর্তন করার দরকার কি?
শোন, এখন পকেটে যা ঢুকছে তা’তে কি ভালো লাগছে না? ওখানে জয়েন করার কিছুদিন পরে বের
ক’রে দিলে ভালো হবে? একূল, ওকূল দুকূল যাবে নাকি? এখন যেখানে করছিস বা যেখানে যেতে
মন চাইছে যেখানেই থাক বা যা না কেন কোম্পানির সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখতে হয়, যাতে পরে
কোনও অসুবিধা না হয়। যদি যেতে হয় তাহ’লে কোম্পানিকে ব’লে যাওয়া উচিত। আর এক্ষেত্রে
ঐ কোম্পানিকে বলা উচিত এখন আমি যেতে না পারলেও ভবিষ্যতে আমি যোগাযোগ করবো। শোন, এখন
এখানেই মন দিয়ে কাজ কর।‘ তারপরে প্রায় একই রকম এক ঘটনার কথা তুলে ধ’রে বললেন, ‘আমার
এক পরিচিত মাইক্রো সফটে কাজ করে। গুগুল আরও বেশী টাকার অফার দিয়ে তাকে তাদের কোম্পানিতে
জয়েন করতে বলে। তখন ও মাইক্রো সফট কোম্পানির ম্যানেজমেন্টকে সে কথা জানায়। মাইক্রো
সফট তাকে আরও বেশী টাকা দেবে ব’লে জানায়। তখন সেই কথা সে গুগুলকে বলে এবং স্বাভাবিকভাবেই
বর্তমানে যা পাচ্ছে তার বেশী দাবী করে। গুগুল তখন তাকে পরবর্তী সময়ের জন্য ভেবে দেখবে
ব’লে জানায়। এক্ষেত্রে সে উভয়ের সঙ্গেই সুসম্পর্ক বজায় রাখে। তুই এখন যা পাচ্ছিস তাই
নিয়ে আনন্দের সঙ্গে এখানেই কাজ কর। সময়মত সব হবে। ঠিক আছে?‘
এইকথা শুনে ছেলে আমার খুশী হ’য়ে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। আমি বিস্ময়ে হতবাক হ’য়ে শুধু চেয়েছিলাম অবিনদার মুখের দিকে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় আমি ছেলেমেয়েকে নিয়ে তাঁকে প্রণাম জানিয়ে ফিরে চললাম। আমাদের কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অবিনদাদার বয়সী একজনকে আসতে দেখলাম। তারপরে অবিনদা তাকে বাইকে বসিয়ে আমাদের সামনে দিয়ে কৃত্রিম পাহাড়ি ঝর্ণার পাশ দিয়ে দ্রুতবেগে চলে গেল। আমরা তিনজনে হাঁটতে লাগলাম বাবাইদাদা যেখানে বসেন, দর্শন দেন সেদিকের উদ্দেশ্যে কারণ ঐখানে আমার স্ত্রী গেছে খোঁজ নিতে। একটু এগোতেই সামনে দিয়ে আমার স্ত্রীকে আসতে দেখলাম। সামনে আসতেই সে বললো, ‘না, বাবাইদাদা আজ বসেননি, আগামী কয়েকদিন বসবেন না।‘ আবার একটা জোর চমকের ধাক্কা খেলাম! মনে মনে ভাবলাম, ‘ঠাকুর তুমি এত, এত দয়াময়!!!!!!” ছেলেমেয়ে তাদের মাকে অবিনদাদার সঙ্গে দেখা ও কথা হওয়ার ঘটনাটা বলবার জন্য হামলে পড়লো। আর আমার মনের মধ্যে পথ চলতে চলতে জেগে উঠলো অনেক প্রশ্ন! ‘এমনও হয়?
কে তুমি!? কে তুমি!?
ক্রমশঃ
প্রকাশ
বিশ্বাস।
No comments:
Post a Comment