প্রণাম জানাই তোমার
শ্রীচরণে।
আজ ৫ই জানুয়ারি শুক্রবার
তোমার জন্মদিন। আজকের এই পবিত্র দিনে তোমার মহিমার কথা না স্মরণ ক'রে পারলাম না। মনে
পড়ে যায় একটা গানের কলিঃ "আর তো তোমায় রাখতে নারি এমন সঙ্গোপনে চতুর্দিকে গন্ডি
কেটে আঁধার ঘরের কোণে।" সেদিনটার কথা মনে পড়ে। গত ২০১৬ সালের জুলাই মাসের শেষের
দিকের ঘটনা। প্রতিবারের মত সেদিনও গেছিলাম পরিবারের সবাইকে নিয়ে পূজনীয় বাবাইদাদার
শ্রীচরণে সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে। ঠাকুরবাড়ি গিয়ে জানতে পারলাম বাবাইদাদা প্রতিদিনের
মত প্রাতঃকালীন প্রার্থনা শেষে তাঁর নির্দিষ্ট স্থানে দর্শন দিচ্ছেন না শারীরিক কারণে।
একটু হতাশ হ'য়ে পড়লাম। দু'দিনের জন্য ঠাকুরবাড়ি যাওয়া। ছেলে ও মেয়ের চাকুরী সংক্রান্ত
সিদ্ধান্ত গ্রহণের মত কঠিন বিষয় ছিল বাবাইদাদার দর্শন, মতামত, অনুমতি ও আশীর্বাদ পাওয়ার
প্রধান উদ্দেশ্য। কারণ চাকরী জীবনের প্রথম থেকেই ছেলে ও মেয়ের উভয়ের চাকরী সংক্রান্ত
যাবতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ ও বর্জন পূজনীয় বাবাইদাদার নির্দেশ মতই হ'য়ে এসেছে। এবারের ঠাকুরবাড়িতে
শ্রীশ্রীঠাকুর,শ্রীশ্রীবড়মা, শ্রীশ্রীবড়দা, আচার্যদেব শ্রীশ্রীদাদা ও শ্রীশ্রীবাবাইদাদা
দর্শন, প্রণাম ও আশীর্বাদ গ্রহণের উদ্দেশ্য ছিল ছেলেমেয়ের চাকুরীর সমস্যা সমাধান ও
ভদ্রকালী সৎসঙ্গ কেন্দ্র সংক্রান্ত আলোচনার বিষয়।
যাই হ'ক, প্রথমদিন সকালে জানতে পারলাম বাবাইদাদার দর্শন সংক্রান্ত কার্যক্রম বন্ধ আছে তখন মনটা খারাপ হ'লেও পরেরদিনের অপেক্ষায় আশায় বুক বেঁধে রইলাম যদি দর্শন হয় আর মনে মনে ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা জানালাম আমার ছেলেমেয়ের অসহায় অবস্থার কথা। একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে যদি না যেতে পারি তাহ'লে ফিরে গিয়ে ছেলেমেয়ে কি করবে সেই কথা ভেবে চিন্তিত হ'য়ে পড়লাম আর আমার চেয়েও বেশী চিন্তাগ্রস্থ হ'য়ে পড়লো ছেলেমেয়ে। আমি মনে মনে ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করলাম ঠাকুর একটা উপায় ক'রো অন্তত অবিনদাদার দর্শন পাইয়ে দাও। প্রসঙ্গান্তরে ব'লে রাখি এইবার যখন ঠাকুরবাড়ি আসবো ব'লে ঠিক করেছিলাম তখন মনে ইচ্ছা হয়েছিল একবার যদি এবার অবিনদাদার দর্শন পেতাম ও কথা বলতে পারতাম; সেইমত ঠাকুরের কাছে প্রার্থনাও জানিয়েছিলাম। তাই এবার যখন জানতে পারলাম শারীরিক কারণে বাবাইদাদার দর্শন ও প্রণাম বন্ধ তখন প্রথমদিন কেটে যাবার পর দ্বিতীয় দিনের অপেক্ষায় বসে রইলাম। সময় আর কাটতে চায় না। মেঘলা আকাশ। মাঝে মাঝে ঝিরঝির ক'রে বৃষ্টি হচ্ছে। তবে তেমন কোনও অসুবিধা হচ্ছে না। সারাদিন প্রার্থনা, ঠাকুর, বড়মা, বড়দা প্রণাম, আচার্য সান্নিধ্য, ফিলান্থ্রফি অফিসের কাজ, সকালের জল খাবার, দুপুরের প্রসাদ গ্রহণ, সান্ধ্য প্রার্থনা, মায়ের প্রণাম, সন্ধ্যাবেলায় চপ ও মুড়ি খাওয়া এবং রাতের প্রসাদ গ্রহণ ইত্যাদি পর্ব সারার মধ্যে দিয়ে প্রথমদিন শেষ হ'লো। রাতে চোখে ঘুম এলো না। সারা রাত শুয়ে শুয়ে ভাবলাম কালকের দিন শেষ হ'লেই পরশু সকালে গাড়ি ধরতে হবে বাড়ি ফিরে যাবার জন্য। তাহ'লে কি খালি হাতে ফিরে যেতে হবে!? ছেলে মেয়ে একবার জিজ্ঞেস করলো, 'বাবা, তাহ'লে কি করবো? কাল তো বাবাইদাদা দর্শন দেবেন না।' আমি কোনও উত্তর দিতে পারলাম না। বাস্তবিক আমার কাছে কোনও উত্তর ছিল না। আমি বললাম, 'শুয়ে শুয়ে ঠাকুরের নাম কর। ঠাকুরকে বল। আর বাবাইদাদার কথা স্মরণ ক'রে বাবাইদাদাকে যা সামনে দেখা হ'লে বলতি তাই মনে মনে বাবাইদাদাকে নিবেদন কর। তারপরে নাম করতে করতে শুয়ে পড়।" ছেলেমেয়ে কি করলো বুঝলাম না। স্ত্রী মনমরা হ'য়ে বসে আছে। আমি বললাম, 'শুয়ে পড়ো, কাল যা হবার হবে।'
তারপরে সবাই শুয়ে পড়লো। আমি ঠাকুরের নাম করতে করতে শুয়ে রইলাম। কিন্তু ঘুম আসছিল না। মাঝ রাতে বৃষ্টি এলো। বেশ জোরে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির খরশাণ ধারা রাতের নিস্তব্ধতাকে আরও রহস্যময় ক'রে তুলছে। বিছানা থেকে উঠে বাইরে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। বৃষ্টির ঝমঝম শব্দে নিস্তব্ধ বারান্দায় শরীরে রোমাঞ্চ জাগে। বাইরে রাস্তার দিকে তাকালাম। আলো ঝলমলে ফাঁকা রাস্তা দিয়ে দ্রুতগতিতে চলে যাচ্ছে রাতের ভারী ট্রাক রাস্তা কামড়ে। ঠাকুরবাড়ি থেকে ভেসে এলো মধুর শব্দে ঘড়িতে দুটো বাজার সংকেত। ঢং ঢং ক'রে বেজে উঠলো ঘড়ি। বৃষ্টি ভেদ করে ছুটে চলা গাড়ির আওয়াজ মাঝে মাঝে রাতের নিস্তব্ধতাকে ভেঙে খানখান করে দিচ্ছে। হেড লাইটের তীব্র আলোয় বৃষ্টি ধারার তীব্রতা বোঝা যায়। দূরের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একবার আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকালাম। বললাম, ঠাকুর জানি না কাল কি হবে। এমন বৃষ্টি যদি চলতে থাকে তাহ'লে আর সকালে প্রার্থনার উদ্দেশ্যে বেরোনো যাবে না আর কোনও সুযোগও পাবো না হয়তো কাউকে দর্শন করার। তুমি দয়া ক'রো। বৃষ্টি যেন থেমে যায় ভোরে। তারপরে ধীরে ধীরে ঘরে ফিরে এলাম। আবার বিছানায় শুয়ে পড়লাম। বৃষ্টির মিষ্টি মধুর নেশাধরা শব্দ যেন ঘুম পাড়ানিয়া গান হ'য়ে চোখের তারায় নেমে এলো। কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না। ঘুম ভাঙল' এল্যার্মের শব্দে। চোখ মেলে চেয়ে দেখলাম ঘড়িতে তখন সাড়ে তিনটে। একে একে সবাই উঠে পড়লাম তৈরি হবো ব'লে।
ক্রমশঃ
No comments:
Post a Comment