পূর্ব প্রকাশের পর।
প্রণাম জানাই শ্রীচরণে
তোমার।
ঘড়িতে তখন ভোর সাড়ে চারটে। কিন্তু তখনও অন্ধকার। মেঘলা আকাশ। ঝিরঝির ক'রে বৃষ্টি পড়েই চলেছে। সেন্টিনারির দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে চেয়ে আছি বাইরের দিকে। মনের ভিতরটা বড় অস্থির হ'য়ে রয়েছে। হালকা বাতাস বইছে। চোখে মুখে এসে বাতাস তার ঠান্ডা হাত বুলিয়ে যেন শুষে নিচ্ছে দুশ্চিন্তাযুক্ত ক্লান্তির মেঘ! মনে হ'ল যেন আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম ঐ বৃষ্টিঝরা আলোআঁধারি ভোরের আকাশে প্রভু যেন বাতাস হ'য়ে এসে কানে কানে ব'লে গেলো, 'চিন্তা কিস বাত কি? হাম হ্যাঁয় না!' আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত চেয়েছিলাম রাস্তা ও আশপাশের গাছগাছালি, বাড়িঘর ও আকাশের দিকে। কখন যে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে ছেলেমেয়ে বুঝতে পারিনি। ওদের ডাকে সম্বিত ফিরে পেলাম। 'বাবা! কি হবে!? বৃষ্টি যে প'ড়েই চলেছে।' উৎকণ্ঠা গলায় জড়িয়ে কথা বললো মেয়ে। আমি চেয়ে দেখলাম মেয়ে আমার খুবই চিন্তিত। কারণ আজ যদি সকালে বেরোতে না পারি তাহ'লে কাল বাড়ি ফিরে যাবার দিন। খালি হাতে ফিরে যেতে হবে এবার ঠাকুরবাড়ি থেকে! ছেলে বললো, 'বাবা প্রার্থনার সময় হ'য়ে গেছে আর বাইরেও ঝিরঝির ক'রে বৃষ্টি পড়ছে, আজকে আর যাওয়া যাবে না। ঘরে চলো।' আমি ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে সম্মতি জানিয়ে ঘরে প্রবেশ ক'রে বিছানার উপর বসে পড়লাম। আর তার কিছুক্ষণ পরেই ভেসে এলো ঠাকুরবাড়ির সমবেত প্রার্থনা। সত্যি বলতে কোনও লজ্জা নেই, প্রার্থনায় মন বসছিল না; শুধু মনে মনে বলছিলাম, 'ঠাকুর! বৃষ্টি থামিয়ে দাও। প্রার্থনার শেষে যেন মন্দিরে যেতে পারি।' একসময় প্রার্থনা শেষ হ'লে আমরা বাইরে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। দেখলাম বৃষ্টি থেমে গেছে কিন্তু আকাশ বাদল মেঘে ঢেকে আছে। আমরা সবাই ঘরে তালা দিয়ে মন্দিরে যাবার জন্য বেরিয়ে পড়লাম।
রাস্তায় বেরিয়ে দেখলাম
এই ভোরের বৃষ্টিভেজা রাস্তায় লোক সমাগম কম। আমরা আশ্রমের গেট পেরিয়ে সোজা হেঁটে চললাম।
কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি, কার কাছে যাচ্ছি কিছুই জানা নেই কারণ বাবাইদাদা তো আজ দর্শন
দেবে না। মন্ত্রমুগ্ধের মত এক অমোঘ টানে আমরা তিনজনে এগিয়ে চলেছি। স্ত্রী সঙ্গে নেই।
সে অনেক আগেই প্রার্থনা শেষ হতেই বেরিয়ে পড়েছে বাবাইদাদা বসবেন কিনা তা জানবার জন্যে।
আশা, যদি বসেন। মেমোরিয়ার পাশ দিয়ে যাবার সময় ছেলে বললো, 'বাবা কাল একটা স্বপ্ন দেখলাম।'
সঙ্গে সঙ্গে মেয়েও বিস্ময়ে ব'লে উঠলো, 'তুই দেখেছিস! আমিও স্বপ্ন দেখেছি! তুই আগে বল,
তারপরে আমি বলবো।' ছেলে ব'লে চললো তার স্বপ্নের কাহিনী। প্রথমে আমি তার স্বপ্নে দেখা
গল্পে মন দিতে পারছিলাম না। মন পড়ে রয়েছিল অন্য এক জায়গায়; শুধু মন বলছিল, 'ঠাকুর!
কি হবে! কি করবো ঠাকুর!' হঠাৎ মনটা আটকে গেল এক জায়গায়। ছেলে আমাকে মেমোরিয়ার পাশ দিয়ে
যেতে যেতে বলছে, 'বাবা! এই জায়গায়! এই জায়গায়!' মুখ ঘুরিয়ে বললাম, 'কি এই জায়গায়? ছেলে
বললো, 'এই যে এতক্ষণ বললাম, তুমি শোনোনি?' আমি একটু লজ্জিত হ'য়ে বললাম, 'না, মানে ইয়ে.........।'
ছেলে বললো, 'ও বুঝেছি।' আমি বললাম, 'বল না কি বলছিলি। আমি একটু অন্যমনস্ক হ'য়ে গেছিলাম।
তাই......, এই জায়গায় কি হয়েছে? ছেলে বললো, কাল রাতে স্বপ্ন দেখলাম, ঠিক এই মেমোরিয়ার
পাশ দিয়ে আমি বাবাইদাদার সঙ্গে হেঁটে যাচ্ছি। বাবাইদাদা আমাকে খুব বকছে। জোরে ধমক দিয়ে
বলছে, 'কোথাও যেতে হবে না। এখন যেখানে আছো সেখানেই থাকো। চুপ ক'রে মুখ বুঝে সেখানেই
কাজ করো মন দিয়ে। কেন এখানে কি ভালো লাগছে না? এখানে কি হয়েছে? এখন কোথাও চেঞ্জ করার
দরকার নেই।'
আমি এই কথা শুনে বিস্ময়ে
হতবাক হ'য়ে গেলাম। ছেলে কি বলছে! উৎসাহে, আনন্দে, বিস্ময়ে আমি আবার শুনতে চাইলাম স্বপ্নের
বিষয়। ছেলে আবার বললো স্বপ্নে দেখা ঘটনা। বললো, আমি বারবার নানাভাবে কোম্পানি চেঞ্জ
করার মনোভাব প্রকাশ করায় বাবাইদাদা রেগে গেলেন। আমি চুপ ক'রে গেলাম। তারপর পিঠে তাঁর
হাত রেখে হাঁটতে হাঁটতে খুব নিচুস্বরে মিষ্টি ক'রে বললেন, 'এখানেই থাক, কোথাও এখন যাবার
দরকার নেই; যা হবার এখানেই হবে, ভালো হবে।' বাবাইদাদার কোমল হাতের স্পর্শে শরীরে শিহরণ
খেলে গেল। মনে হ'ল হাজার ভোল্টের বিদ্যুৎ যেন বইয়ে গেল শরীরের শিরায় শিরায় এক লহমায়।
চমকে মুখ তুলে তাকালাম বাবাইদাদার মুখের দিকে। দেখলাম স্মিথহাস্যে তিনি আমার দিকে তাকিয়ে
আছেন আর হাসিতে ঝরে পড়ছে হাজার চাঁদের আলোর ঝর্ণা! আর তখনই ঘুমটা ভেঙে গেল। এক নিশ্বাসে
কথাগুলি ব'লে থামলো ছেলে আমার। আমি অবাক হ'য়ে শুনছিলাম কথাগুলি। মনে মনে ভাবলাম একেই
কি বলে, Divine dictation!? তারপর আর কিছু ভাবতে পারলাম না। মনে মনে খুব খুশী হ'লাম।
যাক ঠাকুর মুখ তুলে অন্তত চেয়েছে। আজ আর কিছু হ'ক আর না হ'ক, বাবাইদাদার দর্শন পাই
আর নাই পাই, চাকরীর ব্যাপারে ছেলে আমার সিদ্ধান্ত পেয়ে গেছে। সিদ্ধান্ত হীনতায় আর আমার
ছেলেকে ভুগতে হবে না বা ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার হাত থেকে ছেলে আমার বেঁচে গেল। ঠাকুর
আমার প্রার্থনা শুনেছেন। চলতে চলতে দু'হাত জোর ক'রে তাঁর উদ্দেশ্যে প্রণাম জানালাম।
আর তখনই কানের পাশ দিয়ে বইয়ে যাওয়া ঠান্ডা বাতাসে ভর ক'রে কে যেন ব'লে গেলো, 'যার জীবনে
যত ভুল কম, তার জীবনে তত সুখ বেশী।'
আমরা তখন ঠাকুর, বড়মা,
বড়দা প্রণাম ক'রে চিড়িয়াখানার পাশ দিয়ে হেঁটে চলেছি বাবাইদাদা যেখানে দর্শন দেন সেখানের
উদ্দেশ্যে যদি হঠাৎ দর্শন দেন এই আশায়। তখন যেতে যেতে মেয়েকে বললাম, 'তুই কি স্বপ্ন
দেখেছিস?' মনের মধ্যে লাড্ডূ ফুটে চলেছে অনবরত যদি এমন কিছু মেয়ের বেলায় হয় এই লোভে।
মেয়ে তার ভাইয়ের কথা শুনে আনন্দে চেঁচিয়ে উঠে বললো,'বাবা! আমাকেও বাবাইদাদা বলেছে,
কিন্তু আমাকে বকেনি।' 'কি বলেছে বল, বল!' আমার আর ধৈর্য ধরলো না। আমি মেয়েকে ব'লে উঠলাম।
মেয়ে আনন্দে যা বললো তা'তে মাথা ঘুরে গেল। বাবাইদাদা দুজনকেই তাদের সমস্যার সমাধান
দিয়ে দিয়েছেন। যদি বিশ্বাস করি তাহ'লে যে সমাধান তিনি সামনে উপস্থিত থেকে দিতেন সেই
সমাধান তিনি দিয়েছেন স্বপ্নে! এর থেকে আর কি বড় আশীর্বাদ হ'তে পারে আমাদের জীবনে বাস্তবে!
মেয়ে বলতে লাগলো, 'আমি বাবাইদাদাকে নতুন কাজের জায়গায় জয়েন করার অফার গ্রহণ করবো কিনা
জিজ্ঞেস করলাম। বাবাইদাদা ঐ নতুন কোম্পানী সম্পর্কে জানতে চাইলেন বিস্তারিত। আমি 'ইউনাইটেড
ওয়ার্ল্ড' সম্পর্কে, কাজের সম্পর্কে সব বললাম। সব শুনে তিনি সম্মতি দিলেন ইউনাইটেড
ওয়ার্ল্ড'-এ জয়েন করতে।'
আমি চুপ ক'রে শুনছিলাম
কথাগুলি। আমরা কথা বলতে বলতে চিড়িয়াখানার পাশ দিয়ে হেঁটে চলেছি। একটা ঘোরের মধ্যে দিয়ে
যেন চলেছি আমি। এও কি সম্ভব! এইভাবেও কি সমাধান পাওয়া যায়! চারপাশে ঠান্ডা একটা বাতাস
ব'য়ে যাচ্ছে। ঠান্ডা বাতাস মন প্রাণ দেহ সব জুড়িয়ে দিচ্ছে। ভোরের আলো তখনও মেঘলা আকাশের
জন্য ফুটে উঠতে পারছে না। একটা হালকা অন্ধকারের চাদর যেন গোটা আশ্রমটাকে ঘিরে রেখেছে।
চারপাশের গাছগাছালি ঘিরে আলোআঁধারি ঠান্ডা নিস্তব্ধ পরিবেশ যেন রুপকথার রাজ্যে নিয়ে
এসেছে আমাদের। মনে হচ্ছে আমি যেন স্বর্গের বুকে হেঁটে বেড়াচ্ছি। আমি হাটছি না, আমায়
যেন কেউ টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এই ঘোর লাগা অবস্থাটা যেন চেপে বসছে ক্রমশঃ। আমার এইরকম
চলা দেখে ছেলে বললো, 'বাবা, তোমার শরীর খারাপ লাগছে?' আমি থতমত খেয়ে ব'লে উঠলাম, 'না,
না।' ঠিক সেই সময় হঠাৎ পাশ দিয়ে একটা এনফিল্ড বাইক হুশ ক'রে বেরিয়ে গেল। মেয়ে সেদিকে
তাকিয়ে বলে উঠলো, 'বাবা! বাবা! অবিনদাদা গেল, অবিনদাদা গেল।' আমি কথাটা শুনে থতমত খেয়ে
গেলাম। বলে উঠলাম, 'কোথায়!? কোথায়!? দেখলাম, বাইকটা আমাদের যাওয়ার পথের উল্টো দিকের
সামনের গোশালার পাশ দিয়ে ফোয়ারার দিক দিয়ে এসে আমাদের পাশ দিয়ে গিয়ে চলে গেল। তারপর
রাস্তার বাঁ পাশের ভিতরের ফাঁকা জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালো। আমি বললাম, 'ঠিক দেখেছিস তো?'
ছেলে তার উত্তরে সম্মতি জানিয়ে বললো, 'হ্যাঁ বাবা, অবিনদাদাই গেলো।' মুখ ঘুরিয়ে দেখলাম
রাস্তার ভিতরের ঐ ফাঁকা জায়গায় গাছের নীচে বাইকটা দাঁড় করিয়ে বাইকে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে
আছে অবিনদাদা; মনে হ'লো কারও জন্য অপেক্ষা করছে। আমি তখন দ্বিধাগ্রস্থ। অবিনদাদার কাছে
যাবো কি যাবো না, কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। মনে মনে ভাবলাম, ঠাকুর তুমি এত দয়াময়!
তুমি কি আমার প্রার্থনা শুনেছো! বাড়ি থেকে আসার সময় এবং এখানে এসে গতকাল বাবাইদাদার
শরীরের কারণে দর্শন না দেওয়ার কথা জানতে পেরে যা ভেবেছিলাম, ঠাকুরের কাছে যা প্রার্থনা
করেছিলাম এইটা কি তারই ইঙ্গিত!!!!! মনে মনে ভাবছি, যাবো, কাছে যাবো? এই ভোরের আলোআঁধারির
চাদরে ঢেকে থাকা মেঘলা আকাশের নির্জন ফাঁকা জায়গায় অবিনদাদা দাঁড়িয়ে আছেন একেলা, কাছে
পিঠে কেউ নেই, রাস্তা দিয়েও কেউ যাচ্ছে না। আমি অবাক হ'য়ে স্থির দাঁড়িয়ে রইলাম অবিনদাদার
দিকে চেয়ে। মনে মনে একটা লজ্জাও লাগছিল; কি জানি তিনি কি মনে করছেন। একটা রহস্যময় পরিবেশ
যেন মুহূর্তে তৈরী হ'য়ে গেলো। মনের মধ্যে তোলপাড় হ'তে লাগলো, এত ভোরে কেন তিনি এখানে,
কেন তিনি!? 'এখন কি করবো' এইকথা ছেলেমেয়েদের বলাতে তারাও বুঝে উঠতে পারছিল না কি করবে,
কি বলবে। দেখলাম, অবিনদাদা স্থির দাঁড়িয়ে আছে ঐ গাছের আলোআঁধারি ছায়ায়। একবার দেখলাম,
মুখ ঘুরিয়ে যেন আমাদের দিকে তাকালো। আমি আর কোনওকিছু না ভেবেই অনেকটা নেশাগ্রস্থের
মত ছেলেমেয়েদের নিয়ে হেঁটে চললাম অবিনদাদার দিকে। যা হবে হ'ক। ঠাকুরের এইটাই ইচ্ছা।
'তাঁর ইচ্ছাই আমার ইচ্ছা' এইভেবে এগিয়ে গেলাম ছেলেমেয়েদের নিয়ে; কাছে গিয়ে আভূমি প্রণাম
করলাম। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, ' এরা আমার ছেলেমেয়ে। বাবাইদাদার কাছে এসেছিলাম ছেলেমেয়ের
চাকুরী সংক্রান্ত বিষয়ে কি করবে সেই সম্পর্কে আশীর্বাদ নিতে। কিন্তু এসে শুনলাম বাবাইদাদা
শরীরের কারণে দর্শন দিচ্ছেন না। তাই কি করবো বুঝতে পারছি না। ছেলেমেয়ে খুব হতাশ হ'য়ে
পড়েছে, খুব চিন্তাগ্রস্থ, তাই আপনার কাছে এলাম।' অবিনদাদা বললেন, 'হ্যাঁ, বাবার শরীরটা
একটু খারাপ, তাই ক' দিন দর্শন দেবেন না।' তারপর খুব মিষ্টি ক'রে ছেলেমেয়ের দিকে তাকিয়ে
মিষ্টি হেসে বললেন, 'কি হয়েছে?'
অবিনদাদার মুখের হাসির
দিকে চেয়ে মনে হ'ল, এই আলোআঁধারি মাঝে হাজার সুর্যের জ্যোতিঃ যেন ঝরে পড়ছে। মুহূর্তে
যেন অন্ধকার কেটে আলোয় ঝলমল ক'রে উঠলো চারপাশ!!!!!!
ক্রমশঃ
প্রকাশ বিশ্বাস।
ক্রমশঃ
প্রকাশ বিশ্বাস।
No comments:
Post a Comment