আজ টিভিতে হঠাৎ চোখ পড়ল। দেখলাম সিরিয়ালের সেরা ভিলেনের রোলের বিজ্ঞাপন চলছে। এক একটা সিরিয়ালের এক একজন তাদের সেরা ডায়লগ বলে যাচ্ছে। একটা সিরিয়ালের একজন ভিলেনের একটা ডায়লগ শুনলাম; বলছে, ‘ভাত ছেটালে কাকের অভাব হয় না।‘ কথাটা মুহূর্তের মধ্যে প্রায় ৩০-৩৫ বছর পিছনে নিয়ে গেল। একটু নস্টালজিক হ’য়ে পড়লাম। তখন ভরা যৌবন। মাথা ভর্তি লম্বা চুল, মুখে চাপ দাঁড়ি, হাতে মোটা ষ্টীলের বালা, লোহা পেটানো চেহারা। ব্যায়াম, ক্যারাটে-কুম্ফু, ক্রিকেট, নাটক, গান, লেখালেখি, রাজনীতি, বক্তৃতা ইত্যাদি সবেতেই ফুলে ফুলে প্রজাপতির উড়ে উড়ে মধু খাওয়ার মতন যৌবনের পাগলা ঘোড়ায় চেপে ছুটে বেড়াচ্ছি এ মাথা থেকে ও মাথা, এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত, এ মেরু থেকে ও মেরু, এ কূল থেকে ও কূল, এ ঘাট থেকে ও ঘাট, এ জীবন থেকে ও জীবন। সর্বঘটে কাঁটালি কলা হ’য়ে বহাল তবিয়তে বিরাজ করছি। এর সঙ্গে রয়েছে চাকরী জীবন। হু হু ক’রে কেটে যাচ্ছে সময়। এত ব্যস্ত যে শয়তান তার কারখানা বানাতে সুযোগই পায়নি এই মস্তকে। তাই একটাই কি দুঃখ রয়ে গেল? প্রেমহীন যৌবন উদ্দাম গতিতে ছুটে গেল বিনা বাধায়, বিনা দ্বিধায়! কিন্তু কিসের টানে? কেন এই উপেক্ষা? কেন উপেক্ষার জবাবে উপেক্ষা না হ’য়ে গালির গালিচা! উত্তর কি এখন? জানি না, জানার চেষ্টাও করিনি কোনোদিন। তবে ঐ ৩০-৩৫ বছর পিছনের ঘটনাটা বলতে পারি। একদিন অফিস ছুটির দিন শীতকালের সকাল। সময় সকাল ১০টা সাড়ে দশটা হবে। বন্ধু-বান্ধব অনেকে মিলে বসে আছি। সামনে সম্ভবত ক্লাবের কোনো অনুষ্ঠান আছে। তারই প্রস্তুতি চলছে। এলাকার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা ক্লাবের প্রধান শক্তি এলেন। ছোটবড় সবাই তাঁকে ঘিরে বসে আছে। তিনি বলছেন আমরা সবাই শুনছি। সবাই হ্যাঁ হ্যাঁ ক’রে যাচ্ছে। এদের মুশকিল হ’ল এরা দাদা যা বলেন সবেতেই হ্যাঁ হ্যাঁ ক’রে যান। সূর্য পশ্চিমে উঠে পূবে অস্ত যায় বললেও সবাই হ্যাঁ হ্যাঁ ক’রে ওঠে। যাই হ’ক কথার পর কথা এগিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ তিনি রেগে গিয়ে বিরক্তির সুরে বললেন, ‘ ভাত ছেটালে কাকের অভাব হয় না, বুঝলি।‘ আসরে যেন বজ্রপাত হ’ল। সবাই চুপ ক’রে আছে। আমি ঘুরে ঘুরে সবার মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি। দেখছি সবার মুখে যেন মুহুর্মুহু রঙ পাল্টাচ্ছে। কেউ মাথা নিচু ক’রে বসে আছে তো কেউ কেউ অন্যের মাথার পিছনে নিজের মুখ লুকাতে ব্যস্ত হ’য়ে পড়েছে। ‘কি হ’ল চুপ ক’রে আছিস কেন? কি, ভুল বললাম? ভাত ছেটালে কাকের অভাব হয়?’ সামনে বসে থাকা কয়েকজনের দিকে তাকিয়ে আবার কথাটা ছুঁড়ে দিলেন তিনি। আমি আমার মত চুপ ক’রে বসে আছি। তিনি জানেন আমি বিভিন্ন কাজে জড়িয়ে থাকি আর সময় পেলেই আসি। তাই আমাকে একটু প্রশ্রয়ের চোখেই দেখতেন তিনি। তবে সবার সামনে আমাকে যতটা না মান্যতা দিতেন তার থেকে হাজার গুণ বেশী মান্যতা দিতেন যখন দুইজনে একা থাকতাম। যাই হ’ক হঠাৎ তিনি আমাকে উদ্দেশ্য ক’রে বললেন, ‘কিরে তুই চুপ ক’রে আছিস কেন? তুই তো কিছু বল?’ আমি আমতা আমতা ক’রে বললাম, ‘ন-ন-না, আমি কি বলবো?’ তিনি বললেন, ‘কেন? তুই তো পড়াশুনা করা ভালো ছেলে! তুই তো কিছু বল!’ আমি তখন কিছুটা ভয়ে, কিছুটা প্রশ্রয়ে বললাম, ‘না, মানে আপনি কথাটা ঠিক বলেছেন। ভাত ছেটালে কাকের অভাব হয় না। তু নেহি তো আউড় সহি। তবে কি জানেন, কাকেদের চরিত্রটা অদ্ভুত! ভাত ছেটাবার সঙ্গে সঙ্গে তারা একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে একথা যেমন ঠিক, সত্য তার চেয়েও ভয়ঙ্কর ঠিক ও সত্যি হ’ল ভাত খাওয়া শেষ হ’লেই কাকেরা দলবেঁধে উড়ে যায়। আর, দাদা, উড়ে যায় যায়, যাবার বেলায় আরও কর্কষ স্বরে ‘কা কা’ রবে উড়ে যায়।‘ আমার বলা শেষ হ’তেই কিছুক্ষণের জন্য ‘পিন অফ সাইলেন্ট’ হ’য়ে গেল পরিবেশ। তারপরই হঠাৎ দুম ক’রে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। পা দিয়ে সজোরে লাথি মেরে পিছন দিকে ঠেলে ফেলে দিলেন চেয়ারটা। টেবিলটাকে সামনের দিকে ঠেলে দিয়ে গটগট ক’রে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন এলাকার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা আমাদের এলাকার সবার প্রিয় দাদা। আমরা সবাই তখনও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হ’য়ে চুপ ক’রে বসে আছি। সবাই সবার মুখের দিকে তাকাচ্ছে। তারপর দেখলাম সবাই যেন আমার দিকে তাকিয়ে আছে একবুক রাগ আর বিরক্তি নিয়ে। যদিও কেউ কিছু বলতে সাহস করেনি, তবুও আমার মনে হ’ল আমি এই অবস্থার জন্য দায়ী। যাই হ’ক আমি আর কালবিলম্ব না ক’রে একা ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। বেরিয়ে সোজা চলে এলাম বাড়িতে। সেদিন সারাদিন ভেবেছিলাম কথাটা। হঠাৎ কি যে বললাম! কেন যে বললাম! যাই হ’ক আজ অনেক বছর পর টিভির পর্দায় ভেসে ওঠা দৃশ্যটা আমাকে নিয়ে গেল সেই ফেলে আসা দিনগুলিতে। দাদার ‘ভাত ছেটালে কাকের অভাব হয় না’ কথাটা সিরিয়ালের দাদার ডায়লগ হ’য়ে ফিরে এল এতবছর পরে। মনে হ’ল পৃথিবীটা সত্যিই গোল! তবে অনেকদিন পর রাস্তায় দাদার সঙ্গে একদিন দেখা হয়েছিল নিভৃতে। আজও মনে পড়ে সেদিনটার কথা। রাস্তায় আসতে আসতে কাঁধে হাত রেখে খুব বিষন্ন স্বরে বলেছিল, ‘কে জানে ক’ ঘন্টা, রবে রে জীবনটা’; তোর সেদিনের কথাগুলি অপ্রিয় হ’লেও বড় সত্যি। বাস্তব বড় নির্মম, রুঢ়, কঠিন! জীবনকে চেনাতে সাহায্য করার জন্য ধন্যবাদ।‘
আজ তাঁর কথাগুলি মনে পড়ে গেল। আজ আর তিনি নেই আমাদের মাঝে। কিন্তু কথা গুলি ফিরে ফিরে আসে বারে বারে!!!!!!
No comments:
Post a Comment