'তেলেপ্পো
ঝাঁই'!!!!!!!!!!!!!
পাপড়ি
দাসের লেখাটা
পড়ে খুব
ভালো লাগলো।
মনে পড়ে
গেলো অনেক
কিছু। কলকাত্তাইয়া
চট্টগ্রামের ভাষা
এখনও কিছু
কিছু বুঝি
এত বছর
পড়েও। ছোটবেলায়
মা-বাবা-জ্যাঠা-মামা-আত্মীয়স্বজনের
প্রচুর ভিড়
লেগে থাকতো।
চট্টগ্রাম ভাষার
কাকলিতে মুখর
হ'য়ে থাকতো
ঘর। আমরা
ভাইবোনেরা শুধু
নিজেদের মধ্যে
কলকাত্তইয়া বাংলা
ভাষায় কথা
বলতাম। কিছু
কিছু চট্টগ্রামের
ভাষাও বলতাম
আমরা। তবে
খুবই সামান্য।
আমাদের মধ্যে
আমার ছোড়দা
ভালো কলকাত্তাইয়া
চট্টগ্রামের ভাষায়
কথা বলতে
পারতো। আমাদের
সবার জন্ম
কলকাতায়। বাবা-মা-আত্মীয়স্বজনের
মুখে মুখে
শুনে শুনে
শেখা কিন্তু
ভাঙ্গা ভাঙ্গা।
কলকাত্তাইয়া চট্টগ্রামের
ভাষা বললাম
এইজন্য, খাস চট্টগ্রামের
ভাষার সঙ্গে
বহুদিন কলকাতার
বুকে থাকা
চট্টগ্রামীদের ভাষার
তফাৎ পরিলক্ষিত
হয়। সময়ের
সঙ্গে সঙ্গে
ভাষার জটিলতা
সরলতায় পর্যবসিত
হয়। খাস
চট্টগ্রামের ভাষা
বোঝা কোনও
কোনও জায়গায়
কঠিন। আজ
থেকে বহুদিন
আগে প্রায়
৪০-৪৫বছর
আগের একটা
মজার ঘটনা
মনে পড়ে
গেল। স্বাধীনোত্তর
দেশভাগের সময়
পূর্ববাংলা থেকে
পশ্চিমবাংলায় চলে
আসে বাবা-মা।
তারপর অনেক
কষ্টে এ
বাংলায় হুগলী
জেলার উত্তরপাড়ায়
জমি কিনে
বাড়ি তৈরী
ক’রে বসবাস
শুরু করেন।
তখন লোকবসতি
প্রায় ছিল
না বললেই
চলে। যাই
হ’ক আমাদের
যেখানে বাড়ি
তার আশেপাশে
কয়েক ঘর
সবাই আত্মীয়স্বজনের
মধ্যেই পড়ে।
সবাই চট্টগ্রামের
মানুষ। সকাল
থেকে রাত
পর্যন্ত চাঁটগাঁইয়া
ভাষায় কথা
বলতে শুনতাম।
বাবা-মা
নিজেদের মধ্যে
ঐ ভাষায়
কথা বলতো।
আর আমাদের
সঙ্গে কলকাত্তাইয়া
বাংলা ভাষায়
কথা বলতো।
একদিন আমাদের
পাশের বাড়িতে
খুব চেঁচামেচি
হচ্ছে শুনলাম।
বাড়ির গৃহকর্তা
আমাদের সম্পর্কে
দাদু হতেন।
তিনি বাড়িতে
ছেলেদের উপরে
বকাবকি করছেন।
বকাবকি করছেন
খাস চাঁটগাঁইয়া
ভাষায়। আমাদের
বাপ-দাদাদের, মা-মাসিদের
দেখেছি ২৪ঘন্টার
প্রায় পুরো
সময়টাই চাঁটগাঁইয়া
ভাষায় কথা
বলতে। যাই
হ’ক, বাড়িতে তো
খুব চেঁচামেচি
হচ্ছে জটিল
দুর্বোধ্য চাঁটগাঁইয়া
ভাষায়। বাপ
চেঁচাচ্ছে দ্রুত
তাঁর জন্মগত
মাতৃভাষায়। আচ্ছা
কথা প্রসঙ্গে
বলি, এক্ষেত্রে মাতৃভাষা
কোনটা? বাংলা না
চট্টগ্রামের চাঁটগাঁইয়া
ভাষা? এই জায়গায়
আমার একটু
গোলমাল হ'য়ে
যায়। যাই
হ'ক বাপের
চেঁচানোর উত্তরে
ছেলেও মাঝে
মাঝে উত্তর
দিচ্ছে চট্টগ্রামের
ভাষায়। ঠিক
ওই সময়
বাড়ির পাশের
রাস্তা দিয়ে
একদল পাড়ার
ছেলে যাচ্ছে।
তারা যেতে
যেতে দাঁড়িয়ে
পড়লো বাড়ির
পাশে রাস্তায়।
এক মানুষ
উঁচু পাঁচিল
দিয়ে ঘেরা
বাড়ি। বাড়ির
ভেতর থেকে
আশ্চর্য কিছু
জটিল খটমট
শব্দ-----অনেকটা
দক্ষিণ ভারতের
ভাষার সঙ্গে
তুলনা করা
যেতে পারে--------বেরিয়ে
আসছে বাইরে।
বড় শ্রুতিমধুর, মনোরম
শব্দগুচ্ছ! পাঁচিলের
ধারে দাঁড়িয়ে
মাথা উঁচু
ক’রে পাঁচিলের
ভেতরের সেই
চীৎকার চেঁচামেচির
দৃশ্য দেখতে
ও আশ্চর্য
ভাষা শুনতে
উৎসুক জনতা।
যাই হ’ক
অবশেষে সেদিনের
মত সমাপ্ত
হয়েছিল বাপ
ছেলের বকাঝকার
নাটক। কিন্তু
যেটা এরপরে
ঘটেছিল সেটা
ছিল দারুণ
এক উপভোগ্য
বিষয়। দিন
দুয়েক পরে
রাস্তায় একদিন
মুখোমুখি হয়েছিলাম
সেই জনতার
মধ্যে কয়েকজনের।
তারা সবাই
জানে আমিও
ওই বিদঘুটে
আশ্চর্য ভাষাভাষীর
অন্তর্ভুক্ত একজন
মানুষ। তাদের
মধ্যে একজন
আমাকে জিজ্ঞেস
করলো, ‘আচ্ছা ‘তেলেপ্পো
ঝাঁই’ মানে কি? আমি
তো আকাশ
থেকে পড়লাম!
চট্টগ্রামী ভাষায়
‘তেলেপ্পো
ঝাঁই’ মানে তো
আমি জানি
না আর
কোনোদিন বাবা-মার
মুখে শুনিওনি
এত বছর
বয়স পর্যন্ত।
কি উত্তর
দেবো! যাই
হ’ক এই
নিয়ে তাদের
সঙ্গে অনেক
কথা হ’য়েছিল।
পরে এই
বিষয়ে কৌতূহলবশতঃ
পাশের বাড়ির
আমার বয়সী
বন্ধুর সঙ্গে
আলাপচারিতায় ছানবিন
ক’রে যা
জেনেছিলাম তা’তে
হাসতে হাসতে
এই ভাষার
প্রতি ভালোবাসায়
আরও গভীরভাবে
জড়িয়ে গেছিলাম।
ঘটনাটা হ’ল, সেই
সময় কেরোসিন
তেলের ব্যবহার
ছিল খুবই
গুরুত্বপূর্ণ। বাড়িতে
কেরোসিন তেল
শেষ হ’য়ে
যাওয়ায় বাপ
ছেলেদের বলেছিল
সময়মত কেরোসিন
তেল নিয়ে
আসার জন্য।
কিন্তু ছেলেরা
সময়মত সেই
কাজ না
করায় বাড়িতে
রান্নার কাজে
অসুবিধা প্রকট
হ’য়ে উঠেছিল।
তাই বাবা
রেগে অগ্নিশর্মা
হ’য়ে ছেলেদের
বকছিল। ভাষার
মাধ্যম ছিল
সেই চাঁটিগাঁই
ভাষা। ছেলেদের
বকাবকির অনেক
কথার ভিড়ে
একটা লাইন
ছিল ‘লক্ষ্মীছাড়া
মতর্গ্যা গউড়, তর
তেলের কওয়ালে
ঝাঁটা’ (ভাষাটা
যতটুকু পারলাম
লিখলাম) অর্থাৎ
‘তোর
তেলের কপালে
ঝাঁটা মারি’।
আর এই
কথাটায় বক্তার
দ্রুত বলার
ভঙ্গীতে ঘরের
ভিতর থেকে
বেরিয়ে পাঁচিলের
ওপারে গিয়েই
হ’য়ে গেছে
‘তেলেপ্পো
ঝাঁই’। সেই
থেকেই আমাদের
চট্টগ্রামের লোকেদের
দেখলেই ঐ
অচট্টগ্রামীরা বলতো, ‘তেলেপ্পো
ঝাঁই’!!!!! এই কথায়
আমরা কিছু
মনে করতাম
না। উভয়
পক্ষই হাসতাম
আর এই
আশ্চর্য ভাষার
মজা নিতাম।
আমরা
গর্ব ক’রে
বলতাম, অ্যাই এই
ভাষায় কত
ভাষা জড়িয়ে
আছে জানিস? যেমন, ‘অ্যাঁই
ন খায়ম’। অ্যাঁই=
হিন্দি, ইংরেজি , ন=
ইংরেজি , খায়ম=সংস্কৃত!!!!!!!!!!!!!!
হা, হা, হা.....................।
বন্ধুদের
বলতাম, আমরা কত
ধনী জাত
বুঝলি ছাগল!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!
তবে সবাই
এই ভাষা
শুনতে চাইতো, শুনতে
ভালোবাসতো। আমরাও
ভাঙ্গা ভাঙ্গা
ভাবে যতটা
পারতাম বলতাম।
তবে এখন আর
আমরা এই
বাংলায় যারা
চট্টগ্রামের মানুষ
বাস করি
সেই দেশভাগের
সময় থেকে
তারা অর্থাৎ
আমাদের পূর্ব
পুরুষরা চলে
যাবার পর
উত্তরপুরুষরা ভাষা
চর্চার অভাবে
ভুলে গেছি
সেই মাতৃভাষা!!!!!!!
এখন এই
ভাষা এখানকার
বেশীরভাগ চট্টগ্রামীদের
কাছে পূর্ব
পুরুষদের অতীত
স্মৃতি বিজরিত
ভাষা। অনেকটা
'সেই
রাজাও নেই, নেই
রাজ্য'-এর মত।
মায়ের আমলের
সেই কত
অনুষ্ঠান আজ
আর হয়
না। ভুলে
গেছি চট্টগ্রামের
লইট্যা মাছ, শুঁটকি
মাছ, লতি, কচু, পুলি, পিঠা, ভাঙ্গা
খই-এর
মোয়া (কি
জানি বলে, মনে
নেই এখন
আর), তারপর
'বতের
ভাত' ইত্যাদি ইত্যাদি
কত রকমের
খাওয়া দাওয়া।
মাকে দেখতাম
কি একটা
'কালকুমার
আর বেলকুমার' ব্রত
করতো! আজ
আর ঠিক
মনে নেই।
ব্রতের আগের
ও ব্রতের
দিন বাবাকে
দেখতাম কত
রকমের খাবার
বাজার থেকে
নিয়ে আসতো
মায়ের ব্রত
পালনের জন্য।
নানারকম খাবার
রান্না ক'রে
চাটনি, পায়েস, দই, মিষ্টি, ফল
সহযোগে দু'টো
কলাপাতায় সেই
খাবার সমান
সমান সাজানো
হ'ত। তারপর
নানা পূজার
অনুষ্ঠান শেষে
সেই দু'টো
থালার একটা
থালা ছাদের
একটা জায়গা
জল দিয়ে
ধুয়ে পরিস্কার
ক'রে সেইখানে
প্রদীপ, ধূপ জ্বালিয়ে
সাজিয়ে দেওয়া
হ'ত। তারপর
সবাই ঘরে
চলে আসতাম।
ঘর থেকে
লুকিয়ে লুকিয়ে
দেখতাম কি
হচ্ছে। ছাদে
কাকেদের ভিড়
লেগে যেত
কিন্তু কেউ
সেই থালায়
মুখ দিত
না; কখনো বা
একটা কাকও
আসতো না।
আমরা অধীর
হ'য়ে পড়তাম।
কখন কাক
খাবে তারপর
আর একটা
যে থালা
সাজানো আছে
সেটা আমরা
খাবো। আজও
অবাক হয়ে
ভাবি কত
কাক এলেও
কেউ মুখে
দিত না
আবার অনেক
সময় একটা
কাকও আসতো
না দীর্ঘ
সময় ধ'রে।
হয়তো কোনও
ত্রুটি হ'য়ে
থাকবে পুজায়।
মাকে দেখতাম
বিষন্ন মুখে
বসে থাকতে।
অনেকক্ষণ দেরী
হ'লে মা
বলতো তোরা
খেয়ে নে।
মা এতটাই
বাস্তববাদী মহিলা
ছিলেন। কিন্তু
আমরা খেতাম
না। তারপর
হঠাৎ দেখতাম
কোথা থেকে
একটা মোটাসোটা
কালো কুচকুচে
কাক এসে
এক ঠোক্কর
দিয়ে ঠোঁট
দিয়ে খাবার তুলে
নিয়ে উড়ে
চলে যেত।
আর তারপরই
ঝাঁপিয়ে পড়তো
অ-নে-ক
কাক কা
কা রবে!
আমরা জানালা
দিয়ে লুকিয়ে
চুরিয়ে দেখতাম
সেই দৃশ্য
অসীম ধৈর্য্য
নিয়ে। তারপরই
লাফ দিয়ে
নেবে বসে
যেতাম সেই
খাবার খেতে।
আমার সঙ্গে
আমার বোনের
সেই খাওয়া
নিয়ে ঝগড়া
আজও মনে
আছে। বড়
মধুর সেই
স্মৃতি! আজ
বোন আছে
কিন্তু অন্য
সংসারে ব্যস্ত
ক্লান্ত এক
নারী হ'য়ে।
সেই দিনের
মত খাবার
নিয়ে ঝগড়া
করার আজ
আর অবকাশ
নেই। সময়
বড় নিঠুর!
আজ আর
মা-ও
নেই, নেই বাবা, নেই
সেই দিন!
নেই সেই
সব ব্রত
আর নানারকম
চট্রগামী খাবার
দাবার! তবে
মাঝে মাঝে
শুনতাম বছরে
একবার চট্টগ্রাম
পরিষদ কি
একটা উৎসবের
আয়োজন করে।
সেখানে চট্টগ্রামের
হিন্দু সম্প্রদায়ের
মানুষেরা জড়ো
হ'য়ে খাওয়া
দাওয়ার উৎসব
করে। সম্ভবত
সেই উৎসবকে
'মেজবানি
উৎসব' বলে। নানারকমের
মাছ, সবজী, প্রধানত শুঁটকি
মাছের এলাহি
আয়োজন হয়। কিন্তু
কোনোবারই সেখানে
যাওয়া হয়নি।
যাওয়া হয়নি
কারণ কোনো
যোগাযোগ নেই
অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের
কারও সঙ্গে।
আর পরিচিত
জনেরা জানলেও
কেউ দাওয়াতও
দেয় না
অনুষ্ঠানে যোগদান
করার। তাই
স্মৃতিই একমাত্র
সম্বল বেঁচে
থাকার আর
পূর্ব পুরুষ, অতীতের
ঘটনাকে স্মরণ
করার! স্মৃতি
সতত সুখের
হলেও, স্মৃতি বড়
বেদনার। এই
বেদনা নিয়েই
আজও বেঁচে
আছি।
No comments:
Post a Comment