“গত ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে ভারতে মুক্তি পায় সমালোচিত ছবি ‘গুন্ডে’। ছবির ট্র্যায়েলের শুরুতে ইরফান খানের কণ্ঠে হিন্দিতে ভেসে আসে ‘১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১, শেষ হলো ভারত পাকিস্তানের তৃতীয় যুদ্ধ। সেদিন ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে প্রায় ৯০ হাজার পাকিস্তানি ফৌজ আত্মসমর্পণ করল। এটা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় আত্মসমর্পণ। এ যুদ্ধের ফলে জন্ম নিল একটি নতুন দেশ, বাংলাদেশ’। বিতর্কিত ভারতীয় ‘গুন্ডে’ সিনেমায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে অবমাননা করায় সেখানকার অর্ধশতাধিক ওয়েবসাইট হ্যাক করেছে বাংলাদেশ সাইবার আর্মি। সিনেমায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ভারত ও পাকিস্তানের তৃতীয় যুদ্ধ হিসেবে বলা অনলাইনে সরব হয়ে ওঠে নেটিজেনরা। বক্তব্যের প্রতিবাদে প্রথমে ফেসবুকে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। এখন এর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় প্রতিবাদের দাবি জানিয়ে ভারতীয় ওয়েবসাইট হ্যাক করে বাংলাদেশ সাইবার আর্মি”।
ইরফান খানের কন্ঠে ভেসে আসা কথা শুনে চতুর্দিকে যে ঝড় উঠেছে তা’তে স্বাভাবিকভাবেই ঝড় উঠল আমার মনেও। ১৯৭১ সাল আমার কাছে ভীষনভাবে স্মরণীয় ও স্পর্শকাতর! তখন আমার বয়স মাত্র ষোল কি সতেরো। সেই সময় বাংলাদেশের মানুষের ওপর বিশেষ করে নারীদের ওপর যে অমানুষিক নারকীয় পৈশাচিক অত্যাচার হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্থানী সৈন্যদের দ্বারা সে খবর প্রতিনিয়ত খবরের কাগজে পড়তে পড়তে আর রেডিওর খবরে শুনতে শুনতে অস্থির হ’য়ে পড়তাম। সেই সময় হিন্দিতে ‘জয়বাংলা’ বলে একটা ছবি হয়েছিল সেই ছবি দেখার জন্য ছুটে গেছিলাম পারিবারিক বাধা উপেক্ষা করে। সেই ছবি আজও স্মৃতিতে উজ্জ্বল হ’য়ে আছে। ছবিতে পাক সেনা ও রাজাকারদের নির্ম্মম হত্যালীলা আর ভয়ংকর যৌন অত্যাচার নাড়িয়ে দিয়েছিল গোটা দেশটাকে। মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে দেশের সমস্ত মানুষ গর্জে উঠেছিল সেদিন। রেডিওতে ভেসে আসা মুজিবরের উদ্দাত্ত আহ্বান আজও কানে বেজে ওঠে স্মৃতি রোমন্থনে! সেই কন্ঠস্বর, ‘ভাইসব, মায়েরা, বোনেরা আমার যে যেখানে আছো লাঠি, কুড়াল, দা, বটি যা পাও হাতে লইয়া বাইরইয়া পড়............’ কথাগুলি সবটা ঠিক মনে নেই, তবে এটা মনে আছে লক্ষ লক্ষ মানুষ সেদিন মৃত্যুকে উপেক্ষা করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বীর বিক্রমে এরকমই এক বজ্রনির্ঘোষ আকুল আহ্বানে! সম্মিলিত শক্তিরুপে আত্মপ্রকাশ করেছিল বাঙ্গালী সেদিন পাক সেনা ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে। সেদিন কোন মুসলমান বা হিন্দু সত্তার জাগরণ ঘটেনি, জাগরণ ঘটেছিল বাঙ্গালীজাতি সত্তার! গোটাবিশ্ব সেদিন দেখেছিল খাঁটি আর্য রক্ত বয়ে যাওয়া বাঙ্গালীর শৌর্য, বীর্য; দেখেছিল পরাক্রম! আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ও ট্রেনিংপ্রাপ্ত সৈন্যবাহীনির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের দাঁতে দাঁত চেপে আমরণ মুক্তির লড়াই আজও ইতিহাস! বাঙ্গালী মাত্রই গর্বের সাথে স্মরণ করে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত ইতিহাসকে। পাকসেনা ও রাজাকারদের দ্বারা যৌথ ভাবে লক্ষ লক্ষ মানুষকে নির্ম্মমভাবে হত্যা, স্কুল, কলেজ, হোষ্টেল ও বাড়ি থেকে হাজার হাজার আমার মা-বোনকে তুলে এনে মিলিটারি ক্যাম্পে বন্দি ক’রে ইজ্জত নিয়ে হায়েনার মত উল্লম্ফন শেষে নির্ম্মম হত্যার জ্বলন্ত কাহিনীকে, বাংলার মুক্তির জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষের স্বেচ্ছায় আত্মত্যাগকে কি বিকৃত করা যায়? কার আছে সে হিম্মত? বিকৃত করা যায় না, যাবেও না কোনোদিন। ইতিহাস ইতিহাস! ইতিহাস বিকৃত করা যায় না, ভুলিয়ে দেওয়া যায় না! মহাকালের বুকে মাথা উঁচু করে জেগে থাকে ইতিহাস!
সেদিনের বাংলাদেশের মুক্তির লড়াইয়ের ঢেউ
এ-বাংলার হৃদয়কেও ভীষণভাবে ছুঁয়ে গেছিল। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু,
নারীদের ওপর অকথ্য অত্যাচারের খবর এ-বাংলার বাঙ্গালীকে ভীষণ নাড়িয়ে দিয়েছিল।
নাড়িয়ে দিয়েছিল গোটা ভারতবাসীকে। বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের আত্মত্যাগ এ-বাংলা
ও বাঙ্গালী তথা ভারতের অন্তরাত্মাকে জাগিয়ে দিয়েছিল! ঝড় উঠেছিল, উঠেছিল তুফান
বাংলা তথা ভারতবাসীর অন্তরের অন্তঃস্থলে! সেই ঝড় গিয়ে আছড়ে পড়েছিল ভারতের সংসদ
ভবনের অভ্যন্তরে! নড়ে উঠেছিল প্রশাসন! সেদিন আত্মজর পাশে দাঁড়াতে দেরী করেনি,
দ্বিধা করেনি মুল ভূখণ্ড তথা ভারত তথা পিতৃসত্তা! এটা একটা স্বাভাবিক পদক্ষেপ ছাড়া
আর কিছুই নয়! প্রতিবেশীর আপদে-বিপদে পাশে দাঁড়ানো প্রতিবেশীর দায়িত্ব ও
কর্তব্যবোধের মধ্যেই পড়ে। এটাই সভ্যতা! এটাই সংস্কৃতি! এটাই শিক্ষা! এটাই মানবতা!
এখানে অহংকারের কোন জায়গা নেই, নেই কোন কৃতিত্ব দাবী করার প্রশ্ন! শুধু আছে সত্যকে
স্বীকার করার, বাস্তবকে স্বীকৃতি দেবার আন্তরিক স্বচ্ছতা! নির্ম্মল মানসিকতা!
ইতিহাসের মান্যতা!
বাংলাদেশের মানুষের সেদিনের লড়াই ছিল একান্তই
নিজস্ব অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। অস্তিত্বের
টান গোটা বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী ভয়ংকর শক্তিকে আর একবার মনে করিয়ে দিয়েছিল অসম
শক্তির লড়াই হলেও অস্তিত্বের সঙ্কট দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মানুষের মত বাঁচার
তীব্র তাগিদে শেষবারের মত শত্রুপক্ষের ব্রম্মতালুতে সবেগে বিষাক্ত ছোবল বসিয়ে যায়
অস্তিত্বের জানান দিতে যে, আমি ছিলাম, আমি আছি, আমি অনন্তকাল যতদিন চন্দ্র সূর্য
থাকবে, ততদিন থাকবো! এ-লড়াই ছিল বাংলা ও বাঙ্গালীর অস্তিত্বের লড়াই! এ-লড়াই
বাঙ্গালীর অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে সংগঠিত হয়েছিল! ভারত সেদিন শুধু স্বাভাবিক
দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ থেকেই আত্মজর পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। এ ছিল নাড়ীর টান! নাড়ি কেটে
যেদিন আলাদা হয়েছিল সন্তান মায়ের বন্ধন থেকে, পরবর্তীতেও সেই বন্ধন দৃশ্যমান না
হলেও অটুট থেকে যায় মায়ের হৃদয়ে! সন্তানের বিপদে লক্ষ কোটি মাইল দূরে হলেও মায়ের
হৃদয় কেঁপে ওঠে প্রথম অজানা আতঙ্কে! তেমনি ভারতও সেদিন এই একই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত
করেছিল প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই! এর জন্য মায়ের হৃদয়ে কোন কৃতিত্ব দাবীর লক্ষণ
ফুটে ওঠে না, ফুঠে ওঠে চোখমুখে সন্তানকে রক্ষা করতে পারার এক অনাবিল নির্ম্মল
প্রশান্ত গভীর তৃপ্তি! আর কিছুই নয়!
একাত্তরে বাঙ্গালী সেদিন অসম লড়াইয়ে শেষ
রক্তবিন্দু দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। যে নিজের অস্তিত্ব নিজে রক্ষার লড়াই-এ সামিল না
হয় সেই লড়াই কি কোনদিন সফল হয়, সার্থক হয়, স্বীকৃতি পায়? স্থান পায় ইতিহাসের বুকে?
পায় না। বাঙ্গালীর এ-লড়াই শুরু হয়েছিল ভারত ভাগের সময় থেকেই। ব্রিটিশ ও তৎকালীন
নেতৃবৃন্দের যোগসাজশ সেদিন বাংলা ও পাঞ্জাবকে দু’টুকরো ক’রে ধর্ম্মের ভিত্তিতে
ভারত ভাগকে সম্পূর্ণতা দিয়েছিল। যে ভিত্তি আজও অটুট! বুকে হাত দিয়ে কি আমরা আজও
বলতে পারি, “বাংলা আমাদের, আমরা বাঙ্গালী, আমরা হিন্দু বা মুসলিম নই”। পারি না! পারি
কি বাঙ্গালী বলে দুই বাংলা এক হতে? পারি না! সেদিন বাংলা ভাগ হয়েছিল যে উদ্দেশ্যে
সেই উদ্দেশ্য আজও বহমান! বাঙ্গালী জাতীর মেধা, বাঙ্গালী জাতীর বুদ্ধি, বাঙ্গালী
জাতীর প্রজ্ঞাকে খতম করার, ছিন্নভিন্ন করার অভিযান আজও সমানে বয়ে চলেছে। আর তা
চলেছে বাঙ্গালীর হাত ধরেই!!!!
‘গুন্ডে’ ছবিতে ইরফানের কন্ঠে যে কথা ভেসে এল
সে কথার মর্ম্মার্থ আমার কাছে বাংলাদেশের মহান মুক্তি যুদ্ধের গৌরব গাঁথাকে
অপমানিত করেছে বলে মনে হয়না। হয়তো পরিবেশনে, বিশ্লেষনে কোথাও অসম্পূর্ণতা রয়ে
গেছে। এ-ছাড়া আর কিছুই নয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে অপমান করার, লাঞ্ছনা করার
আস্পর্ধা কারো নেই। আর যদি কেউ আস্পর্ধা দেখায়ও প্রকৃতির নিয়মেই সে ঝরা পাতার মত
ঝড়ে পড়ে যাবে। ছবির শুরুতে ভেসে আসা কথাগুলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যখন বাংলা ও
বাঙ্গালীর ভয়ংকর হয়ে ওঠা মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানীর পরাক্রমে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত
পাকবাহিনী সর্ব্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাংলা ও বাঙ্গালীর মুক্তিযুদ্ধকে,
বাঙ্গালী জাতিকে খতম করার জন্য তখন প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসাবে মানবতার ডাকে,
দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধের চেতনায়, আত্মজর প্রতি স্বাভাবিক নাড়ীর টানে ভারত সেদিন
সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে গেছিল আমার মা-বোন-ভাই-দাদাদের বাঁচানোর তীব্র তাগিদে! লড়াইয়ের
অভিমুখ ঘুরে গেছিল ভারত পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধে। পাকসেনাদের বাংলা ও বাঙ্গালীর
ওপর এই আক্রোশ তো আজকের নয়, এই আক্রোশ তো পাকিস্থান জন্মলগ্ন থেকেই। পাকিস্থান
ভালোমতোই জানত ব্রিটিশ ও তৎকালীন নেতৃত্বে গঠিত এই অদ্ভুত দেশগঠন বেশীদিনের জন্য
নয়। আজ নয় কাল এই অদ্ভুত দেশ গঠন স্বাভাবিক ও প্রকৃতির নিয়মেই ভেঙ্গে যাবেই। শুধু
সময়ের অপেক্ষা মাত্র! তাই তো দেশভাগ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়ে লেগেছিল উর্দু
ভাষাকে জাতীয় ভাষায় পরিণত করে বাংলাভাষা তথা বাঙ্গালীকে নিশ্চিহ্ন করতে। কিন্তু
তারা সম্ভবত এটা জানত না খাঁটি আর্য রক্তের কোথাও এখনও যদি কিছু অবশিষ্ট থাকে তবে
তা’ কিয়ৎ পরিমাণে হলেও আজও বাঙ্গালীর রক্তের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে! ভারতের ম্যাপটা
যদি দেখা যায় দেখা যাবে কি অদ্ভুত ক্ষমতা দখলের তীব্র আকাঙ্খা ওই সময়ের
নেতৃবৃন্দকে প্ররোচিত করেছিল! ক্ষমতা দখলের লোভে উন্মত্ততায় অন্ধ হ’য়ে উঠেছিল
নেতৃবৃন্দ ও পৃথিবীতে সবচেয়ে সভ্য ও শৃঙ্খলাবদ্ধ জাত বলে পরিচিত ব্রিটিশের
রাজরক্ত! আজও বোধহয় লজ্জা পায় এ-কথা ভেবে ব্রিটিশের শিক্ষিত সমাজ। ব্রিটিশের লেখাপড়া
জানাওয়ালা মানুষের দ্বারা সৃষ্ট Divide & Rule নীতিতে ভর করে ভারত ভেঙ্গে পাকিস্থান নামে যে
দেশটার জন্ম হ’ল সেই দেশটা কি রকম? ভারতের একেবারে উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত একটা দেশ
আর তার একটা অংশ ভারতের একেবারে পুর্বদিকে ভারতের মাঝখানে অবস্থিত! ভাবা যায়!? কিন্তু
রাজনীতির কুশীলবরা অসম্ভবকে সম্ভব করার সীমাহীন ক্ষমতা রাখেন! 6 আর 9 এর খেলা দেখানোয় তারা সিদ্ধপুরুষ! আম জনতাকে
বুড়ো ভাম জনতায় পরিণত করতে সারা পৃথিবীতে এদের জুড়ি নেই। আর এলিট সমাজ তো দ্রৌপদীর
বস্ত্রহরণের সময় থেকে প্রমাণ করেছে তাঁরা ভীষণভাবে নীতিনিষ্ট বুদ্ধিজীবী! এই সমস্ত
আদর্শহীন ফাঁপা নীতি সর্ব্বস্ব এলিটরা রাজনীতিবিদদের হাতের খেলার পুতুল। তা না
হ’লে এরকমও দেশের ভৌগোলিক কাঠামো হয়! পৃথিবীতে এরকম দ্বিতীয় নজির আর আছে কিনা আমার
জানা নেই। কি করে, কোন পথ দিয়ে যে শাসন করতো পশ্চিম প্রান্ত থেকে পূর্ব প্রান্তকে
আজও ভাবতে বসলে মাথা ঘুরে যায়। যাইহোক সেদিন মুক্তিযুদ্ধের শেষবেলায় ভারতের অবস্থান
পাকিস্তানকে আত্মসমর্পনে বাধ্য করেছিল। ভারতের জেনারেল জে,এন,চৌধুরীর কাছে
পাকিস্তানের জেনারেল নিয়াজী তার ৯০হাজার সৈন্য নিয়ে আত্মসমর্পন করেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় আত্মসমর্পণ। বন্ধ হয়েছিল উন্মাদ পাকসেনা আর নরাধম রাজাকারদের দ্বারা সংঘটিত নৃশংস
হত্যা আর মাতৃ জাতীর প্রতি দানবীয় ভোগলীলা। পূরণ হয়েছিল লক্ষ লক্ষ শহীদের রক্ত
দিয়ে গড়া বাঙ্গালীর স্বপ্ন! এখানে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে অবমাননা করার প্রশ্ন
আসে কোথা থেকে। এ-তো সত্য! এই সত্যকে অস্বীকার করার মানসিকতার প্রশ্নই বা আসে কোথা
থেকে? ইরফানের কন্ঠে উচ্চারিত শব্দমালায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অপমানের ঘ্রাণ
কোথা থেকে এল বোঝার চেষ্টা করলাম। ইরফানের
কন্ঠে ভেসে আসা ‘১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১, শেষ হলো ভারত পাকিস্তানের তৃতীয় যুদ্ধ’ কথার মধ্যে আপত্তি থাকতেই পারে। বাংলাদেশের
স্বাধীনতার যুদ্ধের ইতিহাস যাদের জানা নেই তাদের কাছে কথাটা অনেকটা ধড় আর ল্যাজ
বাদ দিয়ে কাটা মাছের মত। এই জায়গায় বিস্তারিত বর্ণনার অবশ্যই প্রয়োজন ছিল। যুদ্ধের
প্রেক্ষাপট বর্ণনার সঙ্গে ইতিহাসের অবতারনা করে সামঞ্জস্য রেখে তুলনামূলকভাবে
কথাটাকে যুক্তিগ্রাহ্য করে পরিবেশন করা যেত। যুদ্ধটা ছিল পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ যুদ্ধ। ভারত
শুধু তার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করেছে মাত্র মানবতাকে, মানবিকতাকে রক্ষা করার
তাগিদে। লড়াইটা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে পূর্ব
পাকিস্তানের আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদার লড়াই। লড়াইটা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের
আগ্রাসী মানসিকতার বিরুদ্ধে পুর্ব্ব পাকিস্তানের ইজ্জতের লড়াই। লড়াইটা ছিল পশ্চিম
পাকিস্তানের অন্য স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বিলোপের স্বৈরাচারী অভিযানের বিরুদ্ধে
পুর্ব্ব পাকিস্তানের অস্তিত্ব রক্ষার জন্মগত অধিকারের মরণপণ লড়াই। লড়াইটা ছিল
বাংলা ও বাঙ্গালীর পৃথিবীর বুকে শ্রেষ্ঠ এক কৃষ্টি, সংস্কৃতি রক্ষার অহংকারের,
গর্ব্বের লড়াই। এ-লড়াইকে অবমাননা করে কার সাধ্য? এ-লড়াইকে অস্বীকার করে, অপমান করে
এমন বুকের পাটা অন্য গ্রহে অন্য কোন জীবের আছে কিনা জানা নেই, তবে এ গ্রহে কারো
নেই। তাই এমন বালখিল্য অপরিণত বিবৃতিতে উত্তেজিত হওয়ার কোন দরকার নেই। দ্বিতীয়ত,
ইরফানের কন্ঠে উচ্চারিত ‘এ যুদ্ধের ফলে জন্ম নিল একটি নতুন দেশ, বাংলাদেশ’ কথায় স্বাভাবিক ভাবেই দেশবাসীর আত্মসম্মানে
আঘাত করে। অসম্পূর্ণ ও অস্বচ্ছ বিবৃতি অনেক সমস্যার
জন্ম দেয়। বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাস, মুক্তির প্রেক্ষাপট বিস্তারিত না হলেও
সংক্ষিপ্ত অথচ পরিপুষ্ট বিবরণের প্রয়োজন ছিল। ‘যুদ্ধের ফলে বাংলাদেশের জন্ম’ প্রসঙ্গে
বিবৃতির সময় একই দেশের দুই অংশের মধ্যে যুদ্ধের ভিত্তি, সঙ্গে ভারতের যুদ্ধে
অংশগ্রহণের কারণ উল্লেখের প্রয়োজন ছিল। তাহলে অযথা বিতর্কের জন্ম হতো না। এ দিক
দিয়ে বিচার করলে অবশ্যই এ-এক ত্রুটি।
যাইহোক, ছবির ট্রায়েলের বক্তব্যে বিতর্কের
জন্ম হলেও দেখতে হবে বক্তব্য উদ্দেশ্য প্রণোদিত কিনা। নাকি অনিচ্ছাকৃত ভুল বা
বক্তব্যের বিষয়কে গুরুত্বের সঙ্গে না দেখার পরিণাম। নাকি বক্তব্যের বিষয় যেটা বলতে
চেয়েছে সেটা অসম্পুর্ণ ও অস্বচ্ছ কিম্বা ঠিকমতো পরিবেষণ না করতে পারার জন্য অহেতুক
সমস্যার জন্ম। কোনটা? বিতর্ক অনেক
উত্তেজনা ও উদ্ভট কল্পনার জন্ম দেয়। ফলে বৃহৎ ও জটিল সমস্যার সৃষ্টি হয়। আর এর
সুযোগ নেয় বিভেদকামী শক্তি। তাই বিতর্ক যেন অহেতুক আম জনতার মস্তিষ্ককে উত্তেজিত
করে না তোলে এবং উদ্ভট জাঁকজমক পুর্ণ কল্পনার অধিকারী হয়ে দুই দেশের সম্পর্কের
মধ্যে সমস্যাকে বাড়িয়ে না তোলে। বিতর্ক যেন সুযোগ সন্ধানীকে উৎসাহিত করে না তোলে, ছেদককে
যেন গালিচা বিছিয়ে আহ্বান না করে। বিতর্ক যেন উভয় দেশের পারস্পরিক হৃদয়গ্রাহী
আলোচনায় সমাধা হয়।
বিতর্কের বিষয় অবিভক্ত ভারতের স্বাধীনতা
যুদ্ধের ঘটনাবলী মনে করিয়ে দিল। ব্রিটিশের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার যুদ্ধে ভারতের দুঃখজনক
বিষাদময় চরিত্র সর্ব্বশ্রেষ্ট দেশপ্রেমিক নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু দেশকে স্বাধীন
করার তীব্র ইচ্ছায়, কঠিন আবেগে, ইস্পাত কঠিন মানসিকতায়, বলিষ্ঠ হৃদয়ে ‘শত্রুর
শত্রু আমার বন্ধু’ এই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সুচতুর নীতিতে দেশের বাইরে পা রেখেছিল। হাত
মিলিয়েছিল জাপান ও জার্মানীর সর্বাধিনায়কের সঙ্গে। হাত মিলিয়েছিল শুধুমাত্র দেশকে
পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করার জন্য। হাত মিলিয়েছিল শক্তিশালী প্রতিপক্ষের
সঙ্গে যুদ্ধে সামিল হওয়ার লক্ষ্যে আরও বেশী কার্যকর শক্তি সঞ্চয়ের জন্য। লক্ষ্য
একটাই ছিল, দেশকে স্বাধীন করা। তিনি জানতেন ছলে, বলে, কৌশলে সে লক্ষ্য পুরণ করতে
হয়। তার জন্য শক্তিমানের সাহায্য গ্রহণ করা প্রখর বাস্তববাদীর পরিচয়। নেতাজী সুভাষ
চন্দ্র বসু সে লক্ষ্যে সফল হয়েছিলেন। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু নাজি জার্মানীর
প্রধান অ্যাডলফ হিটলার ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী হিডেকি তোজো-র সাহায্যে সেদিন
ভারতের স্বাধীনতাকে প্রায় ছিনিয়ে নিয়েছিলেন ব্রিটিশের হাত থেকে। মণিপুরে
স্বাধীনতার পতাকা উড়িয়ে এগিয়ে চলেছিলেন দিল্লী দখলের লক্ষ্যে। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধ
পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যায়! বদলে যায় সামগ্রিক ছবি, ছক ও পরিকল্পনা! বদলে যায় অখন্ড
ভারতের ও আম ভারতবাসীর স্বপ্ন! বদলে যায় ভারতের ভবিষ্যত ভাগ্য!
এখন প্রশ্ন, হিটলারকে, তোজো-কে আমরা
ভারতবাসীরা কি চোখে দেখবো? আমাদের মুক্তির প্রশ্নে, আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের
প্রশ্নে, আমাদের শক্তি বৃদ্ধির প্রশ্নে, আমাদের অসম লড়াইয়ে বিজয় লাভের জন্য রসদ
যোগানোর প্রশ্নে যে বা যারা সেদিন আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল তাঁদের আমরা কি চোখে
দেখবো? তাঁরা কি আমাদের চোখেও যুদ্ধ অপরাধী? আমারা কি মীরজাফর, জুডাসদের পথ অনুসরণ
করব? ব্রিটিশ সেদিন আমাদের দেশটাকে আমাদের হাতে ছেড়ে দেবার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল
তা নিয়েছিল নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর নিখুঁত যুদ্ধ নীতির কারণেই। অনেক দুরদর্শিতার
পরিচয় দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্বের ক্ষমতা দখলের লোভকে কাজে লাগিয়ে ব্রিটিশশক্তি
সেদিন দেশটাকে এলোমেলো করে দিয়েছিল নোংরা রাজনীতির চরম বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে
দ্রুততার সঙ্গে সাপ লুডোর ঘৃণ্য খেলা খেলে। পরিণতিতে ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ শুধু
নয়, প্রাপ্তি ঘটেছিল পশ্চিম পাকিস্তান ও পুর্ব পাকিস্তানের মত অদ্ভুত অবৈধ অনৈতিক
দেশ গঠন এবং আমাদের সবার প্রিয় নেতাজীর রহস্যজনক অন্তর্ধান! পশ্চিম পাকিস্তান ও
পুর্ব পাকিস্তান নিয়ে যে অদ্ভুত দেশ গঠন হয়েছিল তার পিছনে কি কারণ ছিল? কেন ওরকম
এক অদ্ভুত দেশ গঠন হয়েছিল? কেন তৎকালীন দেশবরেণ্য প্রাজ্ঞ নেতারা এরকম একটা অদ্ভুত
অবৈধ অনৈতিক দেশগঠনে সায় দিয়েছিল? বিট্রিশরা তো সভ্য, শিক্ষিত, সংস্কৃতিবান জাত
বলে পৃথিবীতে পরিচিত ছিল। তারা এরকম অদ্ভুত ভাগে সম্মতি দিল কি করে? ভাবলে অবাক
হয়ে যায়!
ভারতের বর্তমান ম্যাপটা দেখলে বুকের মধ্যে
একটা ব্যথা অনুভুত হয়। ম্যাপে বাংলাদেশের অনুপস্থিতি দেখলে মনে হয় কে যেন দেশটার
মাঝখান থেকে এক টুকরো মাংস খুবলে নিয়েছে। একটা বীভৎস ক্ষত যেন গভীর গর্তের সৃষ্টি
করেছে! যে ক্ষত বোধহয় আর কোনদিনই পুরণ হওয়ার নয়! আজ বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র!
কিন্তু এ-কোন বাংলা? এ-কি নেতাজীর বাংলা? এ-কি মুজিবরের বাংলা? এ-কি জীবনানন্দের
বাংলা? এ-কি রবীন্দ্রনাথের বাংলা? এ-কি কাজী নজরুল, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, এস
ওয়াজেদ আলি, শরৎচন্দ্র, মধুসূদন, বঙ্কিমচন্দ্র, বিদ্যাসাগর, দেশবন্ধু, রামমোহন
ইত্যাদি ইত্যাদির বাংলা? এ-কি বাঙ্গালীর অটুট বাংলা? এ-কি গঙ্গা-পদ্মার যৌথ বাংলা?
একটাই শব্দ না-না-না!!!!! কেন না? আজকের এই ‘না’ এঁকে দিয়েছিল ভারত ভাগের বহু আগেই
সেই ঘৃণ্য পরিকল্পনার গোপন গোলটেবিলের আলোচনায় অখন্ড ভারতভাগের কুশীলবেরা! সেই
সময়ের ভারত ভাগের কুশীলবেরা বুঝতে পেরেছিল অতি প্রাজ্ঞ, প্রখর সুক্ষ্ম ও তীক্ষ্ণু
বুদ্ধির অধিকারী বাঙালীকে এক রাখা যাবে না। রাখলে এই বিশাল বাংলার প্রাজ্ঞ
বাঙ্গালীরা দিল্লীর মসনদে বসে ভারতের ভাগ্যবিধাতা হ’য়ে উঠবে। এমনিতেই ভারতের
তৎকালীন নেতৃবৃন্দ এবং ব্রিটিশ রাজশক্তি সহ অন্যান্য বিশ্বশক্তি বুঝে গেছিল
স্বাধীন ভারতের রুপকার হতে চলেছে অসম্ভব শক্তিমান প্রখর বাস্তব বোধসম্পন্ন বিশ্বের
বিস্ময় আসমুদ্রহিমাচলব্যাপী সমস্ত সম্প্রদায়ের জাতি, বর্ণ নির্বিশেষে আমজনতার
নয়নের মণি বাঙ্গালী নেতাজী! আম জনতার মনে সেদিন স্বপ্ন ছিল নেতাজীর নেতৃত্বে দ্রুত
উঠে আসবে বিশ্বের মানচিত্রে ভারত! রবীন্দ্রনাথের স্বপ্ন ‘ভারত আবার জগত সভায়
শ্রেষ্ট আসন লভে’ পূরণ হবে নেতাজীর হাত ধরে! গড়ে উঠবে এক অখন্ড ভারত! তাঁর
ব্যাক্তিত্বের ছটায় আলোকিত হবে ভারত তথা গোটা বিশ্ব! জাপান, জার্মান, ইতালী মিলিত
হবে তাঁর নেতৃত্বে! ক্ষমতার বিশ্বায়নে নির্ণায়ক ভুমিকায় উঠে আসবে নেতাজীর নেতৃতে
আবার আর্য ভারতবর্ষ! আর্য রক্তের স্ফুরণ ঘটবে! আর্য ভারত রুদ্রবেগে আবার ঘুরে
দাঁড়াবে ঝঞ্ঝাবেগে! আর্য সংস্কৃতির উন্নত সমাজবিজ্ঞানের ঢেউ আছড়ে পড়বে সাতসমুদ্র
তেরো নদীর ওপারে! আর্য কৃষ্টি, আর্য সংস্কৃতির জোয়ারে ভেসে যাবে গোটা বিশ্ব! সমগ্র
মানব জাতীর উন্নত জীবন গড়ার লক্ষ্যে আর্য ভাবধারায় তৈরী হবে পটভুমি! এ-সবের জন্য
ক্ষেত্র প্রস্তুত ছিল। প্রস্তুত ছিল চাষের উপযোগী বীজ, সরঞ্জাম! শুধু ছিল সময়ের
অপেক্ষা। তাই তৎকালীন ভারত তথা বিশ্ব নেতৃত্ব এতটা বুঝতে না পারলেও ‘সমঝদারকে লিয়ে
ইসারা কাফি হোতা হ্যায়’-এর মত আঁচ করতে পেরেছিল আগাম আগুনের আর তাই ঠিক করেছিল অতি
দ্রুত বাংলা ও বাঙ্গালীর কোমর ভেঙ্গে দিতে হবে। রুখতে হবে বাংলা ও বাঙ্গালীর
অগ্রগতি। আর তা করতে হবে দেশভাগের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে। ধর্মের সুড়সুড়িতে তাদের
বাঙ্গালী সত্তায় আঘাত হানতে হবে। সংখ্যাগরিষ্ঠ দুই বাঙ্গালী সম্প্রদায়ের মধ্যে
ধর্ম্ম-কে হাতিয়ার করে Divide & Rule প্রয়োগের মধ্যে দিয়ে তাদের মাথায় ঢোকাতে হবে যে বাঙ্গালীর থেকেও তাদের বড় পরিচয় তারা মুসলমান
আর হিন্দু! তাদের এক সত্তা নয়! তাদের সত্তা আলাদা আলাদা! তারা জাতে বাঙ্গালী নয়
তারা জাতে হিন্দু আর মুসলমান! তাদের ধর্ম being
& becoming with environment (সপারিপারর্শিক বেঁচে থাকা ও বেড়ে ওঠা) নয়। তাদের ধর্ম্ম হিন্দু ধর্ম্ম ও মুসলমান ধর্ম্ম! বিভেদকামী শক্তি সেদিন সফল
হয়েছিল। সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অন্ধতা ও অজ্ঞানতাকে কাজে লাগিয়ে সম্প্রদায়গত
বিরোধকে উসকে দিতে সফল হয়েছিল বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি। দেশ ভাগ হয়েছিল। বাংলা ভাগ হয়েছিল।
বাঙ্গালী, বাঙ্গালী সত্তা সেদিন ভাগ হয়েছিল। যার সাক্ষী আজকের বাংলাদেশ! বাংলা
‘মা’ আজ দুভাগে বিভক্ত! এক অংশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃত আর এক অংশ স্বাধীন
রাষ্ট্র ‘ভারত’-এর অঙ্গ রাজ্য হিসাবে স্বীকৃত! কথায় আছে ভাগের ‘মা’ গঙ্গা পায় না! বাংলা
সেদিন common property-তে পরিণত হয়েছিল। তাই আজ প্রমান হ’ল! বিভেদকামী
শক্তির এ এক great achievement! আর বাংলা আর বাঙ্গালীর forever great loss!
তাই ভারতীয় চলচিত্র ‘গুন্ডে’ ছবিতে
অসম্পুর্ণ অস্বচ্ছ বিবৃতিকে ইতিহাস বিকৃতি বলে মনে হতে পারে এবং এ-জন্য অবশ্যই
বাংলাদেশীদের মনে আঘাত লাগতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের বাঙ্গালীদের মুক্তিযুদ্ধের
ইতিহাসে ভারতের অবদান যদি অস্বীকৃত হয় তাহ’লে তা সত্যকে অস্বীকার করা ছাড়া আর কিছুই
নয়। এটাও সেই এস ওয়াজেদ আলী-র “সেই Tradition সমানে চলেছে” এর মত সেই বেইমানির Tradition সমানে চলেছে বলে বিবেচিত হবে।
আসলে ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মিল আছে। ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু করেছিল ভারতীয়রাই।
অর্জুনের লক্ষ্যভেদের মত একটাই লক্ষ্য নিয়ে সেই যুদ্ধকে ত্বরান্বিত করতে, সফল করে
তুলতে, দেশকে পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্ত করতে, ব্রিটিশের বিরুদ্ধে শক্তি বৃদ্ধি
করতে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু জার্মানির সর্বাধিনায়ক বিশ্বের ত্রাস অ্যাডলফ হিটলার
ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী হিটেকি তোজো-র সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন। দোর্দণ্ডপ্রতাপ হিটলার
ও প্রধানমন্ত্রী তোজোর সাহায্যে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস ভারতের স্বাধীনতা
সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করে স্বাধীনতাকে প্রায় হাতের মুঠোয় নিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু
ভাগ্যদেবতা সহায় ছিল না নেতাজীর প্রতি। যাই হোক সেদিনের ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হ’তে
পারতো। লেখা হতে পারতো অবিভক্ত ভারতবর্ষের নতুন ইতিহাস। আর কি হলে কি হতে পারতো সে
আলোচনা নাহয় উহ্যই থাক। কিন্তু আমার দেশের বিপদে, আমার দেশকে স্বাধীন করার জন্য সেদিন
যারা হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল তাদের আমরা কি চোখে দেখব?
ঠিক তেমনি বাংলা, বাংলা ভাষা ও বাঙ্গালীর
লড়াইও ছিল সেদিন অস্তিত্ব রক্ষার মরণপণ লড়াই। আর এ লড়াই শুরু হয়েছিল বাংলা ভাগের
মুহুর্ত থেকেই। ধিকি ধিকি করে তুষের আগুনের মত এই অপমান, অমর্যাদা ও লজ্জার আগুন
বুকের মধ্যে জ্বলছিল বাঙ্গালীদের। ভাষা রক্ষার আন্দোলনের লড়াই থেকে শুরু করে সে
লড়াই-এর আগুন বাংলা ও বাঙ্গালী সত্তার মুক্তির লড়াইয়ে পৌঁছে গিয়েছিল। জোর করে কোনো
কিছুর সুড়সুড়িতেই যে জন্মগত অধিকার, শিকড়ের টান, মাটির দাবী, মায়ের পরিচয়, মানুষের
ইতিহাস, জাত বা জাতীর উৎস, কৃষ্টি, সংস্কৃতি-কে উপড়ে ফেলা যায় না সে কথা সেদিন বুঝেও
বিশ্বশক্তি, ভারতীয় নেতৃত্ব ও পাকিস্তানি শাসক ক্ষমতা কায়েম রাখার উন্মাদনায়,
বাঙ্গালী সত্তার জাগরনের শঙ্কায়, বাঙ্গালী জাতির মেধা ও প্রজ্ঞার প্রতি হীনমন্যতায়
দেশটাকে ভোঁতা ছুড়ির এলোপাথাড়ি আক্রমণে দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হ’য়ে বীভৎস ও
বিকৃতভাবে টুকরো টুকরো করে দিয়েছিল। তার পরিণতিতে ৭১-এর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে
লক্ষ লক্ষ বাঙ্গালীর রক্তে লাল হ’য়ে গিয়েছিল বাংলার মাটি, বাংলার গ্রাম, বাংলার
শহর, বাংলার জনপদ। বাংলার মা-বোনের আর্তনাদ আজও কান পেতে শোনা যাবে বাংলার
আকাশে-বাতাসে। বাংলার হাজার হাজার মা-বোনের সম্ভ্রম, মা-বোনের ইজ্জত, মা-বোনের
সতীত্ব, মা-বোনের আবরণ, মা-বোনের মর্যাদা-আভিজাত্য ডুকরে ডুকরে কেঁদে চলেছে আজও; চোখ
মেলে দেখলে দেখতে পাবে সেই লুন্ঠিত ভয়ঙ্কর দৃশ্য, কান পেতে শুনলে শুনতে পাবে সেই
কান্না! পথের ধুলায়, নালা-নর্দমায়, গাছের ডালে ডালে, বনে-বনান্তরে, গ্রামে-গঞ্জে,
শহরে-নগরে, পাহাড়ে-সমুদ্রে, স্থলে-জলে-অন্তরিক্ষে নীরবে তার জ্বলন্ত উপস্থিতি
জানান দিচ্ছে, সাক্ষ্য বহন করে চলেছে সেই বীভৎস ইতিহাস! আজকের নতুন প্রজন্ম কি তা’
অন্তর্চক্ষু দিয়ে দেখতে পায়? শুনতে পায় সেই মর্ম্মভেদী অতি করুণ শোচনীয় মা-বোনের
কান্না? আর সেদিনের কিশোর, যুবক আজকে প্রৌঢ়-র স্মৃতিতে কি ভেসে আসে সেদিনের সে
ভয়ঙ্কর দৃশ্য?
যাই হোক সেদিনের অত্যাচারিত, লাঞ্ছিত,
অপমানিত, ধর্ষিত বাংলা মায়ের কান্নার ঢেউ আছড়ে পড়েছিল ভারত মায়ের কোলে! শত হলেও মা
মা-ই! সন্তান অস্বীকার করলে করতেই পারে কিন্তু মা-কি পারে? পারে না! সে সন্তান যতই
খারাপ হোক না কেন, মা-কে অস্বীকার করুক না কেন মা-র টান সেই সন্তানের জন্য আরও বেশী কেঁদে ওঠে! কংসের বিনাসের সময়ও মায়ের অন্তরও কেঁপে উঠেছিল!
ঠিক তেমনি, সন্তান বাংলার একান্ত নিজস্ব অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ের দিনে ভারত মায়ের
হৃদয়ে উঠেছিল ঝড়। সেদিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নারী সত্তা
তীব্রভাবে আন্দোলিত হয়েছিল বাংলা নারীর অবমাননায়। নারী সত্তার প্রকৃতই জাগরণ
ঘটেছিল সেদিন ইন্দিরা গান্ধীর হৃদয়ে! শক্তিশালী রাষ্ট্রনেতার প্রকৃত প্রকৃতি কি
হ’তে পারে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের বিপদের দিনে সেদিন বিশ্বশক্তি দেখেছিল তার নমুনা!
নত মস্তকে সেদিন বিশ্বশক্তি সেলাম জানিয়েছিল এই ভয়ঙ্কর নারী সত্তার প্রজ্বলিত
রুপকে! ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে সেদিন ভারত পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যবাহিনীর
দানবীয় অত্যাচারের বিরুদ্ধে স্বাভাবিক ভাবেই মানবতার পুজারী রুপে পুর্ব পাকিস্তান
তথা বর্তমান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পাশে দাঁড়িয়েছিল সর্বশক্তি নিয়ে। যুদ্ধ শেষ
হয়েছিল ভারতের জেনারেল
জে,এন,চৌধুরীর কাছে পাকিস্তানের জেনারেল নিয়াজীর ৯০হাজার সৈন্য নিয়ে আত্মসমর্পনের
মধ্যে দিয়ে। আর বাংলাদেশকে সাহায্যের ফলস্বরুপ চিরকালীন শত্রুতে পরিণত হ’ল ভারত
পাকিস্তানের দৃষ্টিতে! এটা ইতিহাস! আর এই ইতিহাসকে অস্বীকার করা আর বেইমানী ও অকৃতজ্ঞতা একই
মুদ্রার এ-পিঠ আর ও-পিঠ!
যাইহোক বাংলাদেশের জন্মের পিছনে রয়েছে
বাঙ্গালীদের রক্তক্ষয়ী যন্ত্রণাদায়ক ও মা-বোনেদের আব্রু লুন্ঠনের এক করুণ ইতিহাস!
আর রয়েছে ‘মা’ রুপী ভারতের ‘সন্তান’ রুপী বাংলাদেশের প্রতি আত্মত্যাগের মহান
ইতিহাস। সেদিন ইচ্ছা করলেই মা তার সন্তানকে ফিরে পেত। বিশ্বের কোন শক্তির সেদিন
ক্ষমতা হ’ত না মা আর সন্তানের বৈধ অন্তর্ভুক্তির বিরোধীতা করার। কিন্তু সেদিন ভারত
সরকার তা করেনি। আর তা করেনি তা কিন্তু কোন মহানতার কারণে নই; করেনি বহুদূর
বিস্তৃত এক গভীর ষড়যন্ত্র থেকে। ব্রিটিশদের ছেড়ে যাওয়া সেই একই মন্ত্র ‘Divide & rule-র বাস্তব প্রয়োগের প্রতিফলন ছিল সেই ঘরের ছেলে
ঘরেতে ফিরিয়ে না নেওয়ার বিস্ময়কর সিদ্ধান্ত!! স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষিত হ’ল, স্বীকৃতি
পেল বাংলাদেশ। আনন্দে মেতে উঠল তামাম দুনিয়ার বাঙ্গালী! আনন্দে মেতে উঠল ঘর ভাঙ্গা
খেলার সফল কুশীলবেরা! আনন্দে মেতে উঠল সম্প্রদায়গত বিরোধ সৃষ্টির কারিগররা! আর বাংলা
ও বাঙ্গালীদের চিরকালীন বিচ্ছেদের সীলমোহর পড়ে গেল দুনিয়ার বুকে!!!! শক্তিহীন হ’ল
উভয় বাংলা তথা বাঙ্গালী! বাঙ্গালী! বাঙ্গালী! বাংলা আর বাঙ্গালীর এ -FOREVER GREAT LOSS!
No comments:
Post a Comment