Powered By Blogger

Sunday, November 17, 2013

বোধের ঘরের বন্ধ জানালা........

 অষ্টমীর রাতে একটা T.V channel-এ বৈঠকি আড্ডাই শুনছিলাম রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা ঈশ্বর বিষয়ক আলোচনায় তিনি এক জায়গায় বলছেন, ব্রহ্মা খোশামুদি, তেল খাওয়া পছন্দ করতেন। কেউ একটু খোশামুদি করলেই তাকে বর দিয়ে বসতেন। মহিষাসুর তাকে খুব তেল দিয়ে তোয়াজ ক’রে অমরত্ব প্রার্থনা করল। তখন ব্রহ্মা বলল, অমরত্ব দান করার ক্ষমতা আমার নেই। ওটা নারায়ণের ব্যাপার। অমরত্ব লাভের জন্য তোমায় নারায়ণের কাছে যেতে হবে। আমার এক্তিয়ারে যতটুকু ক্ষমতা আছে তা’ আমি তোমায় দিতে পারি। ব্রহ্মা তার এক্তিয়ারে বরাদ্দ ক্ষমতা সমস্ত উজাড় ক’রে দিলেন মহিষাসুরের জন্য। কিন্তু দিয়ে বললেন, তোমায় অমরত্ব দিতে না পারলেও আমি তোমায় বর দিলাম, তোমায় কোন পুরুষ মারতে পারবে না। তাই মহিষাসুরকে বধ করতে মা দুর্গার আবির্ভাব এখানে রঞ্জনবাবুর বলা ব্রহ্মার তেল খাওয়া বা খোশামোদের প্রসঙ্গে The greatest phenomenon of the world Sri Sri Thakur Anukul Chandra-এর একটা কথা মনে পড়ে গেল। একবার এক ভদ্রলোক আশ্রমে বেড়াতে এসেছিলেন। কথায় কথায় তিনি ঠাকুরকে নিজের চাকরী সম্বন্ধে বললেন,‘আমি খোশামোদ করতে পারি না, তাই আমার উন্নতি হয়না’। রঞ্জনবাবুর কথামতো ভদ্রলোকের অফিসের বস ব্রহ্মার মত তেল বা খোশামোদ পছন্দ করেন। ভদ্রলোককে দৈত্য বা অসুরদের মত উন্নতি যদি করতে হয় তাহ’লে ব্রহ্মা রুপী অফিসের বসকে তেল দিতে হবে, খোশামোদ করতে হবে। যাইহোক ভদ্রলোকের প্রশ্নের উত্তরে শ্রী শ্রী ঠাকুর তাকে দরদ ভরে বুঝিয়ে বললেন, ‘খোশামোদ করতে যাবে কেন? তবে স্তুতি করতে হয়। প্রত্যেকের বাস্তব গুণগুলি দেখতে হয়, সেগুলির তারিফ করতে হয় তাতে নিজেরও উন্নতি হয় আর, প্রত্যেকের বৈশিষ্ট্য বুঝে মনোজ্ঞ ব্যবহারে সকলকে মুগ্ধ ক’রে তাদের হৃদয় জয় করতে হয়। তখন প্রয়োজন মত তাদের তুমি সংশোধনও করতে পার। আর, এইভাবে যদি চল, মানুষকে তুমি তোমার আদর্শে অনুপ্রানিত ক’রে তুলতে পারবে। এতে মানুষ সহজেই তোমাতে স্বার্থান্বিত হ’য়ে তোমার শ্রীবৃদ্ধির সহায়ক হবে। তুমি সম্মান ও খ্যাতিলাভ করবে, সুখী হবে, পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে সম্প্রীতি বেড়ে যাবে তোমার’
রঞ্জনবাবু দৈত্য বা অসুররাও এক একজন বড় সাধক। সাধনার মধ্যে দিয়ে তারা পিতা ব্রহ্মার বর লাভ করেছে, কেউ শিবের বর লাভ করেছে। রাবণ বা হিরণ্যকশিপু এবং আরও অন্যান্য অনেক বড় ক্ষমতাবান সাধকের উদাহরণ আছে। কিন্তু তাদের সাধনার মধ্যে দিয়ে ক্ষমতা অর্জনের লক্ষ্য বা কারণ ছিল আত্মস্বার্থ বা আত্মপ্রতিষ্টা। তাই, তাঁদের অর্জিত শক্তি বা ক্ষমতা জগতের অকল্যানের কারণ হ’য়ে ওঠে। আবার রাবণের সন্তান অসীম ক্ষমতাসম্পন্ন মেঘনাদ আর হিরণ্যকশিপুর সন্তান বিষ্ণুর পরম ভক্ত প্রহ্লাদ। অসাধারণ দুই ব্যাক্তিত্ব! এগুলি কি তেল বা খোশামোদের ফসল? তেল বা খোশামোদি ব্যাক্তিত্ব এমন অসাধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন চরিত্র হ’তে পারে না বা তাঁদের এমন সন্তান জন্মায় না। এটা জন্ম বিজ্ঞানে স্বীকৃত। আত্মস্বার্থ ও আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্যে  বা আত্মকেন্দ্রিকতা ও হীনমন্যতা থেকে সাধনা শুরু না হ’য়ে ব্রহ্মা বা শিবকে খুশি করবার মধ্যে দিয়ে যদি এদের সাধনা শুরু হ’ত তাহ’লে স্বয়ং বিষ্ণুকে রাম বা নরসিংহ রুপে কিম্বা দশ দিকের দশ অধিদেবতার সম্মিলিত রুপ মা দুর্গা-কে আসতে হ’ত না। রঞ্জনবাবু পিতা ব্রহ্মা জানতেন তাঁর এই সন্তান সাধনার মধ্যে দিয়ে অর্জিত ক্ষমতা লাভের পর অহং মত্ততায় পথ হারাবে একদিন। তাই ঐ পুরুষের হাতে মৃত্যু নেই বিধান! অমরত্ব লাভের বর প্রার্থনা এবং তা প্রদান এই দুইয়ের মধ্যে বর প্রার্থনাকারির সাধনায় সিদ্ধি লাভের পর বর প্রার্থনায় চালাকি এবং বর প্রদানকারীর অসম্ভব প্রার্থনা পুরণের ক্ষেত্রে বর প্রদানের প্রশ্নে অম্লান ভক্তির কাছে অসহায়তার ফলস্বরুপ এমন বিধান! রঞ্জনবাবু আপনি তো জানেন কলমের শক্তি তরবারির শক্তির চেয়েও ভয়ংকর। সেই কলমের শক্তির অধিকারী যারা  তারা (আপনিও তার মধ্যে একজন) একটা সাধনা বা প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে এই শক্তি অর্জন করেছেন। এছাড়া জন্মগত সংস্কার বা পুর্বপুরুষের রক্তধারা সাধনায় সিদ্ধিলাভের প্রধান উপায় ছিল এই শক্তির অধিকারীদের। তা’ রঞ্জনবাবু এই কলমের শক্তির অধিকারীদের কলম থেকে যা’ নির্গত হচ্ছে তা’ কি রাবণ বা হিরণ্যকশিপুদের জীবন থেকে নির্গত শক্তির সমতুল্য নয়? কলমের ভয়ংকর   নীল মূত্রপাতে কি সমাজ-সংসার ভেসে যাচ্ছে না? আর তা’ছাড়া আমার মত যারা সমাজের ফালতু তারা না দেবতাদের মতন না অসুরদের মত শক্তির অধিকারী। আমরা ত্রিশঙ্কুর মত যুগ যুগ ধরে ঝুলছি। না স্বর্গে যেতে পারছি, না মর্তে ফিরে আসতে পারছি। রঞ্জনবাবু, দৈত্যদের বা অসুরদের ট্র্যাক চেঞ্জ করার একটা মস্ত উপায় বা সুযোগ আছে। বৃত্তি-প্রবৃত্তিকে খুশি করার পরিবর্তে ইষ্টপ্রীত্যর্থে যদি সাধনা শুরু হয় তাহ’লে দস্যু রত্নাকর বাল্মীকিতে, দস্যু সল সেন্ট পল-এ রুপান্তরিত হয়। আর তাছাড়া রঞ্জনবাবু, পিতা হওয়ার সুবাদে এটা বুঝেছি যে, সন্তান যদি আমার কথা না শোনে তাহ’লে কি কষ্ট হয়। সেই কষ্ট থেকেই বুঝতে পারি, পিতা ব্রহ্মার কষ্ট কি পরিমানের। সম্ভবত সব পিতারই কম-বেশি এই অব্যক্ত চাপা কষ্টের অভিজ্ঞতা আছে। মহিষাসুরের মৃত্যুতে পিতা ব্রহ্মার হাত থাকলেও সন্তানের মৃত্যুতে পিতার কষ্ট হয়েছিল বইকি। এ-প্রসঙ্গে পরম প্রেমময় শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের একটা কথা মনে পড়ে গেল। ঠাকুর এক ভক্তের প্রশ্নের উত্তরে বললেন, “দুঃখ পাই প্রবৃত্তিমুখী হ’য়ে। আশু যদি আপনার কথা না শুনে নিজের খেয়ালে চ’লে দুঃখ ভোগে, সেখানে কি আপনি ঠেকাতে পারেন? আপনি তো চান না যে সে বেচাল চলনে চ’লে দুঃখ পায়, কিন্তু কথা যদি না শোনে কীই বা আপনি করতে পারেন? হয়তো শাসন করতে পারেন, কিন্তু শাসন করলেও যদি না শোনে”? তাই ঐ বৈঠকি আড্ডা শুনতে শুনতে ভাবছিলাম, পূর্ণতার শরণে দেখার ঝাপসা দৃষ্টি স্বছ হ’য়ে যায়। বোধের ঘরের বন্ধ জানালাগুলি খুলে যায়।          
   



No comments:

Post a Comment