শিক্ষা ও শিক্ষিতের
প্রতিফলন বা পরিচয় কি সেটা ভাবতে বসে সব ওলটপালট হ’য়ে গেল। আইনের বেড়াজালে সরকার
বাধা পড়েছে। প্রফেসর মহাপাত্র তাঁর তৈরি মুখ্যমন্ত্রীর ব্যাঙ্গ চিত্র কাণ্ডের জেরে
তাঁকে পুলিশি হেনস্থার অভিযোগে সরকারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। প্রফেসর অম্বিকা মহাপাত্রের উদ্যোগ প্রশংসনীয়। তিনি রাজ্যবাসীকে
সরকারের প্রতিহিংসা এবং পুলিশি অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচাতে এই পদক্ষেপ গ্রহণ
করেছেন। কিন্তু ঠিক-বেঠিক, শ্লীল-অশ্লীল প্রশ্নে আবার সব ঘেঁটে ঘ হ’য়ে গেল। খবরের
কাগজে নানান কার্টুনিষ্টদের কার্টুন বেরতো আর তা’ দেখবার জন্য মুখিয়ে থাকতাম, কখন
সকাল হবে। সেসব বড় মজার। কিন্তু কখনও আজকের মত দেখিনি। বাক স্বাধীনতার কি কোনও
বর্ডার লাইন আছে কিম্বা থাকা উচিত? বাক স্বাধীনতার জন্য যদি কেউ আহত হয় বা অপমান
বোধ করে তাহ’লে কি সেই বাক স্বাধীনতা গ্রহণযোগ্য? না-কি বাক স্বাধীনতা ওসব
মান-অপমান, হত-আহত, ঠিক-বেঠিক, শ্লীল-অশ্লীল ধার ধারে না, মানে না? বাক স্বাধীনতার
উদরপুর্তি হ’লেই হ’ল? স্বাধীনতা মানে কি উচ্ছৃঙ্খলতা? না-কি স্বাধীনতা মানে অবাধ
ভাল করা বা করতে পারা? পরিচালক ঋতুপর্ন ঘোষ-কে দেখেছিলাম তাঁকে নিয়ে মীরের
মিমিক্রি বা ভাঁড়ামিতে আহত হ’তে। কেউ যদি আহত হয় বা অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে তাহ’লেও
তা’ বাক স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে বা আওতায় এনে কারোর আহত হওয়া বা অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ
করাকে খারিজ করা হবে? অন্যের গায়ে আঁচ লাগে লাগুক, আমার গায়ে আঁচ না লাগে ফুরিয়ে
যাবে মামলা, ব্যাপারটা এ-রকম? আর আঁচ লাগলেই তা’ স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ? প্রতিহিংসা
বা অত্যাচার? বাক স্বাধীনতার নমুনা আগেও দেখেছি এখনও দেখছি। ব্যাঙ্গ ছবি বা উক্তি
কিম্বা যৌনতা বা ধর্ষণ সম্পর্কিত প্রশ্নে প্রতীকের ব্যবহার দেখেছি। দেখেছি
সাহিত্যে ও শিল্পে ভাবধারা প্রকাশের জন্য কিম্বা মনের কোন বিশেষ ভাব প্রকাশ করার
জন্য লেখক, শিল্পী, পরিচালকদের প্রতিকের ব্যবহার। বুদ্ধিদীপ্ত, রুচিশীল ও
মার্জিত পরিবেশন। আর এখন চরম বাক স্বাধীনতার নমুনা আকছার দেখছি। দেখছি
শিল্পীর আঁকা ছবিতে, পরিচালকের তৈরী সিনেমায়, কবির কবিতায়,গানে ইত্যাদিতে। সম্প্রতি
বাংলা ছবি ‘প্রলয়’-এ বাক স্বাধীনতার নামে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নন স্টপ খোলাখুলি
কাঁচা কাঁচা গালাগালি এখন প্রকৃত বাক স্বাধীনতার সংস্কৃতি? বহু মানুষের ভক্তির
জায়গা, বিশ্বাসের জায়গা, শ্রদ্ধার জায়গা, ভালবাসার জায়গা-কে শিল্পীর ইরোটিক শিল্প
ভাবনার একক বাক স্বাধীনতার অধিকারে বা অজুহাতে উলঙ্গ করা, লাঞ্ছিত করা,
অপমান-অসম্মান করা, পদদলিত করার নাম বাক স্বাধীনতা!!! তাহ’লে সি, বি, আই অধিকর্তার
সাম্প্রতিক মুখ ফস্কে বেরিয়ে আসা মন্তব্য ‘প্রতিরোধ করতে না পারলে ধর্ষণ উপভোগ
করুন’ বাক স্বাধীনতার মধ্যেই পড়ে!! এ-ব্যাপারে কি বলেন বাক স্বাধীনতা ও মানবতার
পুজারী অম্বিকা মহাপাত্ররা? তাহ’লে চারিদিকে এত ‘গেল, গেল’ রব কেন? তবুও সি, বি,
আই অধিকর্তা তাঁর ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছেন। যদিও তাঁর এ-ধরণের
মন্তব্যের পিছনে আসল কারণটা বা চাপা পড়া রাগটা স্পষ্ট ছিল।
তাহ’লে কি বাক স্বাধীনতার প্রকৃত রুপ এখন এটাই আর
এটাই এখন সভ্যতা? এটাই সংস্কৃতি? এই সভ্যতায় আঁচ পড়লেই স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ,
প্রতিহিংসা বা অত্যাচার বলে বিবেচিত হবে? স্বাধীনতা ‘গেল, গেল’ বলে আওয়াজ উঠবে?
সত্যমিথ্যা, আসল-নকল, আলো-অন্ধকার, দোষী-নির্দোষ, সাধু-শয়তান সব একাকার, ডালে-চালে
মিশে খিচুড়ি হ’য়ে যাবে? সব কিছুর পিছনে একটা অভিপ্রায় বা উদ্দেশ্য থাকে। সেই
অভিপ্রায় বা উদ্দেশ্যই কি বাক স্বাধীনতা রক্ষা বা লঙ্ঘন-এর বিচারের মাপকাঠি হওয়া উচিত?
কুট্টিরা কি এখন ব্রাত্য? শিক্ষার অঙ্গন কি এখন বাক স্বাধীনতার দাবীতে হরিহরের গোয়ালঘর?
যেখান থেকে শ্রদ্ধা মা অন্নপূর্ণার মত গৃহহীন হ’য়ে রাস্তায় এসে দাড়িয়েছে! রাজ্যবাসী-কে
এই অশ্রদ্ধা চাষের হাত থেকে কে বাঁচাবে?
No comments:
Post a Comment