এই অসহযোগীতা আন্দোলনের সুদূরপ্রসারী ভয়ংকর ক্ষতি সম্পর্কে অনেক আগেই সেই স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে সাবধান ক'রে দিয়ে গেছিলেন দ্রষ্টাপুরুষ জীবন্ত ঈশ্বর শ্রীশ্রীঠাকুর। তারপর দেশ যখন স্বাধীন হ'লো সেই স্বাধীনতা এলো অসহযোগীতার থিয়োরির হাত ধ'রে। যে অসহযোগীতার থিয়োরির বীজ বপন হ'য়েছিল ব্রিটিশের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ শাসনকে উৎখাত করার মোক্ষম আন্দোলন হিসেবে, সেই থিয়োরিই প্রয়োগ হ'লো দেশ ভাগের মধ্যে দিয়ে। দেশকে অখন্ড অটূট রাখার জন্য দেশের দুই বৃহৎ সম্প্রদায় কেউ কাউকে মিলেমিশে থাকার জন্য উদারতার হাত বাড়িয়ে সহযোগিতা করলো না। দুই সম্প্রদায়ের উচ্চ নেতৃবৃন্দ অসহযোগীতার মোক্ষম দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন বিশ্বের কাছে দেশকে দু'টুকরো ক'রে দিয়ে। আর চুপ ক'রে তা হজম করতে হয়েছিল অসহায় জড় বৃদ্ধের মতন অসহযোগিতার জনক মহান আত্মা গান্ধীজীকে।
সেদিন বৃটিশ শাসক পিছন থেকে গুপ্ত ঘাতকের মতন দুই বৃহৎ সম্প্রদায়ের মধ্যে অসহযোগিতার আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে দেশকে এক বিকৃত রূপ দিয়ে নির্ম্মমভাবে দুই খন্ডে ভাগ ক'রে দিয়েছিল। সেদিন মহান আত্মা গান্ধীজী নিশ্চয়ই চোখের জলে স্মরণ করেছিলেন বিস্ময়ের বিস্ময় সর্বশ্রেষ্ঠ বিস্ময় শ্রীশ্রীঠাকুরের দেশনেতাদের উদ্দশ্যে পাঠানো দেশভাগ রোখার কাতর আহবান। স্মরণ করেছিলেন সেদিন দেশ নেতৃবৃন্দের কাছে শ্রীশ্রীঠাকুরের পাঠানো চিঠির সেই ভবিষ্যৎ বার্তাঃ শ্রীশ্রীঠাকুর লিখেছিলেন, "Dividing compromise is the hatch of animosity."
শ্রীশ্রীঠাকুর উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় কাতর হ'য়ে আকুল স্বরে সমস্ত মানুষকে ডেকে ডেকে বলেছিলেন, দেশনেতাদের কাছে বারেবারে লোক পাঠিয়ে বলেছিলেন, "দেশভাগ ক'রে সমস্যা সমাধানের অর্থ হ'লো 'তা' দিয়ে শত্রুতার ডিম ফোটানো।" সেদিন তিনি অশ্রুসজল চোখে ক্রন্দনরত কন্ঠে বলেছিলেন, "আজকের এই অসহযোগিতার বিষ বাস্প একদিন ধীরে ধীরে মানুষের রান্নাঘরে ঢুকে যাবে।" আজ আমরা দেখতে পেলাম তাঁর কথা কতটা নির্ম্মম সত্য, ভয়ঙ্কর সত্য! আজ দেশ স্বাধীন হওয়ার সময় থেকে ৭৫বছর ধ'রে তিন টুকরো হওয়া ভারতবর্ষের আকাশে বাতাসে অসহযোগিতার আগুন দাউ দাউ ক'রে জ্বলছে, ছড়িয়ে পড়ছে ক্রমশ তার বিষ বাস্প। তিন দেশের দুই সম্প্রদায়ের কারও ক্ষমতা নেই সেই আগুন নেভায়।
কিন্তু সেদিন কেউ শোনেনি ঠাকুরের কথা। একজন সাধারণ ধর্মগুরুর তকমা সেঁটে দিয়ে তাঁকে একঘরে ক'রে রেখে দিয়েছিল সেদিনের দেশপ্রেমিকরা। প্রায় সমস্ত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ তাঁর দর্শন লাভের জন্য তাঁর কাছে এসেছিলেন, দেখা করেছিলেন, কথা বলেছিলেন কিন্তু তথাপি তাঁরা মনে করেননি যে শ্রীশ্রীঠাকুর শুধু একজন সাধারণ তথাকথিত ধর্মগুরু নন, তিনি একজন সর্বজ্ঞ দ্রষ্টাপুরুষ! দেশ স্বাধীনতার সঙ্গে জড়িত সমস্ত বিষয়ে যে তাঁর মূল্যবান পরামর্শের প্রয়োজন আছে সেকথা দেশনেতৃবৃন্দ আমল দেননি, গুরুত্ব দিয়ে ভেবে দেখার প্রয়োজন মনে করেনি, এককথায় বলা যেতে পারে, পাত্তায় দেননি। ইগো ছিল তাঁদের ভয়ঙ্কর! শ্রীশ্রীঠাকুরের মতো মহান বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব ( Greatest phenomenon of the world) ভারতের মাটিতে থাকতে দেশ ভুলভাবে স্বাধীনতা লাভ করেছিল, স্বাধীন হয়েছিল অঙ্গছেদের মধ্যে দিয়ে! ফল যা হবার তাই হয়েছে।
সেদিন ঠাকুরের নিজের থেকে যেচে স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে নিজস্ব মতামত ও দেশভাগের বিরুদ্ধে আবেদনের প্রতি কর্ণপাত করার প্রয়োজন মনে করেনি সেদিনের দেশনেতৃবৃন্দ। যদি দেশবন্ধু বেঁচে থাকতেন, যদি নেতাজী থাকতেন হয়তো কিছু একটা হ'লেও হ'তে পারতো সেদিন। অন্তত ভাঙার আগে একবার প্রতিরোধ আসতো। আরো একবার প্রচন্ড ধাক্কা খেত চতুর বৃটিশ প্রশাসন ও বিভেদকামীর দল। আরো একবার প্রকৃত স্বাধীনতার আন্দোলন দানা বাঁধতো। কিন্তু দুর্ভাগ্য দুর্বল ভারতবাসীর তা হ'লো না। সেদিন গান্ধীজী নিশ্চয়ই একলা ঘরের কোণে বসে চোখের জলে নেতাজীর কথা, দেশবন্ধুর কথা স্মরণ করেছিলেন। স্মরণ করেছিলেন শ্রীশ্রীঠাকুরের চিঠির বয়ান। নেতাজী, দেশবন্ধু থাকলে হয়তো গান্ধীজী নোতুন ক'রে আরও একবার উঠে দাঁড়াতেন তাঁদের বলিষ্ঠ হাত ধ'রে প্রকৃত অহিংস আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের দৃষ্টিভঙ্গিতে। কিন্তু তা হওয়ার নয়, দেশবন্ধু প্রথমে মারা গেলেন, পরে নেতাজী গেলেন অজানার বুকে হারিয়ে, মৃত্যু এসে কেড়ে নিয়ে গেল গান্ধীজীর প্রাণ, একলা নিঃসঙ্গ হ'য়ে পড়লেন পন্ডিত নেহরু, দেশ টুকরো টুকরো হ'য়ে গেল। আর ফল্গুধারার মতো তলে তলে ব'য়ে যেতে লাগলো অসহযোগিতার বিষাক্ত তত্ত্বের ধারা।
এমনিভাবেই দ্রষ্টাপুরুষ শ্রীশ্রীঠাকুর জানতেন তাঁর অবর্তমানেও কি হ'তে পারে, কি হ'তে চলেছে তাঁর নিজের হাতে তৈরী বড় সাধের, বড় স্বপ্নের 'সৎসঙ্গ' সংগঠনে। চোখের সামনে দেখতে পেতেন তিনি ভবিষ্যৎ। তিনি ঈশ্বর, তিনি সৃষ্টিকর্তা। তাঁর সমগ্র সৃষ্টির ভবিষ্যৎ, তাঁর সৃষ্ট সংগঠন সৎসঙ্গ-এর ভবিষ্যৎ-ও যে তিন টুকরো হ'য়ে যাবে অসহযোগিতার তত্ত্বের হাত ধ'রে তা তিনি জানতেন। আরও টুকরো টুকরো হ'য়ে যাবার হাত থেকে, বর্তমান 'সৎসঙ্গ'-এর ধী ধুরন্দর শক্তিশালী ষড়যন্ত্রকারীদের হাত থেকে 'সৎসঙ্গ'-কে বাঁচাবার জন্য তিনি তাঁর সংগঠনের দায়িত্ব তুলে দিয়ে গিয়েছিলেন পরম ভরসাস্থল, কঠোর কোমল প্রচন্ড অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী, দর্শনে কঠিন অন্তরে প্রেম ভালোবাসার ফল্গুধারার অধীশ্বর তাঁর জেষ্ঠ্যাত্মজ পরম আদরের বড়খোকা শ্রীশ্রীবড়দার বলিষ্ঠ হাতে। তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত ছিলেন যে তাঁর আদরের বড়খোকার কাছে সবাই সমান। আপনপর, ছোটোবড় ব'লে কেউ নেই। নিরাশিনির্ম্মম ভাবে ঠাকুরকে, ঠাকুরের দর্শনকে, ঠাকুরের মিশনকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, এগিয়ে নিয়ে যাবে ঠাকুরের স্বপ্নকে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সময়ানুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে। যা ঝ'রে যাবার তা ঝ'রে যাবে।
আর তাই-ই হয়েছে। শ্রীশ্রীবড়দার সুযোগ্য নেতৃত্বে শ্রীশ্রীঠাকুরের 'সৎসঙ্গ' প্রবল ভয়ংকর ঝড়ঝাপ্টাকে অতিক্রম ক'রে এগিয়ে গেছে সামনের দিকে শ্রীশ্রীঠাকুরের "এক আদেশে চলে যারা তাদের নিয়ে সমাজ গড়া" বাণীকে সামনে রেখে বাস্তবায়িত করার মধ্যে দিয়ে। আর সেই ট্র্যাডিশন ব'য়ে চলেছিল সমানে মহাপুরুষ শ্রীশ্রীদাদার বলিষ্ঠ হাত ধ'রে সুনিপুন নেতৃত্বে।
আজ সেই পবিত্র ব্যাটন বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি সৎসঙ্গীদের অভিভাবক ভালোবাসার আধার শ্রীশ্রীঠাকুরের চলনপূজার পূজারী আচরণসিদ্ধ মহান পুরুষ আচার্যদেব শ্রীশ্রীবাবাইদাদার পবিত্র হাতে। 'সৎসঙ্গ' প্রতিষ্ঠান নিরাপদ, সৎসঙ্গীরা আজ নিশ্চিন্ত। নিশ্চিন্ত, নিরাপদ আগামী প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাঁতে অচ্যুত-আনতি-সম্পন্ন, ছন্দানুবর্তী, জীবন-বৃদ্ধির আচরণ-সিদ্ধ তঁদ্ বংশধর ইষ্ট-প্রতীকস্বরূপ শ্রীশ্রীআচার্যদেবের উপস্থিতিতে।
তাই আচার্য প্রথা ও আচার্য পরম্পরা আর দ্বিধাহীন চিত্তে আচার্য অনুসরণ যদি না থাকতো আজ দিকেদিকে মহাশক্তিধর নন্দীভৃঙ্গীর দল শিববিহীন 'শিবঠাকুরের দেশে আইনকানুন সর্বনেশে' ক'রে ছাড়তো। শয়তানের শিং-এ খন্ড বিখন্ড হ'য়ে যেত আজকের বি-শা-ল প্রতিষ্ঠান সৎসঙ্গ।
(লেখা ১৮ই জানুয়ারী'২০২৩)
No comments:
Post a Comment