পুজোর দিনগুলিতে কয়েকজন ফোনে ও সাক্ষাতে জানতে চেয়েছিলেন 'হিন্দমোটরঃ একটি স্বপ্নের মৃত্যু' ধারাবাহিক লেখার পরবর্তী অংশ কবে Post করব আমার FB-এ বা prakashbiswas's blog-এ। সময়ের অভাবে লেখা হ'য়ে উঠছিল না। 'হিন্দমোটরঃ একটি স্বপ্নের মৃত্যু'-৫' পর্যন্ত লিখে post ক'রেছিলাম। তারপর আর হয়নি। বন্ধুদের কথা দিয়েছিলাম পুজোর পরেই লেখা Post করার। তাই আজ 'হিন্দমোটরঃ একটি স্বপ্নের মৃত্যু-৬' Post করলাম।
পূজো শেষ। বাঙালী আনন্দে মেতেছিল এই কটা দিন। এবার বৃষ্টি বিগত বছর গুলির মত নিষ্টুর হানা দেয়নি তেমন বাংলার বুকে। শেষ হ'ল আর এক আনন্দের বড় উৎসব ঈদ। তারপর ঘরে ঘরে হ'য়ে গেল মা লক্ষীর আরাধনা। একের পর এক আনন্দের রথ চলা শুরু হ'য়ে শেষের যবনিকা টেনে চলেছে স্বাভাবিক নিয়মে। সামনে আসছে ধনতেরাস, কালীপুজো, ভ্রাতৃদ্বিতীয়া, ছটপুজা, তারপর জগদ্ধাত্রী, এরপরে মহরম! বাংলার বুকে একে একে আসবে আনন্দের উৎসব, তারপর শেষও হ'য়ে যাবে। চক্রাকারে ঋতু পরিবর্তনের মত ঘুরে যাবে একে একে আনন্দের রথ। শুরু হ'য়ে শেষ আবার শেষ থেকে হ'বে শুরু। কিন্তু যে দুঃখ শ্রমিকের জীবনে নেবে এসেছিল, শুরু হয়েছিল ঘরে ঘরে আধপেটা খেয়ে বেঁচে থাকা তার শুরু আছে কিন্তু নেই শেষ এই বাংলার বুকে! এই বাংলার আনন্দের দিনে কতজনই বা খবর রেখেছিল তাদের জীবনের, তাদের ঘরের দুঃসহ যন্ত্রণার মধ্যে বেঁচে থাকা জীবনগুলোর? সংখ্যাটা এত নগন্য যে বলতে হয় কেউ রাখে না। আর এটাই সত্যি। হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ মানুষের ঢল নেবেছিল গ্রামে, শহরে, শহরতলীর পথে পথে আনন্দের দিনগুলিতে! আলোয় আলোময় হ'য়ে গিয়েছিল চারপাশ। আবার হ'য়ে যাবে বাড়িঘর, পথঘাট, সারা শহর সামনের দীপাবলি, কালীপূজো ও জগদ্ধাত্রী পুজোর দিনগুলিতে, কিন্তু অন্ধকারে ঢাকা পড়েছিল ও পড়ে থাকবে বন্ধ হ'য়ে যাওয়া বাংলার বুকে কারখানাগুলির শ্রমিকের ঘর!!!!! এটাই নির্মম সত্য 'আমার গায়ে আঁচ না লাগে ফুরিয়ে যাবে মামলা'! যদি কিছু আঁচ লেগে থাকে বা আলো পড়ে থাকে তা' সবই লোক দেখানো কথার 'হাই'। তেমনই একটি কারখানা 'হিন্দুস্তান মোটরস'। আজও গভীর অন্ধকারে ডুবে রয়েছে কারখানা ও কারখানার কয়েক হাজার শ্রমিক ও শ্রমিক পরিবারের আধপেটা খেতে পাওয়া মানুষ!!!!!!!!!!!!!!!!!!
বিশাল টাইটানিক জাহাজ, গাড়ি তৈরীর একমাত্র স্বয়ংসম্পুর্ন (ম্যানুফ্যাকচারিং ও অ্যাসেম্বলী প্ল্যান্ট) কারখানা হিন্দমোটরের বিশাল ডেকে সম্পুর্ণ একা নিঃসঙ্গ যাত্রী, স্বাধীন মালিকানার অহংকারে অন্ধ ও যৌবনের উন্মাদনায় উন্মত্ত ও বহিরাগত পরামর্শদাতার প্রেমে মত্ত যুবক সি কে বিড়লার নেতৃত্বে ধীরে ধীরে ঘনিয়ে এলো কারখানার আকাশে ধ্বংসের ঘন কালো মেঘ! শঙ্করনারায়নন ও সান্থারাম নির্ভরতা এবং ম্যাকিন্সে প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া যুবক সি কে বিড়লা তখন ভুলে গেছে এই কারখানার প্রাণপুরুষ মালী প্রবীন এস এল ভাট্টারকে! ভুলে গেছে, যার হাত ধরে একদিন ঘুরে বেড়িয়েছিল বালক চন্দ্রকান্ত এই বিশাল টাইটানিক জাহাজের ডেকে ডেকে, সেই প্রবীণ অভিজ্ঞ পরম নির্ভর হাতের স্পর্শ! পরকীয়ার প্রেমে মজে থাকার মত মন প্রাণ তখন শয়নে স্বপনে শুধু শঙ্কর, সান্থারাম আর ম্যাকিন্সে চায়!
ম্যাকিন্সে কনসালটেন্সির ‘হিন্দুস্তান মোটর হবে গাড়ি তৈরির শুধুমাত্র অ্যাসেম্বলি প্ল্যান্ট’ এই পরামর্শ অনুযায়ী ম্যানেজিং ডিরেক্টার আর সান্থারামের নেতৃত্বে গাড়ী তৈরীর বিভিন্ন যন্ত্রাংশ আমদানি হওয়ার ফলে ধীরে ধীরে বন্ধ হ’য়ে যেতে লাগলো বিভিন্ন বহু ছোট বড় ডিপার্টমেন্ট! বিশাল মেশিন শপে অকেজো হ’য়ে পড়তে লাগলো একে একে সমস্ত যন্ত্রাংশ তৈরীর দামি দামি মেশিন! বিশাল ফাউন্ডি, ফোর্জ প্ল্যান্ট পড়ল মুখ থুবড়ে! প্রেস শপ, প্লেটিং শপ হ’য়ে গেল অকেজো। পরিস্থিতি যেদিকে যেতে লাগলো তা’তে পরিষ্কার বোঝা গেল ম্যাকিন্সে কনসালটেন্সির ‘অ্যাসেম্বলি প্ল্যান্ট’ এর তত্ত্ব অনুযায়ী হিন্দমোটর কারখানায় ২৫০০ হাজারের বেশী শ্রমিক-কর্মচারী লাগবে না। শ্রমিকের কাছে বাঁচার অক্সিজেন কারাখানায় নবাগত আধুনিক ম্যানেজমেন্টের রুপকার শঙ্করনারায়নন ও আর সান্তারাম-এর যৌথ অভিযান শ্রমিককে তাদের আসল রুপের সন্ধান দিল! মুখ আর মুখোসের মাঝখানের পর্দা উন্মোচিত হ’ল অবশেষে! বর্তমান আধুনিক ম্যানেজমেন্টের যুগে কারখানার পুরোন মানসিকতাসম্পন্ন প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট এস এল ভাট্টার না-কি অচল! তাঁকে সরিয়ে যারা এসেছিলেন কারখানাকে প্রতিযোগীতার বাজারে টিকিয়ে রাখার জন্য আধুনিক ম্যানেজমেন্টের রুপকার হ’য়ে, শ্রমিক-কর্মচারীকে ও তাদের পরিবারকে অক্সিজেন যোগাবার জন্য যারা এসেছিলেন মসীহা হ’য়ে তারাই ধীরে ধীরে আস্তিনে লুকিয়ে রাখা তাদের সেই বিষাক্ত বাঘনখ বের ক’রে আচম্বিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন শ্রমিক-কর্মচারীর ঘাড়ের ওপর অতি সন্তর্পনে চুপি চুপি পা টিপে টিপে আসা Stalker-এর মত। কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই শ্রমিক দেখলো মসীহা আর সান্তারামের ম্যানেজমেন্ট ১৯৯৮ সালে সংবাদপত্রে বিবৃতি দিয়ে জানিয়ে দিলেন কারখানাকে প্রতিযোগীতার বাজারে টিকিয়ে রেখে কারখানাকে বাঁচাতে হ’লে কারখানার ওপর থেকে বাড়তি শ্রমিকের বোঝা কমাতে হবে। প্রায় ১২০০০ হাজার শ্রমিকের মধ্যে ৮,০০০-এ নাবিয়ে আনতে হবে সংখ্যাটা। কারখানার এই আক্রমণাত্মক মানসিকতার জন্য কারখানার সমস্ত ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ কারখানা জুড়ে আন্দোলনের ভঙ্গিতে লড়াইয়ের মুখ ঘুরিয়ে দিলেন কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের বিশ্বায়নের নীতির দিকে। হিন্দমোটরের এই পরিস্থিতির দায় কেন্দ্রের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে শ্রমিক-কর্মচারীর কাছে তুলে ধরলেন, কেন্দ্রের উদারনীতির জন্যই না-কি বিদেশি কোম্পানীগুলি ভারতের বাজার দখল ক’রে নিচ্ছে আর তাই হিন্দমোটরের বস্তাপচা পুরোন মডেলের গাড়ি বাজারে বিক্রি হচ্ছে না! আর সান্তারামের ম্যানেজমেন্টের সংবাদপত্রে দেওয়া সেই বিবৃতিকে সমর্থন ক’রে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্য সংবাদপত্রে বলেন, “দশ বারো হাজার শ্রমিক-কর্মচারী নিয়ে কারখানা চালানোর সময় এখন আর নেই”। সঙ্গে সঙ্গে এই পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করার জন্য এগিয়ে এলেন সিআইটিইউর তৎকালীন সর্বভারতীয় সভাপতি চিত্তব্রত মজুমদার। তিনিও কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের উদারনীতির সমালোচনা ক’রে সিআইটিইউ-র এক সভায় বলেন, গাড়ীর বাজারে হিন্দমোটরের দিন শেষ। আর কারখানা জুড়ে প্রচারিত শ্রমিকদের কাছে অরণ্যদেব ও কোম্পানীর মসীহা আর সান্তারাম এই সর্বনাশা পরিস্থিতির ব্যাখ্যায় শ্রমিকদের কাছে মুখ্যমন্ত্রী তথা সমস্ত ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের সুরেই কেন্দ্রের উদারনীতির সমালোচনা ক’রে বোঝালেন, এই নীতির কারনেই হিন্দমোটরের গাড়ি বাজারে টিকে থাকতে পারছে না।
অতএব এ হেন সুচতুরভাবে পুর্বপরিকল্পিত ছকে তৈরী পরিস্থিতিতে কোম্পানীর মসীহা, শ্রমিক-কর্মচারীর কাছে অরণ্যদেব হিসাবে আবির্ভূত আর সান্তারাম শ্রমিকদের কাছে পরিত্রাতা রুপে হাজির হ’য়ে শ্রমিক ছাঁটাই-এর মত অমানবিক পদক্ষেপের পরিবর্তে মন্দের ভালো VRS প্রকারান্তে FRS(Forcefully Retirement Scheme)-এর তোফা নিয়ে হাজির হ’লেন। আর ঠিক এই সময় কোম্পানীর আকাশে কোম্পানী বাঁচাও, শ্রমিক বাঁচাও এর স্বপ্নে ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ স্লোগান তুলে আবির্ভূত হ’ল সমস্ত শ্রমিক সংগঠনের বিক্ষুব্ধ ও বহিরাগত শ্রমিক নেতৃত্ব! শুরু হ’ল শ্রমিক বাঁচানোর নতুন আন্দোলনের নাটকের নতুন পান্ডুলিপি লিখন! ততদিনে কারখানা ধ্বংসের কফিনে পেরেক পুঁতে দিয়েছেন কোম্পানীর মসীহা শঙ্করনারায়নন ও আর সান্তারাম!
কি ছিল সেই নতুন আন্দোলনের নাটক? সেই আলোচনায় যাবার আগে একবার পিছন ফিরে দেখে নিই কারখানা ধ্বংসের কফিনে পেরেক পোঁতার কি ছিল সেই পরিকল্পনা?
No comments:
Post a Comment