Powered By Blogger

Sunday, February 5, 2023

উপলব্ধিঃ ১৭ অবশেষে............।

ভাষার একটা নিজস্ব গতিময়তা আছে, আর গতিময়তা অনুযায়ী ভাষা গ্রহণযোগ্য হ’য়ে ওঠে ও বিস্তার লাভ করে। ভাষা যদি যে কোনও কারণে তার চলমান গতিময়তা হারায় তাহ'লে তা' হিমঘরে চ'লে যেতে পারে কিন্তু তাই ব'লে তার মৃত্যু হয় না। প্রয়োজনবোধে আবার হিমঘর থেকে বেরিয়ে আসে। যদি মনে ভয় হয় ভারতীয় বাংলার প্রভাবে বাংলাদেশের বাংলা বিলুপ্ত হবে তাহ'লে বলতে হয় এসব হয় বেকুবি কথা আর নাহয় ঘৃণ্য দেশভাগের মত উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই ভাষা ভাগাভাগির ঘৃণ্য এক সংকীর্ণ মনের খেলা। কথায় আছে যেমন ভাগের মা গঙ্গা পায় না তেমনি এই ভাষা ভাগাভাগির ঘৃণ্য খেলার সুর উত্থাপনে কাজ সিদ্ধ হবে না। যদি হিম্মত থাকে, একান্তই এক ভাষা এক প্রাণ বোধ থাকে তাহ'লে ভাষাকে সামনে রেখে বাংলা ভাষাভাষীর বিশাল অঞ্চল জুড়ে গড়ে তুলুন বৃহত্তর বাংলা। দুই বাংলার শহুরে বা গ্রাম্য বা প্রত্যন্ত অঞ্চলের সমস্ত মানুষের সাথে মানুষের একটা ভাষাগত সম্পর্ক আছে এবং এটা পৃথিবীর বহু মানুষের সঙ্গে মানুষের ক্ষেত্রেও একইরকম এবং এর একটা উৎসও আছে। আমাদের এই ভাষা ভাগাভাগির খেলার পরিবর্তে উৎস খোঁজার গবেষণায় নিমগ্ন থাকার নেশা যদি থাকে বিদ্ধজনদের মনে তাহ'লে বাংলা এক ভাষা এক প্রাণ হ'তে পারে। এমনিতেই বাঙ্গালী আজ আর বাঙ্গালী ব'লে পরিচিত নয়। আজ হিন্দু আর মুসলমান ব'লে পরিচিতি লাভ ক'রে ফেলেছে বাঙালি। বাঙালি সত্ত্বা দুইভাগে বিভক্ত হ'য়ে গেছে। হিন্দু বাঙালি, মুসলমান বাঙালিকে মুসলমান চোখে ও বোধে আর মুসলমান বাঙালি হিন্দু বাঙালিকে হিন্দু চোখে ও বোধে দেখে, বাঙালি চোখে ও বোধে দেখে না আর এতেই অভ্যস্থ হ'য়ে উঠছে নতুন প্রজন্ম আর ঠিক এইসময় আওয়াজ উঠছে ভারতীয় বাংলা আর বাংলাদেশের বাংলা প্রশ্নে। বাংলাদেশকে বাঙালির দেশ বলার থেকে মুসলমানদের দেশ ব'লে আখ্যা দেওয়ার জন্য চেষ্টা চলেছিল বা এখনও চলছে। ধর্ম নিরপেক্ষ বাংলাদেশের পরিবর্তে ইসলামিক বাংলাদেশ গড়ার প্রক্রিয়াও শুরু হ'য়েছিল এখনও ছাই চাপা আগুনের মত ধিকিধিকি জ্বলছে আর তক্ষুনি ছাইচাপা আগুনে ঘি ঢালার মত উঠে আসে ভারতীয় বাংলা আর বাংলাদেশী বাংলা তত্ত্ব। আর কত ভাগাভাগির খেলা চলবে কে জানে! দেশভাগের ঘৃণ্য চক্রান্ত আজ মানুষের মানসিকতাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে! ভারতীয় বাংলা নয় বাংলাদেশের নিজস্ব ঢঙের বাঙলা ভাষার চর্চা কেমন সেটা জানতে ইচ্ছে করে। বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ একই রকম ভাবে বাঙলা ভাষায় কথা বলে? বাঙলা ভাষা উচ্চারণে, কথন বা গঠন শৈলীতে কোনও তারতম্য বা তফাৎ নেই? আজ যদি ভারতের বাংলা আর বাংলাদেশের বাংলা ভাষার আলাদা অস্তিত্বের দাবী নিয়ে প্রশ্ন তোলেন বুদ্ধিজীবীরা তাহ'লে গ্রাম বাংলা ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাংলা উচ্চারণে, কথন বা গঠন শৈলীতে তফাতের কারণে সংখ্যাগতভাবে ঘরের ভিতর ঘর অর্থাৎ দ্বিতীয় ভাষার দাবিতে আবার আন্দোলন সংগঠিত হবে নাতো ভবিষ্যতে? ভারতীয় বাঙলা আর বাংলাদেশী বাংলা এই দাবির মধ্যে পরিস্কারভাবে বিরোধিতার প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে না কি!? এখানে বিরোধ কোথায়? বিরোধ কেন? সবাই তো সবার সাংস্কৃতিক আত্মীয়ের বন্ধনে আবদ্ধ। তাই নয় কি?
আরও অবাক লাগে যখন শুনি কেউ কেউ বলছেন বাংলাদেশের ভাষার উপর শান্তিনিকেতনি প্রমিত ভাষার আধিপত্যের অত্যাচারের কথা। কেন বলা হ'লো ঠিক বুঝলাম না। তাহ'লে রবীন্দ্রনাথের জাতীয় সঙ্গীত বাদ দিয়ে দিলেই তো পারে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের গ্রাম বাংলার বা প্রত্যন্ত অঞ্চলের ক্ষেত মজুরদের গ্রাম্য ভাষা দিয়েই হ'ক আর শহুরে ভাষা দিয়েই হ'ক নতুন ক'রে তো রচনা করা যেতে পারে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত? আর তার ফলে যাতে আবার বাংলাদেশের শহুরে বাঙলা দিয়ে বা গ্রাম্য বাঙলা দিয়ে ভবিষ্যতে আবার আজকের দিনের দাবিদারদের মত দাবী উঠতে পারে, তারও সম্ভাবনার জন্ম হ'ক। কোনোদিন দেখবো এই বাংলায় সেই আন্দোলনের জেরক্স কপি। হ'ক যা ইচ্ছা তাই হ'ক। দারুণ আইডিয়া!!!!!
কারও কারও মানসিকতার উত্তরে বলতে পারি, ভাষার বহুমাত্রিক চেহারা থাকতেই পারে তাই ব'লে কোনও ভাষার সঙ্গে কোনও ভাষার বিরোধ নেই। সংখ্যাধিক্যের কারণে বা শহুরে সভ্যতার বিকাশের ফলে বহু ব্যবহার, প্রচার ও প্রসারের জন্য কোনও ভাষা বিস্তার লাভ করতেই পারে তার অর্থ এই নয় ঐ ভাষা বিস্তার লাভ করতে করতে প্রত্যন্ত অঞ্চলে এসে যে গ্রামীণ রূপ নিচ্ছে তা ভাষা হিংসার কারণ হ'য়ে দাঁড়াবে!!!!!!!! এই সমস্ত ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক প্রসূত সংকীর্ণ চিন্তা ছাড়া আর কিছু নয়।। আমেরিকান ইংরেজি, ব্রিটীশ ইংরেজি, অষ্ট্রেলিয়ান ইংরেজি ইত্যাদি সবই ইংরেজি ভাষা হ'লেও ব্রিটিশ ইংরেজি দুনিয়া শাসন করেছিল তার নিজের মুন্সিয়ানায়। এখানে পছন্দ-অপছন্দ নিরর্থক ও সংকীর্ণ মনের অভিব্যক্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। সব ভাষায় মহান। তাই ভাষা সমস্যা কোনও সমস্যা নয়।
জানি না কি বলে এই সম্পর্কে বুদ্ধিজীবী রাজনীতিবিদরা। জানতেও ইচ্ছা করে না। তাদের কাছ থেকে জানার কিছু নেইও। শুধু এই উপলব্ধিতে এসে পৌঁছলাম পরমপ্রেমময় শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের হাত ধ'রে। তাঁকে প্রণাম ক'রে শুধু তাঁর কথা স্মরণ করলাম। শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন,
"আমার মনে হয়, পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকের প্রভাবে অমনতর (ভাষার রকমফের; সেই সময় বিভিন্ন স্থানে ভাষার রকমফের কেন হয়, এই প্রসঙ্গে আলোচনা চলছিল) হ'য়ে থাকে। একই জায়গায় আবার জীবিকা ও ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী একই পরিবেশে লালিত-পালিত একই পরিবারের বিভিন্ন লোকের ভাষার ভোলও একটু-একটু আলাদা হয়। ভাষা ও বাচন ভঙ্গিমা দেখে তাই মানুষটা কেমন তা' খানিকটা বোঝা যায়।"
ভাষার এই সামাজিক সমস্যা (Sociological problem of language ) নিয়েও শ্রীশ্রীঠাকুর বাণীতে বলেছেন,
"তাই, ভাষা সমস্যা
একটা বিশেষ সমস্যা নয়কো,
সমস্যা ঐ অন্তঃস্থ বোধ-বিভুতি ও ভাব অনুকম্পা
যা' ভাষাকে কম্পিত ক'রে
বা উদ্দীপ্ত ক'রে
ভাষায় ফুটন্ত হ'য়ে ওঠে;
ক্ষুদ্র-মস্তিষ্ক বাতুল ছাড়া
ভাষাকে কেউ হিংসা ক'রতে পারে?
বোধবেদনা,
ভাববৃত্তি--------
প্রকৃতিরই পরিস্রোতা উন্মেষ,
ভাষা-হিংসা মানেই-----
বিপর্য্যস্ত বিপর্য্যয়ে আত্মনিমজ্জিত করা।"
(লেখা ৬ই ফেব্রুয়ারী' ২০১৮)

No comments:

Post a Comment