শ্রীশ্রীআচার্যদেব যখন প্রার্থনার সময় বা প্রতিদিন নাটমন্দিরে আর্ত, অর্থার্থী, জ্ঞানী ও জিজ্ঞাসু হাজার হাজার মানুষের সামনে এসে বসেন তখন তাঁর পাশে এসে বসলাম কিংবা আচার্যদেবের সামনে লাইনে দাঁড়ানো উপস্থিত দর্শনার্থী ও আর্ত, জিজ্ঞাসু মানুষের ভিড়ে দাঁড়িয়ে লাইন কন্ট্রোল করা বা তাদের কাছ থেকে তাদের সমস্যা বা নিবেদন বিষয় জেনে নিয়ে আচার্যদেবকে নিবেদন করা এই কাজকে সঙ্গ করা বোঝায়? এই কাজ করলেই আচার্যদেব কে বা আচার্যদেব কেমন মানুষ তা' বোঝা যাবে?
তা' যদি যেত তাহ'লে ঠাকুর ও ঠাকুরের স্বার্থকে প্রতিষ্ঠা করা সহজ হয়ে যেত আচার্যদেবের পক্ষে। ঠাকুরের সব স্বপ্ন পূরণ হ'য়ে যেত এতদিনে। কাঁকড়া চরিত্রের মানুষেরা যেমন ঠাকুরের সঙ্গ করেছে, ঘনিষ্ট হয়েছিল ঠাকুরের ঠিক তেমনি ঘনিষ্ঠ সঙ্গ করা সত্ত্বেও তাদের 'পিছন থেকে টেনে ধরার কাঁকড়া চরিত্রও' ত্যাগ করতে পারেনি। ঠাকুরের মিশন প্রতিষ্ঠার পথে তারা ঠাকুরকে, ঠাকুরের চলার গতিকে পিছন থেকে বারবার টেনে ধ'রে বাধা সৃষ্টি করেছিল। এই একইরকম কাঁকড়া চরিত্রের মানুষেরা ঠাকুরের সময়ে ঠাকুরকে, ঠাকুর পরবর্তী শ্রীশ্রীবড়দাকে, তারপরে শ্রীশ্রীদাদাকে ভয়ংকর বাধা সৃষ্টি করেছে, আর তারা সবাই ছিলেন অত্যন্ত ঘনিষ্ট ও ঋত্বিক; আজও সেই কাঁকড়া চরিত্রের মানুষেরা পিছন ধ'রে টান মারার সেই বিষাক্ত ট্রাডিশান সমানে ব'য়ে চলেছে বর্তমান শ্রীশ্রীআচার্যদেবের পিছনেও।
আর দশটা মানুষের মতন আচার্যদেবও একজন রক্তমাংসের সাধারণ মানুষ। হয়তো একটু চেহারায় আলাদা চটক আছে, যা আমার চেহারায় নেই বা উপস্থিত যারা ওখানে বসেন বা লাইন কন্ট্রোল করেন তাদের নেই। যদিও আধ্যাত্মিক জগতে বা রুপোলি জগতে অনেকেরই চটক আছে কিন্তু কোথায় যেন একটা সূক্ষ্ম তফাৎ লক্ষ্য করা যায় আচার্যদেবের মাঝে। হয়তো অনেকের মনে হ'তে পারে এটা আবেগ সর্ব্বস্ব ভক্তি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ কিংবা যারা তাঁর বিরোধী তাঁদের মনে হ'তে পারে এটা অয়েলিং। কিন্তু বাস্তব হ'লো, যখন আচার্যদেবের সামনে বিভিন্ন বিষয়ে সমাজের প্রতিষ্ঠিত গুণীজনেরা এসে বসেন, কথা বলেন, আলাপ আলোচনা করেন তখন স্পষ্টতই উভয়ের কথাবার্তা, আলাপ আলোচনা, চালচলন, অঙ্গভঙ্গি, হাবভাব, চোখমুখ, চোখের চাউনি, মুখের অভিব্যক্তি, হাসি, বসার ভঙ্গী, অঙ্গুলি হেলন এবং যে কোন সমস্যার নিশ্চিত সমাধান দান এই সবকিছুর মধ্যে সূক্ষ্ম তফাৎ অনুভূত হয়, একটা ঐশ্বরিক এসেন্স 'ম' 'ম' করতে থাকে আচার্যদেবকে ঘিরে, মনে হয় তাঁকে ঘিরে রয়েছে একটা অনুকূল বলয়, আর, সেই বলয়ে নিশ্চিন্তে অবগাহন করে উপস্থিত ভক্তমণ্ডলী।
শ্রীশ্রীআচার্যদেবকে যখন মানুষ তাদের সমস্যার কথা নিবেদন করেন তখন তিনি সবাইকে সহজ সরল ভাবে যাকে যা বলার তাই বলেন, পরামর্শ ও নির্দেশ দেন। তাই শুনে যারা তাঁর নির্দেশ পালন করেন বা পরামর্শ মতো চলেন তারা আচার্যদেবের মধ্যে লৌকিকত্ব বা অলৌকিকত্ব টের পান বা অনুভব করেন। সেটা তারা বোঝেন, যাদের প্রাণ বোঝে। তখন শ্রীশ্রীঠাকুরের বলা "-------রেত শরীরে সুপ্ত থেকে জ্যান্ত তিনি নিরন্তর" বাণী জীবন্ত হ'য়ে ধরা দেয় আগত অকপট সহজ সরল ভক্তবৃন্দের হৃদয়ে। তখন তারা বুঝতে পারে "আজও লীলা করে অনুকূল রায়, কোনও কোনও সৎসঙ্গী দেখিবারে পায়'---এই কথার মর্মার্থ। তারা আরও বুঝতে পারে, শ্রীশ্রীঠাকুরের বলা, "যুগাবতারের অবর্তমানে তাঁতে অচ্যুত-আনতি সম্পন্ন, ছন্দানুবর্তী, জীবন বৃদ্ধির আচরণসিদ্ধ তদবংশধর ইষ্টপ্রতীক স্বরূপ থাকতে পারেন"---এই বাণীর অন্তর্নিহিত অর্থ, বুঝতে পারে কার মধ্যে ইষ্টপ্রতীক স্বরূপ বিরাজ করছেন শ্রীশ্রীঠাকুর। অকপট সহজ সরল ঠাকুর প্রাণ বোকা ভক্ত আচার্যদেবকে দেখে বুঝতে পারে শ্রীশ্রীঠাকুরের বলা "আগত যিনি, উপস্থিত যিনি —তাঁ'র বিগতিতে বা তিরোভাবে তাঁর বংশে যদি তাঁ'তে অচ্যুত – সশ্রদ্ধ – আনতি-সম্পন্ন,প্রবুদ্ধ-সেবাপ্রাণ,তৎবিধি ও নীতির সুষ্ঠু পরিচারক ও পরিপালক, সানুকম্পি-চর্যানিরত , সমন্বয়ী সামঞ্জস্য - প্রধান,পদনির্লোভ , অদ্রোহী , শিষ্ট-নিয়ন্ত্রক,প্রীতিপ্রাণ — এমনতর কেউ থাকেন —তাঁরই অনুগমন ক'রো"----এই বাণী কতটা সত্য, স্পষ্ট, জীবন্ত হ'য়ে উঠেছে আচার্যদেবের জীবনে!!!!
অর্থাৎ এর থেকে বোঝা গেল ঠাকুরকে ও ঠাকুরের বাণী বুঝতে গেলে ঠাকুরের জীবন সম্পর্কে একজন গভীর উপলব্ধিবান মানুষের প্রয়োজন, প্রয়োজন তাঁর বাণীগুলো হাতে কলমে আচরণ ক'রে ক'রে যিনি সিদ্ধ হয়েছেন, যিনি শ্রীশ্রীঠাকুরের নির্দেশ ও নিদেশ জীবনের শেষদিন পর্যন্ত শুধু ও শুধুমাত্র করার স্রোতে ভেসে আচরণ সিদ্ধ হয়েছেন, এছাড়া যার জীবনে অন্য আর কোনও কাজ ছিল না, নেইও অর্থাৎ নিখুঁত আচরণসিদ্ধ পুরুষ হয়েছেন যিনি, গাছের পাতা্র ওপর পড়া বৃষ্টির জলের ফোঁটায় বৃষ্টি শেষে বিরাট সূর্য্যের প্রতিফলনের মত যাঁর জীবনে ঠাকুর উদ্ভাসিত হয়েছেন, যাঁর মধ্যে একমাত্র ব্রহ্মজ্ঞান আরোপ করা সম্ভব, শ্রীশ্রীঠাকুরের পক্ষে তাঁর ব্রহ্মজ্ঞান অর্পন করা সম্ভব ছিল যাঁর ওপর, শ্রীশ্রীঠাকুরের অবর্তমানে তেমন একজন মানুষ যাঁকে ঈশ্বরকোটি পুরুষ বলা হ'য়ে থাকে, তেমন একজন মানুষের প্রয়োজন আমাদের জীবনে শ্রীশ্রীঠাকুরের অবর্তমানে, যাঁকে দেখলেই শ্রীশ্রীঠাকুরকে সাক্ষাৎ দেখা যাবে, বোধ করা যাবে ঠাকুরকে জীবন্ত, যাঁর মধ্যে শ্রীশ্রীঠাকুর রেত শরীরে অবিরাম, অনবরত, সর্বদা, এবং অবিশ্রাম জ্যান্ত আছেন, তীব্র ভাবে পুর্ণ শক্তিতে প্রকট হয়েছেন যাঁর ভেতর তেমন একজন মানুষ আমাদের সামনে চাই, কারণ মানুষ তার জীবনের বাইরে এমন একটা মানুষকে পেতে চায় যাঁর সঙ্গ তাকে ঠাকুরের সঙ্গে যুক্ত রাখে, ঠাকুরের প্রতি বিশ্বাস দৃঢ় রাখে, ঠাকুরে যুক্ত রেখে তাকে সঠিক পথ দেখায়, হতাশা ও অবসাদে ডুবে হারিয়ে যাওয়া থেকে, মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা থেকে রক্ষা করে, দূর্গম অন্ধকার পথে আলো ধ'রে তাকে ঘরে পৌঁছে দেয়, ঠাকুরকে ধ'রে ভারমুক্ত, চিন্তামুক্ত, সংশয়মুক্ত হ'য়ে কঠিন জটিল সংসার সমুদ্র পার হ'তে সাহায্য করে, তেমন একজন মানুষ প্রয়োজন যাঁর সম্পর্কে শ্রীশ্রীঠাকুর স্বয়ং বলেছেন, "পুরুষোত্তমের অবর্তমানে তঁনিষ্ঠ, তঁত্তপা আচার্য্যই শরণীয়"।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে সেই আচার্য, তিনি কে? সৎসঙ্গীদের মধ্যে, শ্রীশ্রীঠাকুরের মন্ত্রে দীক্ষিতদের মধ্যে তিনি কে? তিনি কি কোনও ঋত্বিক?
উত্তর একটাই, তিনি হলেন পরমপূজ্যপাদ শ্রীশ্রীবড়দা। শ্রীশ্রীবড়দা পরবর্তী ছিলেন শ্রীশ্রীদাদা এবং বর্তমান পরমপূজ্যপাদ শ্রীশ্রীআচার্যদেব বাবাইদাদা।
প্রকাশ বিশ্বাস,
ভদ্রকালী, উত্তরপাড়া।

No comments:
Post a Comment