সম্প্রতি গত শনিবার (৩০শে সেপ্টেম্বর'২৩) শ্রীশ্রীআচার্যদেবের সম্মুখে সকালবেলা বসেছিলাম। সময় তখন সাড়ে দশটা। অনেকক্ষণ বসার পরে মেয়ে জামাই তাদের Little Buddha International Pre-school নিয়ে কথা বললো। তাদের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ শ্রীশ্রীআচার্যদেব স্কুলের ফাউন্ডেশন, স্কুলের পরিবেশ, শিক্ষা পদ্ধতি, ক্যারিয়ার, বাচ্চাদের স্বাস্থ্য, বাবা-মায়েদের মানসিকতা, হিলিং সেকশান, স্কুল ও হিলিং সেকশানের নামকরণ, ইনভেষ্টারের সঙ্গে চুক্তি ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে কথা বললেন।
তাদের কথা শেষ হ'লে অন্যদের নিবেদন শেষে আমার স্ত্রী ফ্ল্যাটের কঠিন সমস্যার বিষয় উত্থাপন করলে পরে আমি আচার্দেবকে সবিস্তারে বিষয় ব্যাখ্যা করলাম। পূর্ব কমিটির মেইন্টেন্যান্সের লক্ষ লক্ষ টাকার হিসাব না দেওয়া, মেইন্টেন্যান্সের টাকা বন্ধ ক'রে দেওয়া, প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমাকে নির্বাচন করা সত্ত্বেও পূর্ব কমিটির যোগ সাজসে বর্তমান কমিটির সদস্যদের আমাকে সহযোগীতা না করা ও পদত্যাগ করা, বিল্ডিংয়ের ইলেক্ট্রিক বিল জমা না পড়া, সুইপারের টাকা না দেওয়া, সম্প্রতি পূর্ব কমিটির অদূরদর্শিতার কারণে মোটর পাম্প নষ্ট হওয়া এবং নোতুন ক'রে বোরিং করা ও মোটর পাম্পের পিছনে দেড় লক্ষ টাকার অধিক খরচা হওয়া ও পুনরায় ফিল্টার পরিষ্কার না করা ইত্যাদি ইত্যাদি নানা সমস্যার কথা শুনে এবং উদ্বেগ দেখে শ্রীশ্রীআচার্যদেব বললেন,
"দেশের প্রধানমন্ত্রীকে সবাই মানে? রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে সবাই মানে? সবাই আপনাকে মানবে এটা কোথায় লেখা আছে? আপনার নাক মুখ যদি কেউ চেপে ধ'রে তখন আপনার কি হবে?" আমি চুপ ক'রে থাকায় তিনি দ্বিতীয়বার বললেন, কি হবে? আমি দমবন্ধ কষ্টকর পরিস্থিতির কথা বলায় তিনি বললেন, "ঠিক তেমনি তাদেরও হবে। ফ্ল্যাটের লাইট চলে গেলে দরকার হ'লে ইনভার্টার কিনে নেবেন, জল না থাকলে জল কিনে খাবেন, বাইরে থেকে নিয়ে আসবেন। সমস্যা আপনার একার না। সমস্যা হ'লে সবার হবে। আপনি বিন্দাস থাকুন, পরিস্থিতি এনজয় করুন। দেখুন কি হয়।" এ কথা ব'লে আমার দিকে মিষ্টি হাসি হেসে চেয়ে রইলেন।
এরপরেও যখন আমি উদ্বেগে দুশ্চিন্তায় ভবিষ্যৎ ফ্ল্যাটের খারাপ অবস্থার কথা বললাম তখন তিনি পরিষ্কার ভাষায় বললেন, "আর যদি না পারেন তাহ'লে আপনি প্রেসিডেন্ট পদ থেকে রিজাইন দিন।" পরে কিছুক্ষণ উভয়পক্ষই চুপ থাকার পর অন্যান্যদের নিবেদনের মাঝে আমায় হাসি মুখে বললেন, "আনন্দে থাকুন, সিচুয়েশন এঞ্জয় করুন।"
একলহমায় আমি যা বোঝার, যা ইঙ্গিত পাওয়ার বুঝে গেলাম, পেয়ে গেলাম। মনের ওপর থেকে বিরাট একটা চিন্তার বোঝা নেমে গেল নিমেষে। নিজেকে বিরাট হাল্কা বোধ হ'লো। আমি চুপ ক'রে কিছুক্ষণ বসে রইলাম। তারপরে স্ত্রী বাড়ি ফেরার আশীর্বাদ চাইলো। তিনি হাত দিয়ে দেখিয়ে বললেন, গাড়িতে এসেছেন? স্ত্রী হ্যাঁ বলায় তিনি বললেন, "ঠিক আছে। সাবধানে যাবেন।"
ততক্ষণে সময় হ'য়ে এসেছে নিবেদন শেষ হওয়ার। আমি প্রণাম ক'রে ধীরে ধীরে বাইরে বেরিয়ে এলাম। বেরিয়ে আসার সময় তাঁর আলোময়, রূপময় চোখের দিকে চেয়ে আর মধুময় মুখের মিষ্টি হাসিতে কি আর্শীবাদ ও অভয় যে পেলাম তা ভাষায় বর্ণনা করা অসম্ভব!
এখন আমি নিশ্চিন্ত। প্রতিটি মুহুর্ত এনজয় করছি।
কারণ, কি অদ্ভুতভাবে পরিস্থিতি ঘুরে যাবার পরিচয় পেলাম। দেওঘর থেকে ফিরে এলাম শনিবার রাতে। কলকাতায় বেহালার গ্রীণ ফিল্ডের ফ্ল্যাটে রাত কাটিয়ে পরদিন রবিবার সকালে জলযোগ সেরে ফিরে এলাম উত্তরপাড়ায় নিজের ফ্ল্যাটে। পরেরদিন ২রা অক্টোবর গান্ধী বার্থ ডে উপলক্ষে ছুটি। সকাল দশটার সময় ফ্ল্যাটের দু'জন এলেন দেখা করতে। জলট্যাঙ্ক পরিষ্কার করার প্রয়োজনের কথা বললেন। তারা সবার সঙ্গে কথা বলেছেন বললেন। জলের ট্যাঙ্ক ইমিডিয়েট সেদিনই পরিষ্কার করার কথা বললেন। বললেন যে কোনও মুহুর্তে যে কারও শরীর খারাপ হ'তে পারে। বাড়িতে বাচ্চারা রয়েছে। বাড়ির মহিলারা ভয় পেয়েছে। তাই আমাকে জানাতে এসেছেন, আমার অনুমতি চাইলেন।
আমি অনুমতি দিলাম। অনেক কথা হ'লো। আমি বিক্ষিপ্ত ইন্টারেস্ট ছেড়ে টোটাল বিল্ডিং ইন্টারেস্টের কথা বললাম। বললাম, 'আমরা এক নৌকোর যাত্রী। নৌকো ফুটো হ'লে সবাই একসঙ্গে ডুবে মরবো। বিল্ডিংয়ের অবস্থা খুব খারাপ। বিল্ডিংয়ের ভালোর জন্য যা আপনাদের ইচ্ছা হয় করুন। আমি অনেকবার মিটিং ডেকেছি আপনারা একটা গ্রুপ আসেননি। আমাকে কোনও সহযোগীতা আপনারা করেননি। অথচ আমি আপনাদের সবসময় সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। আপনারা ইমিডিয়েট মিটিং ডাকুন, আমায় আগের আয় ব্যায়ের হিসাব দিন, দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে আজ পর্যন্ত আমার হিসাব নিয়ে নিন। নোতুন কমিটি করুন। যাকে ইচ্ছা আপনারা কমিটিতে রাখুন। আমি 'ডাল রোটি খাও আর প্রভুকা গুণ গাও' মেন্টালিটির লোক। আমি রিজাইন দিয়ে দিচ্ছি। আপনারা বিল্ডিং পরিচালনা করুন।
তারা চুপ ক'রে রইলো। কোনও কথা বললো না। সমস্যা সমাধানের জন্য মিটিংয়ে বসার কথা স্বীকার করলো। ফান্ড শূন্য। কি ক'রে ট্যাঙ্ক পরিস্কারের টাকা দেবে সে কথা বললো না। আমিও কোনও কথা বললাম না। মিটার রুমের চাবি চাইলে দিয়ে দিলাম। তারা একরাশ উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা নিয়ে চলে গেল।
আমি আমার ড্রয়িং রূমে চুপ ক'রে বসে আসনে বসানো শ্রীশ্রীঠাকুরের ফটোর দিকে চেয়ে রইলাম, চেয়ে রইলাম ফটোয় শ্রীশ্রীআচার্যদেবের মুখের দিকে। মনে পড়ে গেল শ্রীশ্রীআচার্যদেবের কথা। আমার দু'চোখ ছলছল ক'রে উঠলো।
আমি বিন্দাস তাদের উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা এনজয় করলাম।
(লেখা ৩রা অক্টোবর'২৩)
No comments:
Post a Comment