জীবন জীবনের জন্যে,
একটু সহানুভূতি কি
মানুষ পেতে পারে না?
না পেতে পারে না। এ অপ্রিয় সত্য। এ বিধাতার বিধান।
হয়তো আমার কথাটা ভালো লাগবে না। তা'তে আমার কিছু করার থাকে না।
এ বিধাতার বিধান কারণ কারও বৃত্তি-প্রবৃত্তি যে কথায়, যে কাজে বাধা পায় সেই কথা বা কাজ তার ভালো লাগে না। ফলে যার কথা ও কাজে রিপু ভোগ করার পথে বাধা সৃষ্টি হয় সেই বাধাসৃষ্টিকারী মানুষটাও তার কাছে বিরক্তির কারণ হ'য়ে পড়ে। কারণ সে ষড়রিপুর দাস, চাকর। রিপু দ্বারা চালিত তার জীবন। ষড়রিপু তাকে গলায় শেকল বেঁধে কুত্তার মতো টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলে তার দিকে। ষড়রিপু দ্বারা আক্রান্ত ব্যক্তি তার বৃত্তি-প্রবৃত্তিকে আঁকড়ে ধ'রে বাঁচতে চায়। তার বৃত্তি-প্রবৃত্তি অর্থাৎ ঝোঁক, টান যেদিকে অর্থাৎ কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য এই ষড়রিপুর যেদিকে সে ছুটে চলেছে রিপুর প্রবল টানে উন্মাদের মতন সেই ছুটে চলার পথে বাধা পায় যে কথা ও কাজে সেই কথা, সেই কাজ তার ভালো লাগে না, সেই কথা, সেই কাজ, সেই জ্ঞান, সেই উপদেশ ইত্যাদি তখন তার কাছে শত্রু। জীবন্ত ঈশ্বরকে, তাঁর উপস্থিতিকে তখন সে পরম শত্রু মনে করে আর সেই বৃত্তি-প্রবৃত্তিকে অর্থাৎ উচ্ছৃঙ্খল রিপুর সেই টানকে, রিপুর প্রতি মত্ত ঝোঁক রূপী শয়তানকে সে তখন পরম বন্ধু ব'লে মনে করে। সে তখন চিনতে পারে না এই অল্প কদিনের জন্য আসা পৃথিবীতে কে প্রকৃত বন্ধু আর কে বন্ধু রূপী শত্রু। এ কথা দুঃখের হ'লেও তার কাছে পরম সুখের। আরও দুঃখের কথা সেই শয়তান তাকে এমনভাবে নানা প্রলোভনে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নেয় সাপের মতো যে সেই বাঁধন থেকে সে বেরিয়ে আসতে চাইলেও আর বেরিয়ে আসতে পারে না; অবশেষে তাকে গিলে খায় সেই শয়তান। সেই নানা প্রলোভনের মধ্যে ঈশ্বর আরাধনাও একটা প্রলোভন। এই উচ্ছৃঙ্খল বিশৃঙ্খল ভাবে রিপুকে ভোগ করার জন্য সে ঈশ্বর আরাধনাও করে। যাতে ষড়রিপুর প্রতি তার এই তীব্র ঝোঁক অর্থাৎ বৃত্তি-প্রবৃত্তির বৃত্তের মধ্যে ডুবে থাকার জন্য তার কোনও ক্ষতি না হয় সে জন্য ঈশ্বরের পুজোকে হাতিয়ার করে।
আর সেই ঈশ্বর কিন্তু কোনও জীবন্ত ঈশ্বর বা সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ নয়। সেই ঈশ্বর আকাশের ঈশ্বর, বোবা ঈশ্বর, মাটির ঈশ্বর। যে ঈশ্বর তাকে তার ভুল কাজ, অন্যায় কাজকে বাধা দিতে পারে না, কিছু বলতে পারে না।। শুধু একতরফা অন্যায় কাজ, ভুল কাজের সমর্থন আদায়ের জন্য বৃত্তি-প্রবৃত্তির অধিকারী মানুষ জাঁকজমক আড়ম্বরপূর্ণ বোবা ভগবানের, অমূর্ত ভগবানের পুজো করে। বৃত্তি-প্রবৃত্তিতে ডুবে থাকা মানুষ জীবন্ত ঈশ্বরের কাছে যাবে না, তাঁর কাছে তাঁর অন্যায় কাজের জন্য, ভুল কাজের জন্য ক্ষমা চেয়ে সারেন্ডার করবে না, তাঁর নির্দেশিত পথে চলবে না। সেখানে শুধু নানারকম করার কথা, ক'রে পাওয়ার কথা, কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য এই ষড়রিপুকে, বৃত্তি-প্রবৃত্তিকে কন্ট্রোল করার কথা, চরণপুজোর পরিবর্তে চলনপুজোর কথা, চরিত্র গঠনের কথা। জীবন্ত ঈশ্বরের কাছে Character making education-এর কথা যা ছোটো বড়, গরীব বড়লোক, জ্ঞানী অজ্ঞানী, পন্ডিত মূর্খ, যোগী ভোগী কারও ভালো লাগে না। সব তখন বকোয়াস, বাড়াবাড়ি মনে হয়।
আর এই অভ্যাস এমন মজ্জাগত হ'য়ে যায়, শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে, শিরায় শিরায়, কোষে কোষে এমনভাবে জোঁকের মতো গেঁথে বসে যে বয়সকালেও সেই বদ সংস্কার ত্যাগ করতে পারে না। জোঁকের রক্ত খেয়ে একেবারে ফুলে মোটা হ'য়ে যাবার পর যেমন আপনা আপনি খসে পড়ে জোঁক ঠিক তেমনি এই বৃত্তি-প্রবৃত্তির বদ অভ্যাস রিপুদ্বারা নিয়ন্ত্রিত বৃত্তি-প্রবৃত্তির অধিকারী মানুষের জীবনীশক্তিকে চুষে খেয়ে, নিংড়ে নিয়ে একেবারে ঝাঁঝরা ক'রে দিয়ে, ছিবড়ে ক'রে ফেলে দেয়। তখন সে হয় মৃত্যুমুখে পতিত হত অসহ্য জ্বালাযন্ত্রণা সহ্য ক'রে। নতুবা শেষ জীবনে বিছানায় হেগে মরে। শেষের সেদিন তখন তার ভয়ংকর হ'য়ে ওঠে। আর, এর কষ্টকর ফল ভোগ করে পরিবারের সদস্যরাও।
তাই সে মানুষ কাউকে সাহায্য করা ও কারও কাছ থেকে সাহায্য পাওয়া তো দূরের কথা কাউকে সহানুভূতিটুকুও দেখায় না ও কারও কাছ থেকে পায় না। আর দেখালেও সেখানেও উচ্ছৃঙ্খল রিপুর ছোবল থাকে। সেখানেও থাকে Give & Take policy. ফলস্বরূপ সে প্রতিদানে কোনও সাহায্য বা বিন্দুমাত্র সহানুভূতিও কারও কাছ থেকে পায় না।
মানুষ মানুষের জন্য তখনই হয়, জীবন জীবনের জন্য তখনই হয়, মানুষ মানুষের কাছে সহানুভূতি শুধু নয়, সাহায্যও পায় যখন মানুষের জীবনে সর্ব্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ জীবন্ত ঈশ্বর থাকে। যখন মানুষ সেই জীবন্ত ঈশ্বরের চরণে নিজেকে সঁপে দিয়ে তাঁর চরণপূজার পরিবর্তে চলনপূজায় মগ্ন হয় এবং সেই জীবন্ত ঈশ্বরের গুণাবলী তাঁর চরিত্রের মধ্যে জীবন্ত হ'য়ে ওঠে, যখন সেই মানুষ তাঁর জীবন্ত সর্ব্বশ্রেষ্ঠ আদর্শের স্পর্শে নিজেই এক চলমান আদর্শে পরিণত হয় নিজের পরিবারে, নিজের সমজে তখন সে মানুষের জন্য বাঁচে আর মানুষও তাঁর জন্য বাঁচে।
পৃথিবীতে ঈশ্বর ব্যতিত কোনও মানুষই কোনও মানুষের জন্য হ'তে পারেন না। সবটাই সাময়িক কিংবা লোক দেখানো। মানুষের জন্য প্রকৃত মানুষ তখনই হয় যখন মানুষ একমাত্র ঈশ্বরের জন্য হয়, ঈশ্বরই তাঁর জীবনে এক ও একমাত্র হয়, অন্য কেউ নয়। যখন এই বিশ্বব্রম্মান্ডের সৃষ্টিকর্তার জীবন্ত রূপ আমার জীবনে প্রথম ও প্রধান হয় তখন তাঁর সৃষ্টির সবকিছুর জন্য আমার জীবনও উৎসর্গ হয়। তাই শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন,
"You are for the Lord
Not for others,
You are for the Lord
And so for others."
এই সমাজ, সমাজব্যবস্থা ও রাষ্ট্রব্যবস্থা সবটাই এই মারণ রোগের শিকার। সবাই রিপুতাড়িত। তাই মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য আর হ'য়ে উঠতে পারলো না। কেউ কাউকে একটু সাহায্য তো দূরের কথা একটু সহানুভূতিও দেখায় না। তুমি যদি কাউকে ভালো না বাসো, তুমি যদি কাউকে সাহায্য না করো, তুমি যদি কারও বিপদের সময় পাশে না দাঁড়াও, একটু সহানুভূতিটুকুও না দেখাও তাহ'লে তুমিও তা আশা করতে পারও না। কারণ সবটাই সেই অর্থে বিজ্ঞান।
বিজ্ঞানের ভাষায়ও বলা আছে, Every action has an equal and opposite reaction. প্রতিটি ক্রিয়ার একইরকম ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে।
শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রও বললেন, "তুমি যা করছো বা ক'রে রেখেছো ভগবান তাই-ই গ্রাহ্য করবেন আর তাঁর ফলও পাবে ঠিক তেমনি।"
তিনি আবার বললেন, "
যা ইচ্ছা তাই করবে তুমি
তা করলে রে চলবে না
ভালো ছাড়া মন্দ করলে
পরিস্থিতি ছাড়বে না।"
তাই, মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য এসব কাঁদুনি গেয়ে লাভ নেই। মানুষ যেখানে নিজের জন্যই নয় সেখানে অন্যের জন্য কি ক'রে হবে? এখন লোক দেখানো সব ভালো ভালো কথা আয়ের জন্য, ক্ষমতা দখলের জন্য, আধিপত্য বিস্তারের ও নাম যশ কামানোর উপকরণ মাত্র।
আর এ কথা শুধু মূর্তি পূজার অধিকারী ব্যক্তির জন্য শুধু নয় জীবন্ত ঈশ্বরের তথাকথিত লোকদেখানো ভন্ড সাজা ভক্তরাও এই একই রোগের রুগী। জীবন্ত ঈশ্বর যতবার এসেছেন ততবারই তাদের অনুগামী শিষ্যদের মধ্যে এই রোগের ভয়ংকর প্রাদুর্ভাব আমরা দেখেছি ও দেখে চলেছি।
আর বর্তমান যুগপুরুষোত্তম শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের ভক্ত শিষ্য সৎসঙ্গীরা এই রোগের প্রাদুর্ভাব থেকে মুক্ত? সাজা সৎসঙ্গীরা কি মন্দিরে মন্দিরে কেন্দ্রে কেন্দ্রে আয়ের জন্য, ক্ষমতা দখলের জন্য, আধিপত্য বিস্তারের ও নাম যশ কামানোর উপকরণ মাত্র বানিয়ে নেয়নি শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রকে? তারা কি শ্রীশ্রীঠাকুরের স্বার্থ প্রতিষ্ঠা ও শ্রীশ্রীঠাকুরকে প্রতিষ্ঠায় মগ্ন? তারা কি শ্রীশ্রীঠাকুরের নির্দেশ ও নিদেশ মেনে চলছে জীবনে? তারা কি তাদের জীবন শ্রীশ্রীঠাকুরের জীবনের জন্য নিজেদের জীবনকে উৎসর্গ করেছে? তারা কি শ্রীশ্রীঠাকুরের স্বার্থ প্রতিষ্ঠা ও শ্রীশ্রীঠাকুর প্রতিষ্ঠার এক ও একমাত্র লক্ষ্যে অবিচল ও অন্তপ্রাণ শ্রীশ্রীআচার্দেবকে সাহায্য করেছেন ও করছেন?
তাই তারাও যখন শ্রীশ্রীঠাকুরের জন্য নয়, শ্রীশ্রীঠাকুরের জীবনের জন্য তাদের জীবন নয় তখন তারাও মানুষের জন্যে নয়, তাদের জীবনও কোনও জীবনের জন্যে নয়। তাই তারাও রোগ, শোক, গ্রহদোষ, বুদ্ধি বিপর্যয় ও দরিদ্রতা থেকে মুক্তি তো দূরের কথা একটু সহানুভূতিও পেতে পারে না।
প্রকাশ বিশ্বাস।
উত্তরপাড়া, ভদ্রকালী।
No comments:
Post a Comment