যে বর মাঙ্গে সেই বর পায়।
আজ আশ্বিনের শেষ দিন, কাল আসছে কার্তিকের প্রথম দিন।
এই ব্রত সম্পর্কে নীচে বিস্তারিত দেওয়া আছে। চলতি কথায় আমরা বলতাম বতের ভাত। আমরা পূর্ব বাংলার চট্টগ্রামের লোক। মা-বাবা চট্টগ্রামের ভাষায় কথা বলতো নিজেদের মধ্যে। আর আত্মীয়স্বজন সবসময় দিনেরাতে কেউ না কেউ আসতো বাড়িতে। সবসময় ঘর গমগম করতো। এত দেশ থেকে আসা আত্মীয়স্বজন ছিল এলাকায়। তারা সবসময় চট্টগ্রামের ভাষায় কথা বলতো। যখন এই ব্রতের ভাত নিয়ে কথা বলতো তখন তারা এমনভাবে কথা বলতো শুনলে মনে হ'তো বতের ভাত বলছে। আর তা শুনে শুনে আমরাও কখন শিখে গেছি ব্রতের ভাতের বদলে বতের ভাত। আসলে কথাটা ব্রতের ভাত। আর এই ব্রত স্বর্গের চিকিৎসক অশ্বিনীকুমারের উদ্দেশ্যে ব্রত।
স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরেই মানুষ বাঁচতে চায়। বাঁচেও; যদি স্মৃতি ফিরে ফিরে আসে কোনও না কোনওভাবে। স্মৃতি আনন্দের হ'লেও সাথে এক বুক দুঃখ নিয়ে আসে। এমনি আনন্দ আর দুঃখ মেশানো এক স্মৃতি হ'লো বতের ভাত ওরফে ব্রতের ভাত। এই ব্রত অনুষ্ঠান বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের অনুষ্টান। আমরা চট্টগ্রাম জেলার লোক। যদিও এ বাংলায় আমার জন্ম। আমার বাবা দেশভাগের আগে চলে আসেন এ বাংলায়। বাবারা ছিলেন পাঁচ ভাই আর বাবা ছিলেন সবার ছোটো। ও বাংলায় ছিল বিশাল যৌথ পরিবার। বাবা আর এক জ্যাঠা ও তার পরিবার সঙ্গে অন্যান্য জ্যাঠার ছেলেরা চলে আসে এই বাংলায় বাবার হাত ধ'রে। বাকীরা থেকে যায় ও বাংলায়।
যাই হ'ক, যখন একটু বড় হ'লাম তখন থেকে বাবার মৃত্যু পর্যন্ত (১৯৭৯) পর্যন্ত প্রতি বছর বড় ক'রে এই বতের ভাত অনুষ্ঠান হ'তো। তারপর মা যতদিন বেঁচে ছিলেন (১৯৯২) ততদিন শেষের দিকে কয়েক বছর বাদ দিয়ে অনুষ্ঠান হ'তো, ছোটো ক'রে নিয়ম রক্ষার্থে হ'তো। যদিও আজ আর স্পষ্ট ক'রে সব মনে পড়ে না। তারপর মা চলে গেলে সব বন্ধ হ'য়ে যায়। চট্টগ্রামের রীতিনীতি সব বন্ধ হ'য়ে ওলটপালট হ'য়ে যায়। কারণ চট্টগ্রামের কোনও মেয়ে এ বাড়ির বউ হ'য়ে আসেনি যারা জানবে চট্টগ্রামের নিয়ম। যদিও বৌদিরা শিখে গিয়েছিল মোটামুটি কিন্তু মায়ের মৃত্যুর পর অনেকবার ইচ্ছা হ'লেও পুজো পদ্ধতির ভুল ত্রুটির ভয়ে আর করা হ'য়ে ওঠেনি। তবে আমি চেয়েছিলাম অন্তত শ্রদ্ধাভক্তিকে অবলম্বন ক'রে প্রসাদ নিবেদন করা হ'ক আর তারপর ঐ অদ্ভুত সদাচার সমৃদ্ধ পবিত্র সাত্ত্বিক প্রসাদ সবাই গ্রহণ করুক। কিন্তু কেন জানি প্রতিবার হবো হবো ক'রে আর হয়নি।
এবার আসল কথায় আসি। এই একই রকমের ব্রত পশ্চিবঙ্গে অর্থাৎ এ দেশীদের মধ্যেও চল আছে। যাকে এ দেশীরা রান্না পুজো বলে। তারা ভাদ্র মাসের শেষ দিনে রাঁধে আর আশ্বিনের প্রথম দিনে খায়। আর বাঙ্গালদের অর্থাৎ পূর্ববঙ্গের লোকেদের ছিল আশ্বিনে রাঁধে কার্তিকে খায় প্রথা অর্থাৎ আশ্বিন মাসের শেষ দিনে রাতের বেলায় রান্না ক'রে অশ্বিনীকুমারের উদ্দেশ্যে নিবেদন করবে আর ১লা কার্তিক সকালবেলায় সেই প্রসাদ গ্রহণ করবে। তবে দুই বাংলার পুজোর উদ্দেশ্য ও প্রসাদের ছিল আসমান জমিন ফারাক। বাংলাদেশে চট্টগ্রাম ছাড়া আর কোন জেলায় এই ব্রত পালন করা হয়, কিভাবে হয় তা আমার জানা নেই। আর এই প্রসাদ রূপী আহার ছিল একেবারে সাত্ত্বিক আহার। প্রচন্ড সদাচার সম্পন্ন গোঁড়ামি ছিল এই প্রথা পালনে। আগের দিন সারাদিন উপোস থেকে বতের ভাতের উপকরণ প্রস্তুত করা হ'তো। সকালে নারকেল কুড়িয়ে গুড় জ্বাল দিয়ে তৈরি করা হ'তো নারকেলের পুর। তারপর হাতের তালুতে সেই পুর নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে করা হ'তো নাড়ু। সবচেয়ে যেটা বিস্ময় ছিল নারকেল নাড়ু তৈরি হ'তো এক একটা ক্যাম্বিস বলের সাইজের, যেন লাল ক্যাম্বিস বল! তারপর যেখানে এই ব্রত অনুষ্ঠান পালন হবে অর্থাৎ ঠাকুর ঘরে সেখানে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ক'রে রাখা হ'তো আগে থেকে। সেখানে এনে রাখা হ'তো থরে থরে সাঝানো ক্যাম্বিস বল সমান নারকেল নাড়ু থালায় ক'রে ক'রে কাপড় দিয়ে ঢাকনা দিয়ে। পাশে রাখা হ'তো ইয়া বড়া বড়া কাঁদি কাঁদি সিঙ্গাপুরি কলা। কয়েক হাঁড়ি মিষ্টি দই। গামলা ক'রে রাখা হ'তো কয়েক রকমের মিষ্টির প্যাকেট। থাকতো হাঁড়ি ভর্তি খাঁটি আখি গুড়। খাঁটি গুড়ের গন্ধে ম ম করতো ঠাকুর ঘর। আর থাকতো নারকেল। পরের দিন সকালে ভেঙ্গে গোল গোল ক'রে কাটা হবে নারকেলের টুকরো। সবশেষে কাজ গুছানো হ'য়ে গেলে রান্না হ'তো বতের ভাত। গোবিন্দ ভোগ চালের ভাত। রান্না হ'তো মাটির হাঁড়িতে। রান্নার সময় সারা ঘর বাহির ম ম করতো চালের গন্ধে! আর এখন গোবিন্দ ভোগ রান্না হ'লে রান্নাঘরে গন্ধ পাওয়া যায় না, বাইরে তো দূরের কথা। ভাত রান্না হ'য়ে গেলে সেই ভাতের হাঁড়ি এনে রাখা হ'তো ঠাকুর ঘরে যেখানে পুজোর সামগ্রী, উপকরণ পরপর সাজিয়ে রাখা হয়েছে। হাঁড়ির ভাতের মধ্যে ঢেলে দেওয়া হ'তো ঠান্ডা জল। তারপর সাদা পরিস্কার নোতুন কাপড় দিয়ে বেঁধে দেওয়া হ'তো মাটির হাঁড়ির মুখ। এরকম আরো একটা বড় হাঁড়িতে ক'রে রাঁধা হ'তো বতের ভাত। কারণ আত্মীয় স্বজন প্রতিবেশী আমাদের ভাইবোনেদের ঘনিষ্ট বন্ধু বান্ধব অনেক নিমন্ত্রিত থাকতো। তারপর সব কাজ শেষ হ'লে ঠাকুর ঘরে সব সাজিয়ে গুছিয়ে রাখার পর আরো একবার ঘর মুছে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন হ'য়ে এসে ধুপ জ্বালিয়ে দিয়ে অশ্বিনীকুমারদের উদ্দেশ্যে সেই বতের ভাত ও অন্যান্য প্রসাদ নিবেদন ক'রে প্রণাম ক'রে ঠাকুর ঘর বন্ধ ক'রে দিত মা।
পরের দিন মা অতি প্রত্যুষে উঠে ঘর দ্বোর ঝাড় দিয়ে মুছে পরিস্কার ক'রে স্নান ক'রে পুজোর কাপড় পড়ে এসে বসতো ঠাকুর ঘরে। মা আমার শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের মন্ত্রশিষ্যা ছিলেন। সারা বছর সূর্য ওঠার আগে ঘুম থেকে উঠে ঘর দ্বোর পরিস্কার ক'রে চলে যেত গঙ্গা স্নানে। প্রতিদিনকার মত কাজ শেষে গঙ্গা স্নান ক'রে এসে প্রথমে ইষ্টভৃতি, প্রার্থনা ক'রে তারপর বতের ভাত পুজানুষ্ঠান শুরু করতো। এইভাবে সময় গড়িয়ে যেত। আমরা ঘরের লোকেরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম কখন পুজো শেষ হবে আর আমরা সেই অদ্ভুত অভুতপূর্ব পবিত্র সাত্ত্বিক আহার গ্রহণ করবো। আর পুজো চলাকালীন একে একে এসে উপস্থিত হ'তো ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশী, বন্ধু বান্ধব একে একে।
মা যখন পুজোর প্রসাদ স্বরূপ হাঁড়ির কাপড় খুলে গোবিন্দ ভোগ চালের ভাত, ঢাকনা খুলে খাঁটি ঝোলা খেজুর গুড়, চাক চাক দই, ক্যাম্বিস বল, গোল গোল ক'রে কাটা নারকেলের টুকরো, কয়েক রকমের মিষ্টি দিয়ে সাজিয়ে রাখতো থালা গুলি তখন দেখতে এত সুন্দর লাগতো প্রসাদের থালাগুলি এবং সেই সমস্ত আলাদা আলাদা প্রসাদের গন্ধ মিলিত হ'য়ে এমন এক মোহময়ী সুগন্ধির সৃষ্টি হ'তো যে মনে হ'তো এই বতের ভাতের অর্থাৎ ব্রতের ভাতের আরাধ্য দেবতা স্বর্গ থেকে নেবে এসেছে এই ঘরে। পবিত্র স্বর্গীয় সাত্ত্বিক পরিবেশে সবাই এক ঐশ্বরিক অনুভূতি উপভোগ করতাম। তারপর যারা যারা এসে যেত তাদের আসন দিয়ে বসিয়ে প্রসাদের থালা অর্থাৎ বতের ভাতের থালা এগিয়ে দেওয়া হ'তো। সবাই স্বর্গীয় অনুভূতিতে নিমগ্ন হ'য়ে গ্রহণ করতো সেই অদ্ভুত পবিত্র প্রসাদ। এমনিভাবে চলতো দুপুর পর্যন্ত। তারপর অতিথি আপ্যায়ন শেষ হ'লে মা আর দিদিমা মায়েমেয়ে মিলে গ্রহণ করতো সেই ব্রতের প্রসাদ পরম তৃপ্তিভরে।
ভুলে গেছিলাম সব। হঠাৎ চোখে পড়ে গেল এই পোষ্ট। আর অমনি স্মৃতির দরজা জানালা খুলে হুড়মুড় ক'রে বেরিয়ে এলো সব চাপা পড়া স্মৃতি। অনেক অনেক কিছু একের পর এক ভেসে উঠতে লাগলো স্মৃতি। সব লিখতে ইচ্ছে করছে কিন্তু লিখলাম না কারণ এক, লেখা দীর্ঘ হ'য়ে যাবে আর দুই, স্মৃতিগুলো থেকে দুঃখ ঝ'রে প'ড়ে বুকটাকে ভারাক্রান্ত ক'রে তুলছে। বতের ভাতকে কেন্দ্র ক'রে আশ্বিনের শেষের দিন অর্থাৎ সকাল থেকে শুরু ক'রে কার্তিকের প্রথম দিনের অনুষ্ঠান শেষ পর্যন্ত সমস্ত ছবি, সবার ছবি একে একে ভেসে উঠছে চোখের সামনে আর বুকের ভেতরটা ব্যথায় ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম তাই আর না এগিয়ে অনিচ্ছাকৃত ভাবেই একবুক কষ্ট নিয়ে এখানেই স্মৃতির ঝাঁপি বন্ধ করলাম। কারণ আমায় বাঁচতে হবে। দুঃখ একটাই যদি একটা মায়ের হাতের সাজানো বতের ভাতের ছবি এখানে দিতে পারতাম।
(লেখা ১৮ই অক্টোবর'২০২২)
SND Devotional
October 18, 2022
আশ্বিনে রাধে-কার্তিকে খায় (ব্রতের ভাত)

বুধবার (১৯-অক্টোবর)
স্বর্গের চিকিৎসক অশ্বিনী কুমারদ্বয় সূর্যদেব ও সংজ্ঞা'র পুত্র। অভিশাপগ্রস্ত সংজ্ঞা জগজ্জনী পার্বতীর কাছে নিজের দুর্দশা থেকে মুক্তি চাইলে পার্বতী এক মুষ্টি চাল দিয়ে তাকে বলছিলেন-আশ্বিন মাসের শেষ তারিখ পূর্বরাত্রে শেষ দিবসে রেখে এই চাল ভক্তিপূর্বক রন্ধন শেষে মহাদেবের অর্চনা করতে হবে এবং কার্তিক মাসের ১ম দিবসে সেই অন্ন ভক্ষণে মনস্কামনা পূর্ন হবে।সে নিয়মে মেনে রোগ ও অভিশাপমুক্ত হয়েছিলেন দেবী সংজ্ঞা।
অশ্বিনী কুমারদ্বয় হলেন-নাস্যতা ও দস্র। ঋগ্বেদ এবং সংস্কৃত সাহিত্যে ও অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের নাম এসেছে। মহাভারতের আদিপর্বের পৌষ্যপর্বাধ্যায়ে উপমন্যোপাখ্যানে দেব-চিকিৎসক হিসাবে তাদের ভূমিকার কথা জানা যায়।
"আশ্বিনে রাঁধে, কার্তিকে খায়
যেই বর মাগে,সেই বর পায়।)
No comments:
Post a Comment