হাঁটতে হাঁটতে এসে উপস্থিত হ'লাম দাদার ডেরায়। দাদা একটা চেয়ারে বসে আছে। কথা বলছে সবার সঙ্গে। বহুজনের বহু সমস্যা। সামনে আশেপাশে অনেক লোক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে দাঁড়িয়ে বা বসে আছে। আমাকে দেখেই উঠে দাঁড়ালো। তারপর আমার হাত ধ'রে নিয়ে চলে গেল দূরে অন্ধকারে যাতে কেউ আমাদের কথা শুনতে না পায়। সবাই অবাক বিস্ময়ে উৎকণ্ঠায় চেয়ে রইলো সেদিকে। কি জানি কি হয়। প্রত্যেকের মনে এই ভাব। আমরা দুজনে এসে দাঁড়ালাম দূরে একটা অন্ধকার বারান্দায়। তারপর আমাকে দাদা বললো, কি রে কি শুনছি? কি বলেছিস ----দাকে? আমি বুঝতে পারলাম এই অল্প সময়ের মধ্যেই ঐ দাদা কথাটা পৌঁছে দিয়েছে বিশ্বস্ত সৈনিকের মতো। আমি বললাম তুমি যা শুনেছো ঠিক শুনেছো। উত্তেজিত হ'য়ে দাদা বললো, মানে? আমি বললাম, মানে আমি কাল সকাল ন'টায় গাড়ি আটকাবো। চাপা গলায় চেঁচিয়ে উঠলো দাদা, কার গাড়ি আটকাবি? আমি দ্বিধাহীন কন্ঠে নিঃসঙ্কোচে বললাম, প্রেসিডেন্টের গাড়ি। তুই আটকাতে পারবি? তোর এত সাহস? তোর এত বুকের পাটা? ব'লে উত্তেজনায় কাঁপতে লাগলো দাদা। আমি জোশের সঙ্গে বলে উঠলাম, এতে সাহসের কি আছে আর বুকের পাটার কি দরকার? সকালবেলা গাড়ি যাবে আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে গাড়ি আটকে দেবো। ব্যাস্। এতে আশ্চর্যের কি আছে? আমার এরকম উত্তেজনাবিহীন সহজ সরল নির্লিপ্ত উত্তর শুনে দাদা আবার রেগে ব'লে উঠলো, তুই জানিস তুই কার গাড়ি আটকাবি? এর পরিণতি কি হ'তে পারে তুই জানিস? তোর কোনও বোধবুদ্ধি আছে? নাকি সব লোপ পেয়ে গেছে? পরে এর ঠেলা সামলাতে পারবি তো? আমি বললাম, দ্যাখো, আমরা বেকার ছেলেরা সব রাস্তায় বসে থাকি। এই রাস্তার ওপর দিয়ে এই কোম্পানির প্রেসিডেন্ট রোজ ৩৬৫ দিন যান। আমরা যেখানে থাকি আড্ডা মারি সেখান থেকে কোম্পানির গেটের দূরত্ব ৫ মিনিট। আমাদের এই রাস্তার ওপরে যারা রোজ আড্ডা মারে, সময় কাটায় প্রেসিডেন্ট এই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় ও কোম্পানী থেকে ফেরার সময় দু'বেলা আমাদের বসে থাকতে দ্যাখেন। তা উনাকে আমাদের বেকার অবস্থার কথা যদি বলি তাহ'লে দোষ বা অপরাধ কোথায়? অন্যায় কোথায়? আর তিনিই বা কেন শুনবেন না? কারখানা সংলগ্ন এলাকার লোকেদের কোনও অধিকার বা দাবী নেই সেখানে কাজ পাবার?
নিজেকে একটু সামলে নিয়ে রাগ বিরক্তিসহ চাপা গলায় বললেন, তোর এসব দাশর্নিক কথা শোনার মতো প্রেসিডেন্টের সময় আছে? যত্তসব ভাবের কথা, আবেগের কথা। এইকথা ব'লে আমার কাঁধে হাত দিয়ে বললো, তুই ভাবিস না আমি তোর একটা ভালো ব্যবস্থা ক'রে দেবো এই কারখানায়। আমি বললাম, দাদা, ভাবের কথা, আবেগের কথা হয়তো আমি বলেছি কিন্তু আবেগে ভেসে গিয়ে কোনও অসম্ভব আজগুবি অন্যায্য কথা আমি বলিনি। তাছাড়া সামনে আমার এম-এ পরীক্ষা। আমার কথা ভেবে আমি এই সিদ্ধান্ত নিইনি। আমি সত্যিকারের এখানে চাকরী করার কথা ভাবিইনি কোনওদিন। বন্ধুদের কথা ভেবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। ওদের প্রত্যেকের চাকরী দরকার। বাড়ির পাশে এতবড় কারখানা থাকতে তারা চাকরী পাবে না? এইকথায় দাদার রাগ একটু কমলো কিন্তু তবু বলতে লাগলো, দ্যাখ এতবড় কারখানা আর তার প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তার প্রশ্নে পুলিশ প্রশাসনের ওপর চাপ আসবে। আর পার্টিও ছেড়ে কথা বলবে না। আমি দৃঢ়তার সংগে গভীর প্রত্যয় নিয়ে বললাম, আর আমি যে এত পার্টির জন্য খাটলাম তার কোনও মূল্য নেই পার্টির কাছে। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর যে মিছিল, মিটিং, স্লোগান, বক্তৃতা, নাটক, দেওয়াল লিখন, পোষ্টার লাগানো, পথসভা ইত্যাদির সঙ্গে সক্রিয় যুক্ত ছিলাম তার কোনও মূল্য নেই পার্টির কাছে? এত করার পরেও পার্টির কাছে পরিচিত হ'য়ে উঠতে পারলাম না যখন ক্ষমতায় আমাদের সরকার? আমি তো কোনও অন্যায় কাজ করছি না। শুধু গাড়ি থামিয়ে প্রেসিডেন্টকে দু'টো কথা বলবো। একনাগাড়ে এতসব কথা শোনার পর দাদা একদম শান্ত হ'য়ে বললো, তুই পারবি? পরে ভয়ে পিছিয়ে আসবি নাতো? আমি বললাম তোমার যদি কোনও ব্যক্তিগত অসুবিধা না হয়, তোমার যদি একান্তই কোনও আপত্তি না থাকে তাহ'লে আমার কোনও ভয় বা পিছিয়ে আসার ব্যাপার নেই। একটু চিন্তা ক'রে পরে বললো, দ্যাখ (একজন উর্ধতন নেতার নাম ক'রে বললেন) হয়তো তিনি রেগে যেতে পারেন। তবে উনি যদি তখন বাধা দেন, কিছু বলেন উনার সঙ্গে কোনও ঝগড়ায় যাবি না। আমি বললাম, তুমি একটু উনার ব্যাপারটা দেখে নাও বাকীটা আমি সামলে নেব। আমার ওপর ভরসা রাখতে পারো। কোনও বিশৃঙ্খলা বা গন্ডগোল আমার বা আমাদের দিক থেকে বিন্দুমাত্র হবে না। শান্তভাবেই সব শেষ হবে আমি তোমায় কথা দিলাম। তুমি শুধু বাকীটা সামলে দিও। এইবলে তাঁর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম ক'রে বললাম, তুমি আমায় আশীর্বাদ করো আমি যেন সফল হ'ই। তিনি খুশী হ'য়ে হেসে চাপা গলায় বললেন, বেস্ট অফ লাক। তারপরে দুজনে হাঁটতে হাঁটতে সবাই যেখানে বসে আছে সেখানে এলাম।
তারপর দাদার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম নিজের আড্ডার জায়গায়। সেখানে সবাই আমার জন্য অপেক্ষা করছে। তারা এতক্ষণ কি হ'লো জিজ্ঞেস করলো। আমি তাদের শুধু পরের দিনে কি করণীয় সেটা বুঝিয়ে দিয়ে যে যার বাড়ি চলে এলাম।
( লেখা ১১ই জুন'২০২৩)
No comments:
Post a Comment