Powered By Blogger

Wednesday, June 11, 2025

আত্মকথন ১০

কিছুক্ষণ হতভম্ব হ'য়ে দাঁড়িয়ে রইলো এলাকার দোর্দন্ডপ্রাতাপ দাদার ডানহাত বিজনেস পার্টনার। তারপর সে পিছন পিছন হন্তদন্ত হ'য়ে এসে আমার হাতটা ধ'রে টান দিল। আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। বন্ধুদের বললাম এগিয়ে যাওয়ার জন্য। তারপরে বললাম, বলো। সে উৎকণ্ঠা মিশ্রিত গলায় কৌতুহল ভরে বললো, কাল সকাল ন'টায় কি করবি? আমি হাসতে হাসতে নির্দ্বিধায় নির্বিকারভাবে বললাম, কাল প্রেসিডেন্টের গাড়ি আটকাবো, ঠিক ন'টায়। ভয় পেয়ে গিয়ে সে বিস্ময়ে চোখ বড় বড় ক'রে বললো, কোম্পানীর প্রেসিডেন্টের গাড়ি!? আমি বললাম, হ্যাঁ। তারপরে জোরে চিৎকার ক'রে ব'লে উঠলো। তুই পাগল হ'য়ে গিয়েছিস? এই চিৎকারে চারপাশের সবাই তাকিয়ে আছে দেখে গলার স্বর নাবিয়ে ধীর অথচ অশান্ত গলায় বললো, বাপী এতবড় রিস্ক নিস না। বিরাট ক্ষতি হ'য়ে যাবে। পুলিশ-প্রশাসন-পার্টি-নেতা-গুন্ডা এত চাপ সামলাতে পারবি না। প্রচন্ড ঝামেলা হবে। আজ পর্যন্ত কেউ কোম্পানির প্রেসিডেন্টের গাড়ি আটকাতে সাহস করেনি। এই ভুল তুই করিস না।

আজ লিখতে বসে মনে পড়ছে আমার ভালোর জন্যেই সে সাবধান করেছিল। আমাকে ভালোবাসতো সেই দাদা। প্রতিদিন একসঙ্গে পুকুরে দুপুরবেলায় স্নান করতাম। দুধে আলতা ফর্সা, লোহা পেটানো চেহারা ছিল তার। আর হাত দু'টো ছিল অ্যায়সা তাগড়াই মোটা। আজও মনে পড়ে তার খাঁজ কাটা বুকে, হাতে, থাইয়ে হাত বুলিয়ে বলতাম, সারা শরীর জুড়ে ছোট ছোটো পাহাড় আর উপত্যকার বাহার! আর, সে কথা শুনে আমাকে বলতো, তুই তো ছুপা রুস্তম! নিজেকে সবসময় ঢেকে রাখিস। সত্যি কথা বলতে কি আমিও শরীর চর্চা করতাম। ফুলফ্লেজে করতাম। কিন্তু ফুলহাতা জামা ও গেঞ্জি ছাড়া যৌবনে কোনওদিনই কিছু পড়িনি। পায়জামা পাঞ্জাবী ছিল আমার প্রিয় পোশাক। যৌবনের শেষে প্রৌঢ়ত্বে এসে হাফ হাতা জামা ও গেঞ্জি পড়েছি স্ত্রীর কথায়। স্ত্রী অনেকদিন বলতো কোনোদিনই তো হাফহাতা জামা বা গেঞ্জিতে তোমায় দেখলাম না একবার দু'বার পড়লে কি হয়? ভাবলাম কথাটায় আপত্তির কি আছে!? তাই পড়লাম।

যাই হ'ক শীতকালে তেল মেখে আমার বাড়ির পাশে পুকুরপাড়ে বসে রোদ পোয়াতাম আর আখ চিবাতাম দাদা-ভাই মিলে দু'জনে। আস্তে আস্তে জুটে যেত একে একে অনেকে। আখ চিবানো শেষে সবাই স্নান ক'রে যে যার বাড়ির দিকে চলে যেতাম। সেখান থেকে গড়ে উঠেছিল একটা ঘনিষ্ঠতা।

যাই হ'ক, আমি চুপ ক'রে তার সত্য ও ভয় ধরানো সব কথা শুনে শান্ত স্বরে শুধু হালকা হাসি ঠোঁটে মাখিয়ে বলেছিলাম, কাল সকাল ন'টা। ব'লেই মুখ ঘুরিয়ে হাঁটা দিয়েছিলাম। শুনতে পাচ্ছিলাম আমার নাম ধ'রে তার ডাক। পিছন ফিরে আর তাকাইনি। বোধহয় বরাবর মাথা উঁচু ক'রে চলার জোশ আমাকে তাড়িয়ে বেড়াতো।

তারপর নিজের ডেরায় এসে বসলাম। মুড়ি চানাচুড় খেতে খেতে বন্ধুরা বললো, কিরে কাল সকাল ন'টায় কি করবি? আমি বললাম তোরা থাকবি তো আমার সঙ্গে? বুঝলাম ঝামেলার গন্ধ পেয়ে পিছিয়ে যেতে চাইছে। আমি বললাম, কাল সবার একটা চাকরীর ব্যবস্থা করবো। আর সঙ্গে সঙ্গেই সবাই উৎসুক হ'য়ে আনন্দে হৈ হৈ ক'রে উঠে জিজ্ঞেস করলো, কাল কি করতে হবে? আমি তাদের সংক্ষেপে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললাম। আর তখনি রাস্তার ওপার থেকে একজন সাইকেল থেকে নেবেই চীৎকার ক'রে আমার নাম ধ'রে ডাক দিয়ে বললো, বাপী, ----দাদা তোকে ডাকছে। এক্ষুনি চল। তখন সবে আলুর চপে এক কামড় বসিয়েছি, পাশে গরম চা। আমি বললাম তুই যা, আমি যাচ্ছি। ও বললো, না না তুই এক্ষুনি চল। তোকে সঙ্গে নিয়ে যেতে বলেছে। দাদা তোর জন্য অপেক্ষা করছে। এক্ষুনি দেখা করতে বলেছে।

আমি সবাইকে অপেক্ষা করতে ব'লে ওর সঙ্গে চপ খেতে খেতে চললাম হাঁটতে হাঁটতে। ওরও হাতে একটা চপ ধরিয়ে দিলাম। সাইকেলে চড়তে বললো বন্ধু। আমি 'না' বললাম। কারণ প্যান্টে সাইকেলের দাগ লেগে যাবে বলে। বন্ধু বললো, শালা রাজার বেটা। সবসময় শালা স্যুটেড বুটেড থাকতে হবে? আমি হেসে বললাম তুই সাইকেলে চলে যা আমি হেঁটে হেঁটে আসছি। বন্ধু কিছু না ব'লে আমার সঙ্গে হাঁটতে লাগলো। আমি হাসতে হাসতে বললাম, দ্যাখ, বাবার হোটেলে খাই আর শালা এক্কেবারে রাজার বেটার মতো সবসময় ফিটফাট চলাফেরা করি। সোনার চামচ নিয়ে না জন্মালেও রুপোর চামচ নিয়ে জন্মেছি বুঝেছিস। আসলে সবসময় নিজেকে ফিটফাট রাখতে ভালো লাগে বুঝলি। কোনওদিনই এলোমেলো আগোছালো চলা ভালো লাগে না। শরীরচর্চা, খেলাধুলা, অভিনয়, পড়াশুনা, রাজনীতি ইত্যাদি আরো অনেক কিছু নিয়ে ব্যস্ত রাখি নিজেকে। তুই তো জানিস, দেখিস সব।

ও শুধু বললো, এলাকার দাদা হ'য়ে উঠছিস। আর কিছু না ব'লে চুপচাপ হাঁটতে লাগলো। আমি হাসতে হাসতে বললাম, দাদা না গুন্ডা! তবে ধর্ম্মগুন্ডা। তারপর আর কোনও কথা না বলে আমিও হেঁটে চললাম পাশাপাশি চুপচাপ। ( লেখা ১১ই জুন'২০২৩)

No comments:

Post a Comment