এতদিন সেই যে স্কুল লাইফ ছেড়ে কলেজ জীবনে প্রবেশ ও তারপরে বৃহত্তর বাইরের জগতে যাদের সঙ্গে মেলামেশা করেছি তারা সবাই রাতারাতি অপরিচিত হ'য়ে গেল দেখে বিশ্বাস হ'লো না যে বাস্তব এত নির্ম্মম! মানতে চাইলো না মন। আবার চিঠিটাকেও অস্বীকার করার উপায় নেই। খাঁচায় বন্দী প্রাণীর ছটফটানির ভয়ঙ্করতা বোধের মধ্যে ধরা দিল। ভিতরে ঝড় ব'য়ে যাচ্ছে কিন্তু উপরে জোর ক'রে নিজেকে ধ'রে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা বুঝতে পারলাম চোখেমুখে ফুটে উঠছে। কি ক'রে আটকাবো তাকে ভাবতে ভাবতে মাথার ভিতরের স্নায়ূ ছিঁড়ে যেতে চাইলো। কি বলবো বাড়িতে? সদ্য সদ্য বাড়িতে বাবার মৃত্যুর রেশ এখনও তাজা হ'য়ে রয়েছে ঘরের চারপাশে। আমি জানি দাদারা সব জেনে যাবে। কিন্তু মাকে জানাবো কি ক'রে? কি ক'রে বলবো যে মা, আমার আর চাকরী নেই? কি ক'রে বলবো, আমি মারামারি করার অপরাধে সাসপেন্ড হয়েছি?
আমি চাকরীতে জয়েন করেছিলাম ৭৭ সালের শেষ দিকে দূর্গাপুজোর ঠিক একমাস আগে। আর সাসপেন্ড হ'য়েছিলাম ৭৯ সালের পুজোর আগেই। আর সাসপেন্ড হওয়ার সাথে সাথেই আমার এলাকার সবাই যারা একই কোম্পানিতে কাজ করতো তারা কথা বলা বন্ধ ক'রে দিল। আমি অচ্ছুৎ হ'য়ে গেলাম। আমি যেন এক সংক্রামক ব্যাধির রুগী! অ্যাম্বুলেন্সের গায়ে যেমন লেখা থাকে 'শুধুমাত্র সংক্রামক ব্যাধির জন্য' ঠিক তেমনি আমি হ'য়ে গেলাম পাড়ায় ও কারখানায়। যারা কোম্পানিতে চুরি-চামারি-নেশাভাং-মারামারি এবং কোম্পানি অফিসার বা নেতাদের ব্যাক্তিগত রোষের কারণে সাসপেন্ড হ'য়ে যায় তারা পথেঘাটে দেখা হ'লে কথা বলতো, জিজ্ঞেস করতো কিছু সমাধান হ'লো কিনা। সবচেয়ে কষ্ট হয়েছিল যাদের চাকরী আমার ঐ প্রেসিডেন্টকে দেওয়া নামের লিস্টের ভিত্তিতে হয়েছিল তারা কেউ আর যোগাযোগ রাখতো না পারতপক্ষে।
অথচ এদের জন্যই জীবনে অনেক বড় ঝুঁকি নিয়েছিলাম। ঝুঁকি নিয়েছিলাম নিশ্চিত মৃত্যুকে বা নিদেনপক্ষে ভয়ংকর শারীরিক ক্ষয়ক্ষতিকে স্বীকার করেই জোশ-সাহস আর মহৎ এক উদ্দেশ্যকে হাতিয়ার করেই। পরবর্তী আত্মকথনে সেটা বর্ণনা করবো আর সেখানেই একসময়ের এশিয়ার তথা ভারতের একমাত্র স্বয়ং সম্পূর্ণ ২৫ হাজার কর্মচারীর প্রেসিডেন্টের সংগে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতার কাহিনী তুলে ধরবো।
যাই হ'ক, এলাকার যারা এমপ্লয়ী ছিল ওই কারখানার তাদের কাছে আমি হ'য়ে গেলাম ভয়ানক অপরাধী। তারা এলাকার দাদাকে নাকি ইউনিয়নের নেতাকে নাকি কোম্পানীর পারসোনাল ডিপার্ট্মেন্টে কর্মরত আমার ঐ একই এলাকায় বসবাসকারী আমার দূরসম্পর্কের মামাকে কা'কে খুশি করতে যে আমাকে বয়কট করেছিল তা ভেবে কূলকিনারা পেতাম না। মোটকথা আমাকে একা ক'রে দেওয়ার একটা চেষ্টা শুরু হ'লো পাড়ায় ও কারখানায়। এটা যে একটা গোপন ষড়যন্ত্র আর সেই ষড়যন্ত্র যে মানসিক চাপ সৃষ্টি ক'রে ক'রে আত্মবিশ্বাস, জোশ, কর্মক্ষমতা, উৎসাহ-উদ্দীপনা ইত্যাদি একটা মানুষের সমাজে মাথা উঁচু ক'রে বাঁচার গুণাবলী নষ্ট ক'রে নেতা বা দাদাদের ওপর নির্ভরশীল ক'রে তাদের আজ্ঞাবাহ দাসে বা লাঠিতে পরিণত ক'রে স্বাধীন ব্যক্তিত্বকে পঙ্গু ক'রে দেওয়ার নোংরা ষড়যন্ত্র তা বুঝেছিলাম দেরীতে, সময়ের পরতে পরতে। সময় সবসে বড়া বলবান জানি কিন্তু
কারখানায়-পাড়ায় আর ঘরে ঘরে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে
বিশ্বাসদার চাকরী গেছে মারামারি-গুন্ডামীর কারণে।
( লেখা ১১ই জুন' ২০২৩)
No comments:
Post a Comment