Powered By Blogger

Wednesday, June 11, 2025

আত্মকথন ৬

সেই সময়টা ছিল সবে বাম জমানার সূত্রপাত। ১৯৭৭সাল। সিপিএম রাজ্যে ক্ষমতা দখল করেছে ও সরকার গঠন করেছে। সেইসময়ের বাম আন্দোলনের সঙ্গে ছিলাম জড়িয়ে, ছিলাম গণনাট্যের সঙ্গে। মিছিল, মিটিং, স্লোগান, বক্তৃতা সবেতেই ছিলাম অগ্রণী ভুমিকায় সক্রিয়ভাবে। অনেক ঘটনাপ্রবাহ ব'য়ে যাচ্ছে মনের মধ্যে। সেই সূত্রে এলাকার পার্টির সব নেতাদের সঙ্গেই ছিল গভীর ও সুসম্পর্ক। এলাকার সেই দন্ডমুন্ডের কর্তা তিনিও ছিলেন সেই দলের সদস্য। আমার বড়দাও ছিলেন পার্টির আমৃত্যু মেম্বার। এলাকার সেই প্রভাবশালী দাদা আমাকে ক'দিন অপেক্ষা করতে বললেন। এদিকে সময় চলে যাচ্ছে। এমনিভাবে বেশ কয়েকদিন চলে গেল। পনেরো দিনের মধ্যে উত্তর দিতে হবে। কি করবো কিছুই স্থির করতে পারছি না, নিতে পারছি না কোনও সিদ্ধান্ত। কেউ পাশে এসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলছেনা, আয় আমার কাছে। যে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে কথা বলেছি, চলে গেছি যার অফিস ঘরে চাকরী পাওয়ার আগে সরাসরি বেশ কয়েকবার, কথা বলেছি একান্তে সাহসের সঙ্গে, দাপটের সঙ্গে সেখানে যেতে গিয়েও কোথায় জানি একটা অদৃশ্য বাধা পাচ্ছি যাতে তাঁর কাছে যেতে না পারি, জানাতে না পারি সমস্যার কথা। ঘুরপাক খাচ্ছি কেবল লাট্টুর মতো।

ক'দিনের মধ্যেই সব ও সবাইকে অপরিচিত মনে হ'তে লাগলো। আমি বুঝতে পারছি সময় চলে যাচ্ছে। জোর ক'রে যে সবাইকে অস্বীকার ক'রে চলে যাবো প্রেসিডেন্টের ঘরে সেখানেও যেন কনফিডেন্স হারিয়ে ফেলছি ধীরে ধীরে। চিড় ধরছে আত্মবিশ্বাসে। শুধু তাই নয় মনে হ'লো সিকিউরিটিরাও কারও গোপন নির্দেশে যেন তৎপর যাতে প্রেসিডেন্টের ঘরের দিকে যেতে না পারি। নিজের বক্তব্য যে নিজে লিখে জমা দেবো তাও দিতে পারছি না।

ক'দিন পর এলাকার সেই দাদা আমাকে ইউনিয়নের সেক্রেটারির সঙ্গে দেখা করতে বললো। আর, ইতিমধ্যে ইউনিয়ন থেকেও আমাকে ডেকে পাঠিয়ে বলা হ'লো জেনারেল সেক্রেটারিকে বিষয়টা জানাতে। গেলাম সেখানে। তাকেও বললাম সত্য যা ঘটেছে। তিনি শুনলেন। কিছু বললেন না। শুধু বিজ্ঞের মতো বললেন, কোম্পানি প্রেমিসেসের ভেতরে মারামারি করেছেন তার জন্য কোম্পানি তার মতো ব্যবস্থা নেবে। আমি বললাম, আমি তো আপনাকে সত্য ঘটনা বললাম। তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন, বললেন, ইউনিয়নের তরফ থেকে চিঠি যাবে। আমি বললাম আমাকে পারসোনাল অফিস থেকে বলা হয়েছে উত্তর দিতে। আমি সত্য যা ঘটেছে তাই লিখে জানাই। তিনি একটু বিরক্ত হ'য়ে বললেন, সব যদি অত সহজ হ'তো তাহ'লে ইউনিয়নের আর দরকার হ'তো না। তারপরে আমার থেকে শো-কজের লেটারটা চেয়ে নিয়ে বললেন, আপনি এখন যান, আপনাকে সময়মতো ডেকে নেওয়া হবে।

আমি চুপ ক'রে উনার অফিস থেকে বেরিয়ে এলাম।

বাইরে বেরিয়ে এই প্রথম চারপাশের দিকে তাকিয়ে মনে হ'লো আমি একা। কেউ নেই কোথাও। যেদিকে তাকাচ্ছি মনে হ'লো সবাই যেন কেমন অদ্ভুত চোখে তাকাচ্ছে আর নীরব মজা নিচ্ছে। অফিসে, পাড়ায় সবাই এড়িয়ে চলতে লাগলো। এই প্রথম নিজেকে একা সঙ্গীহীন মনে হ'লো।

এইভাবে কেটে গেল পনেরোদিন। তারপর একদিন পোষ্টম্যান হাতে ধরিয়ে দিয়ে গেল আর একটা রেজিস্ট্রি চিঠি। খুলে দেখলাম আমাকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। লেখা রয়েছে, কোম্পানির শো-কজের উত্তরে আমাকে সাসপেন্ড না করার কারণ কোম্পানির কাছে গ্রাহ্য না হওয়ায় অনির্দিষ্ট কালের জন্য সাসপেন্ড করা হ'লো। কোম্পানির নিয়ম মতো পরবর্তী প্রক্রিয়া চালু থাকবে।

আমি কর্মহীন ভবঘুরে হ'য়ে গেলাম। ( লেখা ১১ই জুন' ২০২৩)

No comments:

Post a Comment