সেদিনটা ছিল আর দশটা দিনের মতো স্বাভাবিক দিন। সকালটা ভালোভাবে কেটে গেলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মাথার ভেতরটা কে যেন চেপে ধরছে মনে হ'লো। কয়েকদিন ধ'রে শরীরটাও ফুরফুরে ছিল না। কেমন জানি হাত, হাতের আঙ্গুলগুলি ঝিনঝিন করতো। রাতের দিকে ঘুমের মধ্যে মাথার ভেতরটা ঝন ঝন ক'রে উঠে ঘুমটা ভেঙ্গে যেত। তারপর শুরু হ'লো ভোরের দিকে ঘুম ভাঙলে দুই হাতে ঝাঁকুনি। এমনিভাবে কেটে গেল বেশ কিছুদিন। খুব একটা গুরুত্ব দিতাম না। ক'দিন পর মনে হ'লো ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে যাচ্ছে। তাই ঠিক করলাম ডাক্তারকে একবার দেখিয়ে নিই। ডাক্তারকে দেখালাম। ডাক্তার প্রেস্ক্রিপশান করলো। প্রেসারের ওষুধ দিল, সঙ্গে দিল নার্ভের ভিটামিন ও আরও কয়েকটা ওষুধ। কিছুদিন পর আরও একবার দেখালাম। দেখে ওষুধ চেঞ্জ ক'রে দিল, প্রেসারের ডোজ দিল বাড়িয়ে, সঙ্গে রেফার ক'রে দিল নিউরোলজিস্ট ডাক্তারকে দেখাবার জন্য।
এমনিভাবেই কেটে গেল আরও কিছুদিন। বুঝতে পারছিলাম সমস্যাটা একটু একটু ক'রে বাড়ছে। বেশ কিছুদিন ধ'রে নানারকম চিন্তা মাথাটাকে চেপে ধরছিল। ইষ্টপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নিজেদের মধ্যে আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রতিনিয়ত সংঘাত, জন্ম থেকে এই বয়স পর্যন্ত নিজের পৈতৃক বাড়ি ছেড়ে, এলাকা ছেড়ে ছেলের কেনা ফ্ল্যাটে নিজের প্রিয়জনদের ছেড়ে চলে আসা ও আরো অনেক স্মৃতি শরীর মনকে আচ্ছন্ন ক'রে রাখতো সবসসময়। বিশেষ ক'রে আমাকে আচ্ছন্ন ক'রে রেখেছিল তিন বছরের একটা ছোট্ট শিশু। যে আমার পুরোনো বাড়িতে আমার সবসময়ের ছিল সঙ্গী। সে ছিল আমার ছোট্ট নাতি, আমার সোনাবাবা। আমার ভাইপো অর্থাৎ ছোড়দার নাতি। সঙ্গে আরও একজন ছিল সে আমার আর এক ভাইপো অর্থাৎ আমার বড়দার নাতনি, আমার সোনামা। মানে উভয়েই আমার সম্পর্কে নাতিনাতনি।
যাই হ'ক সেই প্রতিদিনের একই ছাদের তলায় থাকার যে বিচ্ছেদ তা আমাকে অস্থির ক'রে রাখতো সবসময়। শ্রীশ্রীআচার্যদেবের সহধর্মিনী বড় বৌরাণীমা আমাকে সেই মায়ার বাঁধন থেকে বেরিয়ে এসে স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে আসার কথা বলতেন। কিন্তু মধুর সেই স্মৃতিগুলি আমাকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রাখতো সবসময়। একটা ঘোরের মধ্যে থাকতাম আমি যা কাউকে বোঝাতে পারতাম না। আমার মানসিক অবস্থা বুঝতে পেরে মিষ্টি ক'রে সহানুভূতির স্বরে বড়বৌরাণীমা বলেছিলেন আমার মেয়েকে, "উনি তো বেরিয়েই আসতে চান না ঐ স্মৃতি থেকে, চেষ্টা কি আর করবে।" সেদিন আমি কিছু বলতে না পেরে চুপ ক'রে বসেছিলাম তাঁর সামনে। তিনি আমার দিকে করুণ স্নেহ ঝরা চোখে চেয়েছিলেন অনেকক্ষণ। এই না বেরিয়ে আসার অক্ষমতার জন্য আমার চোখের দৃষ্টি একেবারে ঝাপসা হ'য়ে এলো।
তারপর দিন কেটে যায় একদিন দু'দিন ক'রে অনেকদিন। শারীরিক অস্থিরতা বাড়তে থাকে ক্রমশঃ। বাড়তে বাড়তে এমন অবস্থায় যায় আমি ভয় পেয়ে যায় প্রচন্ড। সারাদিন যা না কষ্ট অসুবিধা হ'তো তার থেকে অনেক অনেক গুণ বেশী হ'তো রাতে ঘুমের মধ্যে আর ভোরবেলায় ঘুম ভাঙলে। রাতে ঘুমের মধ্যে এসে ভিড় করতো নানাবিধ চিন্তা। পাখির পালকের মতো সেই চিন্তাগুলি এলোমেলো ঝাপটা মারতো মাথার মধ্যে। আর সবচেয়ে কষ্ট শুরু হ'লো যখন শুরু হ'লো প্রতিদিন ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখা। সে কি অসহ্য যন্ত্রণা। অর্থহীন স্বপ্ন যার কোনও শুরু নেই শেষ নেই, মাথামুন্ডূহীন স্বপ্ন! জটিল প্রচন্ড গিঁট পাকানো স্বপ্ন! গিঁট পাকানো স্বপ্নের কোথায় মাথা আর কোথায় লেজ তার কোনও সন্ধান পেতাম না। স্বপ্নের মধ্যে সবসময় অন্ধকার, অত্যন্ত সংকীর্ণ পথ, জনশূন্য বিস্তৃত স্থান ঘিরে আমার অবস্থান। তার মধ্যে দিয়ে আমি হেঁটে চলেছি! প্রচন্ড এক ভয়, দমবন্ধ হওয়া এক নিদারুণ ভয়ঙ্কর চাপ হার্টের ওপর চেপে বসতো। মনে হ'তো এই বুঝি বেরিয়ে যাবে প্রাণবায়ু। ধড়ফড় ক'রে উঠে বসতাম বিছানার ওপর। সারা শরীর ঘেমে নেয়ে উঠতাম। চুপ ক'রে বসে থাকতাম বিছানায় আর দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলতাম। তারপর উঠে চলে যেতাম ঠাকুরঘরে। চুপ ক'রে বসে থাকতাম ঠাকুরের সামনে। সঙ্গে চলতে থাকতো অনবরত নাম। এ তো একধরণের সমস্যা। আরও একটা সমস্যা হ'তো মাথার মধ্যে। তা হ'লো কে যেন হঠাৎ হঠাৎ হাতুড়ি দিয়ে মারতো মাথায়। দড়াম্ দড়াম্ ক'রে উঠতো মাথার মধ্যে। ঝাঁকিয়ে উঠতো মাথাটা। আর ভোরবেলা হ'ত ঘোড়ার দৌড়। দু'হাত দিয়ে কাঁধ থেকে হাতের আঙুল পর্যন্ত উপর থেকে নীচে ঝনঝন ক'রে ছুটে যেত কাঁপুনি। মনে হ'তো রক্ত ঘোড়ার মতো দৌড়ে নাবছে উপর থেকে নীচে। আঙুলগুলি ঝিনঝিন করতো। কেঁপে কেঁপে উঠতো সমস্ত শরীর। তাড়াতাড়ি উঠে বসতাম ঘুম চোখে। কি এক কষ্টের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলাম তা বোঝানোর ভাষা আমার নেই। সাপের ছোবল যে খায়নি সে জানে না সাপের বিষের জ্বালা কি।
যাই হ'ক, এমনিভাবেই কষ্টের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল দিনগুলি। হঠাৎ ঝুপ ক'রে নেবে এলো শরীর আর মন জুড়ে অবসাদ, অবসন্নতা, ক্লান্তি আর অসুস্থতা। একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে গেল জীবন চক্র। ঘরে হ'য়ে গেলাম বন্দী। বই পড়া, লেখালেখি সব হ'য়ে গেল বন্ধ। লিখতে গিয়ে মাথার ওপর প্রচন্ড চাপ পড়তো লেখা নিয়ে চিন্তার কারণে। কম্পিউটার হ'য়ে গেল চোখের বিষ। ছোট ছোট বিষয় তীব্র দুশ্চিন্তার কারণ হ'য়ে উঠলো। ঘুম থেকে উঠে আবার রাতে ঘুমোতে যাওয়া পর্যন্ত এবং ঘুমের মধ্যেও ছোটো থেকে ছোটো, বড় থেকে বড় নানা বিষয়ে আগাম দুশ্চিন্তা এসে প্রচন্ড ঝাপটা মারতো মনের মধ্যে। বাইক চালানো মানুষ বাইক তো দূরের কথা সাইকেল চালালে হাত কাঁপত। রাস্তা দিয়ে হাঁটলে মনে হ'তো রাস্তাটা দুলে উঠছে। এমতোবস্থায় বাড়ির লোক নিয়ে গেল নিউরোলজিস্টের কাছে।
যেদিন নিউরোলজিস্টের কাছে গেলাম সেদিন চেম্বারের পরিবেশ আমাকে আতংকিত ক'রে তুললো। দেখলাম চেম্বারের বাইরে চেয়ারে সব বসে আছে নিউরো পেশেন্ট আর সঙ্গে তাদের লোকজন। এক জন ক'রে নাম ডাকা হচ্ছে আর বাইরেই ডাক্তারের লোকজন তাদের প্রেসার, অক্সিজেন মাত্রা চেক ক'রে ও ওজন মেপে নিয়ে লিখে নিচ্ছে। তারপর কাঁপতে কাঁপতে ঢুকে যাচ্ছে ছেলে, মেয়ের হাত ধ'রে চেম্বারে। তারপর পাঁচ মিনিট পরেই আবার বেরিয়ে আসছে কাঁপতে কাঁপতে বাইরে সঙ্গে আরো পরীক্ষা নিরীক্ষা ও নোতুন ওষুধের লম্বা প্রেস্ক্রিপশান হাতে নিয়ে।
এইসব দেখতে দেখতে মনে হ'লো আমারও পরিণতি এমন হবে? এত ঠাকুরের কাজ নিয়ে থাকার পর দিন শেষে অবশেষে আমাকেও এভাবে কাঁপুনি, ডাক্তার আর ওষুধ নির্ভর হ'য়ে বাকী জীবন কাটাতে হবে? কাটাতে হবে বৌ, বৌমা আর ছেলের উপর নির্ভর ক'রে, পরনির্ভরশীল হ'য়ে!?
যখন চেম্বারে ঢুকলাম একগাল হেসে ডাক্তার সামনে রাখা চেয়ারে বসতে বললো। আমি তাঁর সামনে রাখা একটা টুলে বসলাম। তিনি হেসে বললেন, কি হয়েছে বলুন। আমি আমার কথা সবিস্তারে বললাম। তিনি হাসিমুখে সব শুনলেন তারপর একটা হাতুড়ি দিয়ে পা থেকে মাথা পর্যন্ত হাতুড়ি দিয়ে ঠক ঠক ক'রে মেরে কি যেন বোঝার চেষ্টা করলেন তারপর প্রেসক্রিপশান লিখতে শুরু করলেন। লেখা শেষ ক'রে দিন পনেরো পরে লিখে দেওয়া সমস্ত রিপোর্ট নিয়ে আসতে বললেন। তারপর হাসতে হাসতে অনেক কথা বললেন, মনে জোর দিলেন, প্রবোদ দিলেন তারপর হ্যান্ডশেক ক'রে বললেন, কোনও চিন্তা নেই, সব ঠিক হ'য়ে যাবে।
ডাক্তারের ব্যবহার আমায় মুগ্ধ করলো। বেশ ভাল লাগল শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাঁর আচরণ। আমাকে বিদায় দেওয়ার পর তাঁর কম্পাউন্ডার পরবর্তী পেশেন্টের নাম ধ'রে ডাকলেন। আমি ধীরে ধীরে চেম্বারের বাইরে বেরিয়ে এলাম। তারপর বাইরে অফিসে প্রেস্ক্রিপশান দেখানোর পর তাঁরা আমাকে ইসিজি ও হার্ট এক্সরে ক'রে নিতে বললেন। আমি সেইমতো ইসিজি ও হার্ট এক্সরে ক'রে নিলাম সেইখানেই। তারপরে অন্য আর একজায়গায় (M R I)) ব্রেন এক্সরে ও নানারকম রক্ত পরীক্ষা করাতে হ'লো। সমস্ত রিপোর্ট পেলে দিন পনেরো পরে আবার যেতে হবে চেম্বারেে। এরপরে বাড়ি ফিরে এলাম।
এরপরে শুরু হ'লো ওষুধ খাওয়ার পালা। প্রেস্ক্রিপশান অনুযায়ী একটা ওষুধ খাওয়ার চারদিন পর আমি একবারেই ঝিমিয়ে পড়লাম। যাও চ'লে ফিরে বেড়াতাম এবার আর বিছানা থেকেই উঠতে ভালো লাগতো না। বাকী ওষুধ খেতে ভয় লাগছিল।
( ২৮শে নভেম্বর' ২০২২ )
ক্রমশ
No comments:
Post a Comment