সময়টা ৭০দশক। সম্ভবত বাম জমানার শুরুর (১৯৭৭) পরেই। আমার বয়স তখন সম্ভবত ২৪-২৫। বাম আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলাম। মিছিল, মিটিং, স্লোগান, নাটক ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রচন্ড সক্রিয় অবস্থানের পরে সবে একটু থিতু হয়েছি, সেই সময় মনে হ'লো আমার প্রিয় লেখক সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কথা। তাঁর সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা তীব্র মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। উঠলো দু'টো কারণে। একটা তিনি আমার প্রিয় লেখক, দ্বিতীয়ত তিনি ছিলেন শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের দীক্ষিত, আমার শ্রদ্ধেয় গুরুভাই। তাঁর 'ঘুণ পোকা' উপন্যাস আমি প্রথম পড়ি। এবং ঘুণ পোকায় আক্রান্ত হ'য়ে একেবারে ঝুরঝুরে হ'য়ে যাই। তারপরে 'কাগজের বউ, দূরবীন, যাও পাখি, রঙ্গীন সাঁকো, পারাপার' ইত্যাদি নানা উপন্যাস পড়ে ফেলেছি। এখন আর সব মনে পড়ে না। পড়াও হ'য়ে ওঠে না। তবে 'ঘুণ পোকা' একেবারে শরীরে-মনে বিরাট প্রভাব ফেলেছিল। একটা শীর্ষেন্দু ফোবিয়া কাজ করছিল তখন আমার তরুণ তাজা রক্তে। সঙ্গে সমানভাবে পড়া চলছিল সৎসঙ্গ প্রকাশিত আলোচনা পত্রিকায় অনুলেখক শ্রদ্ধেয় প্রফুল্লদা, রেবতীদা, মণিলালদা, দেবীদা সংকলিত শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের কথোপকথন সমৃদ্ধ বিভিন্ন লেখা। অদ্ভুত একটা মিল, ছন্দ খুঁজে পাচ্ছিলাম শীর্ষেন্দুবাবুর লেখায়।
তাই, ছুটে গেছিলাম আনন্দবাজার পত্রিকা অফিসে দু'দুবার। কিন্তু দু'বারই তিনি অফিসে না থাকায় দেখা হয়নি। দ্বিতীয়বার যখন গেছিলাম তখন দেখা হয়েছিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে। আমি তখন তাঁকে চিনতাম না। একজনকে শীর্ষেন্দুবাবুর কথা জিজ্ঞেস করায় জানতে পেরেছিলাম তিনি অফিসে নেই, কিন্তু কোথায় তিনি বসেন জিজ্ঞেস করায় তিনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর বসার চেয়ারটা। তার একটু দূরে বসেছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। অফিসের সেই ব্যক্তিকে সুনীলবাবুকে দেখিয়ে 'উনি কে' জিজ্ঞেস করায় ঐ ব্যক্তি আমাকে বলেছিলেন, উনি কবি, সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। সেই সময় একটা দু'টো তাঁর লেখা উপন্যাস যে পড়িনি তা নয়। কিন্তু এখন আর মনে পড়ে না। লাইব্রেরী থেকে অনেক লেখকের বই এনে পড়তাম। থ্রিলার, গোয়েন্দা উপন্যাস ইত্যাদি আরও নানারকম বই পড়তাম। সুনীলবাবুর দিকে এগিয়ে গেলাম এই ভেবে যে, এতবড় একজন বিখ্যাত লেখক, কবি সামনে ব'সে আছেন একবার তাঁর সঙ্গে দেখা ক'রে যাই। একজন বিখ্যাত লেখকের দেখা পায়নি তো কি আছে আর একজন বিখ্যাত লেখকের তো দেখা পেলাম। কাছে যাওয়ার সময় শীর্ষেন্দুবাবুর চেয়ারটা ছুঁয়ে প্রণাম করলাম। তিনি মাথা তুলে আমার দিকে অবাক চোখে তাকালেন। আমি তাঁর কাছে গিয়ে তাঁকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম। পায়ে হাত দিয়ে যে প্রণাম নিষেধ আমার ঠাকুরের তখন সেইমুহুর্তে সেটা মাথায় ছিল না। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে হেসে আমার নাম জিজ্ঞেস করলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন কাউকে খুঁজছি কিনা। আমি উনাকে আমার আসার কারণাটা বললাম। উনি আমায় শীর্ষেন্দুবাবু অফিসের কাজে বাইরে কোথায় গেছেন সেটা বললেন। এখন আর সে কথা মনে নেয়। তারপর তিনি আমাকে দাঁড়িয়ে আছি দেখে সামনের একটা চেয়ার দেখিয়ে বসতে বললেন। আমার মত অপরিচিত অখ্যাত যুবকের প্রতি উনার আন্তরিকতায় আমি অভিভূত হ'য়ে গেছিলাম। আমি উনার সামনে বসতে সঙ্কোচ বোধ করছিলাম। অবশেষে বসলাম।
উনি তখন কি যেন লিখছিলেন মাথা নীচু ক'রে। একটু চুপ ক'রে থাকার পর অনেক গল্প হ'লো। শীর্ষেন্দুবাবুর প্রিয় পাঠক জেনে খুশী হলেন। উনারও কয়েকটা উপন্যাস পড়েছি সেটাও উনাকে বলেছিলাম। তারপর কথায় কথায় আমিও যে শীর্ষেন্দুবাবুর মতো ঠাকুরের দীক্ষিত সে কথাও জানালাম। আলোচনায় একইসঙ্গে বাম আন্দোলনে অংশ নেওয়া ও শ্রীশ্রীঠাকুরের জীবন দর্শন ভালো লাগা উঠে এলো। তখন সদ্য সদ্য বাম আন্দোলনের একটা তীব্র বাতাবরণ এবং আমার মধ্যে তা'তে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ার একটা গর্ব ফুটে উঠছিল আমার কথায়, চোখেমুখে। লেখালেখির বিষয়েও কথা উঠলো। উনি সব শুনলেন লিখতে লিখতে, কখনোবা মাথা তুলে। একটু অবাক হচ্ছিলেন আমার যৌবন বয়সে একইসঙ্গে বাম আন্দোলন এবং ধর্ম ও ঈশ্বর বিশ্বাস, সাথে গুরুগ্রহণ দু'টো পরস্পর বিরোধী বিষয়ের প্রতি সমান তীব্রতা দেখে! তখন তাঁর চোখমুখের অভিব্যক্তি দেখে যা বুঝেছিলাম তাই লিখলাম, ভুলও হ'তে পারে। শুধু উনি আমাকে বললেন, খুব বই পড়তে আর লিখে যেতে। এই পর্যন্তই আমার মনে আছে। আর কিছু অবশিষ্ট মনে নেই। তারপর উঠে এসেছিলাম বিদায় নিয়ে পরে আসবো ব'লে।
সেই ঘটনার পর আর কোনওদিন যাওয়ার ইচ্ছা হয়নি সময়ের স্রোতে ভেসে গিয়ে, ইচ্ছে হয়নি কারও সঙ্গে দেখা করার; না শীর্ষেন্দুবাবু, না সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় না অন্য কেউ। দেখা হয়েছে অনেক শিক্ষা, ক্রীড়া, সাহিত্য, নাটক, রাজনীতি ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশিষ্টদের সঙ্গে সেই থেকে আজ এই বয়স পর্যন্ত কিন্তু ঘনিষ্ঠতা বা আলাপ-পরিচয় দানা বাঁধেনি। তবে সুনীলবাবুর ঐ পরামর্শ আজও মাথায় আছে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে শ্রীশ্রীঠাকুরের গ্রন্থ ছাড়া আর কারও বই পড়তে ইচ্ছে হয়নি; কিন্তু যখনি কোনও লেখা, কোনও কথা পড়েছি ও পড়ি বা শুনেছি ও শুনি শ্রীশ্রীঠাকুরের অসীম দয়ায় আজ সবকিছুর পিছনে সত্যটা দেখতে পাই। আর, তাঁর দ্বিতীয় পরামর্শ মেনেছি কিনা জানি না, তবে লেখার আনন্দে লিখে গেছি হাতে যখনি খাতা ডায়েরি পেয়েছি আর এখন তো এই কম্প্যুটার- ল্যাপটপ আর মোবাইলের যুগ। লিখেছি, লিখি নিজের মনের আনন্দে, তাগিদে; দেখতে যাইনি ও যাই না কে পড়লো, না-পড়লো, যাইনি ও যাই না কোথাও লেখা দিতে।
এবার আসি, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এই কবিতা প্রসঙ্গে। এই কবিতার বিষয়বস্তু আমাকে আজ থেকে ৫০বছর আগে ফিরিয়ে নিয়ে গেল, ঠিক যেন টাইম মেশিনে বসিয়ে। আর, তাই তুলে ধরলাম এখানে ল্যাপটপের বুকে। এবার কবিতাটা নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক। শ্রদ্ধেয় কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতাটা নীচে পোষ্ট করেছি। আর, আমি আমার ভাবনাটা কবিতার আকারে এখানে তুলে দিলাম।
এতগুলি যুগ পেরিয়ে গেল,
মানুষ তবুও অবুঝ রয়ে গেল
কিছুতেই বুঝদার হ’তে চায় না।
এখনো বুঝতে চায় না ‘আকাশ’ শব্দটার মানে
সীমানাহীন কোনও বারোয়ারী সম্পত্তি নয়।
মানুষ শব্দটাতে কোনও ভবঘুরে বা ভাদাইম্মা নেই
নিখুঁত 'বাদ'-এর কোনও বোদ্ধা এই বিশ্ব সংসারটা চালাচ্ছেন না।
'বাদ'গুলো সব ইউটোপিয়া
যারা এই ইউটোপিয়ায় বিভোর হ’য়ে থাকে
তারা নিজের অন্তরের মলিন আত্মাটির
কান্না শুনতে পায় না।
তারা অলীক স্বপ্নবিলাশী।----প্রবি।
No comments:
Post a Comment